‘রান্নার ডিপার্টমেন্টটা মূলত আমিই সামলাতাম। দেখা যেত আমি খাবার তৈরি করছি; সেই সময়টাতে ফারাবি গান লিখছে, সুর বসাচ্ছে। আমাকে শোনাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গেই। জানতে চাইছে কী ধরনের অদলবদল করা যায়।’
বলছিলেন দুর্গ ব্যান্ডের ড্রামার ফাহাদ। তখন সদ্যই হার্ডরক ঘরানার ব্যান্ডটিতে যোগ দিয়েছেন তিনি। বয়সের ব্যবধান থাকলেও ব্যান্ডের বাকিদের সঙ্গে রসায়ন জমে উঠেছে অল্প দিনেই। একই বাসায় থাকতেও শুরু করেছেন একসঙ্গে। দিনের শেষে তিনি ফিরছেন অফিস থেকে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষে বাসার পথ ধরেছেন ব্যান্ডের কিবোর্ডিস্ট এবং ভোকাল ফারাবি। বাসার কাজগুলো দুজনেই ভাগ করে নিতেন। সেসব সেরে নেওয়ার সময়টাতে চলত গান নিয়ে কথোপকথন। একবার তো তাঁরা গানের কথা লেখার আগেই সুর তৈরি করে ফেলেছিলেন।
এ রকম দিনকাল পেরিয়ে সম্প্রতি ‘তোমায় ভেবে’ শিরোনামে একটি গান প্রকাশ করেছে দুর্গ। এটি তাঁদের প্রথম অ্যালবাম ‘দেয়াল’-এর দ্বিতীয় ট্র্যাক। ১৪ মে ইউটিউব এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই ব্যান্ডের সদস্যরা ভাসছেন শ্রোতাদের প্রশংসায়।
হোক কলরব
পথচলার প্রথম থেকেই সমাজের সব অসংগতির বিরুদ্ধে গান করার লক্ষ্য তাঁদের। সবাই মিলে নিরাপদ এবং সাম্যবাদী এক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এই প্রত্যাশা পূরণ করাটা মোটেও সহজ নয়। তা ছাড়া আমাদের দেশে রক মিউজিক চর্চা করার পথে রয়েছে অসংখ্য প্রতিকূলতা। প্রতিনিয়তই নানান ধরনের বাধার মুখোমুখি হতে হয় শিল্পীদের। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা যেন একধরনের যুদ্ধ। ‘বলা যেতে পারে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয় দুর্গ থেকে। আমরাও তো একপ্রকার সংগ্রাম করছি। ব্যান্ডের নাম রাখার ক্ষেত্রে এই ভাবনাটাই কাজ করেছে’, জানালেন ফারাবি।
‘তোমায় ভেবে’ মুক্তির সময় পাওয়া গেল দুর্গের এই বিদ্রোহী মনোভাবের পরিচয়। প্রযুক্তির কল্যাণে গান এখন উপভোগ করা যায় খুব সহজেই। বিদায় নিয়েছে সিডি প্লেয়ার, এমপি থ্রি কিংবা অন্যান্য ‘বাহুল্য’। তবে অর্থের বিনিময়ে গান শোনার মনোভাবও সেসবের সঙ্গী হয়েছে। শ্রোতাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছেন অনেক সম্ভাবনাময় শিল্পী। আর এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে দুর্গ। স্বেচ্ছামূল্যের বিনিময়ে সদ্য প্রকাশিত গান ‘তোমায় ভেবে’ উপভোগের সুবিধা রেখেছিলেন তাঁরা। প্রি-অর্ডার করা শ্রোতাদের তাদের ই–মেইলে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল অরিজিনাল সাউন্ডট্র্যাক। এ ক্ষেত্রে অর্থের পরিমাণ নির্ধারণের ভার ছিল আগ্রহীদের হাতেই।
এ প্রয়াস শুভাকাঙ্ক্ষীরা সাদরে গ্রহণ করেছেন। তাতে দুর্গ অনুপ্রাণিত। তাঁদের বিশ্বাস, অন্যান্য ব্যান্ড, সংগীতশিল্পীরাও এভাবে পদক্ষেপ নিলে একসময় বদলে যাবে গান শোনার ক্ষেত্রে অর্থ খরচে অনীহার দৃশ্যপট।
বন্ধুর পথচলা
সেদিন ৩০ সেপ্টেম্বর। দেয়ালে ঝুলছিল ২০১৪ সালের ক্যালেন্ডার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে রীতিমতো আয়োজন করে শুরু হয়েছিল দুর্গের যাত্রা। কিন্তু এরপরের গল্পটা ক্রমাগত ভাঙা-গড়ার। মতের অমিল, জনরা নিয়ে দ্বিধা, পড়াশোনার চাপসহ নানান কারণে ব্যান্ড থেকে সরে দাঁড়ান শুরুর দিকের সদস্য রিয়াসাত ও হাসান। অমসৃণ পথ ধরে এগোতে থাকে দুর্গ। অতিথি শিল্পী থেকে পাকাপাকিভাবে যুক্ত হন ফাহাদ। সঙ্গে বেজিস্টের ভূমিকায় সাকিব। সময়টা ২০১৫।
এরপর ব্যান্ডটি অংশ নিতে থাকে একের পর এক কনসার্টে। শুরু হয় নিজেদের গান তৈরির কাজ। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রস্থানের ঘটনা ঘটে আরও দুবার। থমকে যায় দুর্গ। স্থবিরতা বিরাজ করে বেশ কিছুদিন। সেই সময়ের কথা মনে করতে গিয়ে আক্ষেপ ঝরল ফারাবির কণ্ঠে, ‘কয়েকটা মৌলিক গান তৈরি করে ফেলেছিলাম আমরা। কিন্তু আকস্মিক ধাক্কায় প্রায় ভেঙে পড়ার দশা হয়েছিল।’
তবে ‘বাধা আসে, পেরিয়ে যাই’ নীতিতে ঘুরে দাঁড়ান তাঁরা। গিটারিস্ট হিসেবে আসেন তপু ও সাজিদ। অভিষেকের তিন বছর পর মুক্তি পায় তাঁদের প্রথম গান ‘ভোর হয় না’। বাংলাদেশের প্রথম ক্যাম্পাস বেজড মিক্সড অ্যালবাম ‘অপরাজেয়’তে প্রকাশ পেয়েছিল সেটি। এর অল্প দিনের ব্যবধানে ব্যান্ডের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয় ‘বাংলাদেশ ট্রিবিউট’। নন্দিত ও অনবদ্য কিছু গানের মিশেলে তাঁরা শ্রদ্ধা জানান কিংবদন্তিদের প্রতি।
নতুন দিনের মিছিলে
২০১৭ সালে ব্যান্ড প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছিল কিশোর আলো। বিচারকদের রায় ও শ্রোতাদের মতামতের ভিত্তিতে জয়ী হয়েছিল দুর্গ। গান পরিবেশনের সুযোগ অর্জন করেছিল সেবারের কিআনন্দে। নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে এভাবে এগোতে থাকেন তাঁরা। কনসার্টে অংশগ্রহণ, জ্যামিং চলতে থাকে নিয়মিত। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ২ মার্চ দুর্গ হাজির হয় নিজেদের ১০০তম শো নিয়ে।
ব্যান্ডের সদস্যদের মতে, বারবার বিপর্যয়ের পরও দুর্গ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রোতাদের অনুপ্রেরণায়। অ্যালবাম প্রকাশের আগেই সমাদৃত হওয়ার কারণও এটিই। গানের আসরগুলোতে অন্যান্য ব্যান্ডের দারুণ সব গানও দুর্গকে বাজাতে দেখা যায়। তবে কভার করার আগে তাঁরা মূল শিল্পীর কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার চেষ্টা করেন। শোনান নিজেদের কিছু অপ্রকাশিত গানও। তাতে মুগ্ধতা বাড়ে শ্রোতাদের। প্রতিনিয়তই জোরালো হয় অনুরোধ—গানগুলোর স্টুডিও ভার্সন চাই।
শ্রোতাদের সমর্থনে আপ্লুত হওয়ার কথা জানালেন প্রত্যেকে। নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলে গেলে দুর্গ গ্রহণ করে সমর্থকদের মতামত। ব্যান্ডের এক সদস্য বললেন, ‘আমরা বিবিএমএফসির এক আয়োজনে সদ্য মুক্তি পাওয়া গানটার কিছু অংশ শুনিয়েছিলাম। দর্শকদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম গানটার নাম কী রাখা যায়। অনেকের কাছ থেকেই “তোমায় ভেবে” রাখার প্রস্তাব আসে। আমাদের কাছেও তা যৌক্তিক মনে হয়। তাই “কান্না” রাখার কথা ভেবে রাখলেও শেষমেশ সিদ্ধান্ত বদলে যায়।’
ফারাবি, ফাহাদ, সাকিব, তপু এবং গত বছর যোগ দেওয়া গিটারিস্ট লুবানকে নিয়ে এখন এগিয়ে যাচ্ছে দুর্গ। সদস্যদের তিনজন চাকরিজীবী। পড়াশোনা করছেন দুজন। বয়সের ব্যবধান থাকলেও প্রত্যেকের মধ্যে বোঝাপড়াটা দারুণ। এর প্রমাণ মিলল সাকিবের কথায়, ‘আমরা সত্যিকার অর্থেই একটা পরিবার। বাইরে থেকে কেউ অনুমানও করতে পারবে না সবাই সমবয়সী নই।’ জানা গেল, গান লেখা থেকে শুরু করে প্রকাশের আগ অবধি সবার মতামতের ভিত্তিতে চলতে থাকে গানের বিবর্তন। ব্যান্ডের জন্য প্রত্যেকেই নিবেদিতপ্রাণ। ফাহাদ তো একবার চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন। এটাকে অবশ্য তিনি খুব বেশি বড় করে দেখতে চাইলেন না। ‘তখন এমনও দিন গেছে যে পরপর তিনটা শো করতে হচ্ছে। চাকরি আর গান একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই আরকি।’ তাঁর নির্লিপ্ত বক্তব্য।
ব্যান্ডের প্রাক্তন সদস্যদের সঙ্গেও দুর্গের সম্পর্কটা সুন্দর। যেকোনো প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়ান তাঁরা। এই যেমন ‘তোমায় ভেবে’ রেকর্ড করা হয়েছিল একসময়ের সারথি সামির স্টুডিওতে। গানটির মিক্সিং, মাস্টারিংয়ের কাজটিও তিনি করেছেন।
সৃষ্টি সুখের উল্লাস
সব মিলিয়ে অ্যালবামের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্দান্তভাবে। দুর্গের চাওয়া—সমাজে কোনো ধরনের বিভেদ না থাকুক, ভেঙে যাক বৈষম্যের সব দেয়াল। অ্যালবামের নামকরণ করা হয়েছে এমন আকাঙ্ক্ষা থেকেই। ‘তোমায় ভেবে’ অবশ্য সে ধরনের গান নয়। ব্যতিক্রম গানটিই সবার আগে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আরেকটি ব্যতিক্রম—অ্যালবামের প্রথম গানটি সবার আগে প্রকাশ করা হয়নি।
আট–নয়টি গান নিয়ে সাজানো হবে ‘দেয়াল’। আরও কয়েকটি গান প্রকাশ পেতে পারে দেড়-দুই মাস ব্যবধানে। বাকিগুলো শোনা যাবে একেবারে অ্যালবামের সঙ্গে। সিডি সংস্করণ এখন ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’। আগ্রহীদের জন্য সীমিত পরিসরে সে ব্যবস্থা থাকবে তবু।
দ্রুততাকে আবশ্যক মেনে কাজ করার ইচ্ছা নেই দুর্গের। ব্যান্ডের সবাই চাইছেন, সবটা এগিয়ে যাক স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তাই তাঁরা সময় নিয়ে গান তৈরি করছেন। চলছেন ‘সন্তুষ্টি যতক্ষণ না ধরা দিচ্ছে, ততক্ষণ অবধি গান প্রকাশ না করা’র নীতিতে। এভাবে তাঁরা ক্রমেই আরও পরিণত হচ্ছেন। আর বিকশিত হওয়ার এই যাত্রাটা তাঁদের কাছে হয়ে উঠেছে ভীষণ উপভোগ্য। আলাপন পর্ব শেষে বুঝতে পারলাম, দুর্গ মেতেছে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’।
ফেসবুক পেজ: www.facebook.com/doorgo.bd
ইউটিউব চ্যানেল : www.youtube.com/c/DoorgoOfficial/about