সে বহুকাল আগের কথা। গ্রিসের করিন্থ নগরীতে রাজত্ব করতেন এক রাজা। ওই নগরীর প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন তিনি। তাঁর নাম ছিল সিসিফাস। রাজার বাবার নাম ছিল আয়োলাস। আয়োলীয়দের পূর্বপুরুষ ছিলেন তিনি। গ্লকাস নামে একটা ছেলেও ছিল সিসিফাসের। সিসিফাস ছিলেন কারিগরি বিদ্যায় বিশেষভাবে পারদর্শী। সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্য বিষয়েও বেশ জ্ঞানগম্যি ছিল তাঁর। সমুদ্রদেবতা পসেইডনের সম্মানে একটা বড় খেলাধুলার আয়োজন করেছিলেন তিনি। বসন্তকালের সুন্দর আবহাওয়ায় বেশ জমত সেই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। চালাক আর স্বার্থ উদ্ধারে খুব দক্ষ মানুষ হিসেবে নামডাক ছিল তাঁর। তবে কিছু দোষও ছিল তাঁর। সেগুলোর কথাও জানত সবাই। ভাই স্যালমোনিয়াসকে খুব হিংসে করতেন সিসিফাস। এমনকি তাকে মেরে ফেলারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। তা ছাড়া তাঁর রাজ্যে বেড়াতে আসা দূর দেশের লোকজন কিংবা তাঁর কাছে আসা অতিথিদের পর্যন্ত হত্যা করতেন তিনি! দেবরাজ জিউস এসব কারণে খুব রুষ্ট ছিলেন সিসিফাসের ওপর।
সিসিফাসের কাহিনি নিয়ে অবশ্য একাধিক রকমের বিবরণ রয়েছে। তা যাহোক, মৃত্যুকে যে তিনি থমকে দিতে পেরেছিলেন, সে বিষয়টা সব বর্ণনাতেই পাওয়া যায়।
একবার হলো কী, নদীদেবতা আসোপাস হন্তদন্ত হয়ে এলেন সিসিফাসের কাছে। জানতে চাইলেন, তাঁর মেয়েকে তিনি দেখেছেন কি না। আরও জানতে চাইলেন মেয়ের হদিস।
মেয়েটা কোথায়, সেটা সত্যি সত্যিই জানতেন সিসিফাস। তাই তিনি ঝটপট জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, জানি আমি। হদিসও দিতে পারি। তবে তার বিনিময়ে একটা জিনিস দিতে হবে আমাকে।’
মেয়েকে ফিরে পেতে আর তর সইছিল না আসোপাসের। তিনিও রাজি হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গেই। সিসিফাস বললেন, ‘আমার রাজ্যে জলের বড় অভাব। মানুষের খুব জলকষ্ট। সব অধিবাসীদের জন্য যদি জলের ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে আমি আপনার মেয়ের হদিস দিতে পারি।’
এটা কোনো ব্যাপারই ছিল না নদীদেবতার জন্য। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করলেন জলের। এবার সিসিফাস বললেন, ‘ইগল এসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে আপনার মেয়েকে।’
সে তো ইগল নয়, আসলে দেবরাজ জিউস। নদীদেবতা ছুটলেন মেয়ের খোঁজে। ওদিকে জিউসের কাছেও গোপন রইল না ঘটনাটা। তিনি তো রেগেই আগুন। তাড়াতাড়ি সিসিফাসকে শায়েস্তা করতে হুকুম দিলেন তাঁর ভাই পাতালদেব আর মৃত্যুদেব হেডিসকে।
খবরটা ছড়িয়ে পড়তে দেরি লাগল না মোটেই। যার বিরুদ্ধে এত গর্জন, সেই সিসিফাসও জেনে ফেললেন ব্যাপারটা। কী ঘটতে চলেছে, বুঝে ফেললেন তিনি। মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে কম সাজা যে তিনি পাবেন না, তা তিনি বুঝে গেলেন।
সিসিফাস বুঝতে পারলেন, যম এসে শিগগিরই হানা দিতে চলেছে তাঁর ওপর। কিন্তু তিনি এত তাড়াতাড়ি মরতে রাজি ছিলেন না মোটেও। তখন রীতি ছিল, মৃত মানুষের জিবের নিচে পয়সা রেখে দেওয়ার। তিনি নিজের স্ত্রীকে ডেকে বললেন, তাঁর জিবের নিচে যেন পয়সা রেখে দেয়া না হয়। আর মৃতদেহটা সমাধিস্থ না করে যেন ফেলে রাখা হয় শহরের বড় চত্বরে।
শিগগিরই দেবতার রোষে মৃত্যু হলো সিসিফাসের। তারপর তো তাঁর পাতালপথে যাত্রা। তো এই যাত্রাকালে স্টিক্স নদীর তীরে গিয়ে হাজির হলেন তিনি। সেখানে মৃত্যুদেব এসে তাঁর কাছে পারাপারের পয়সা চাইলেন। এই নদী না পেরিয়ে তো আর পাতালে যাওয়া যাবে না। কিন্তু সিসিফাস তো পয়সা আনেননি। এ ঘটনায় বিরক্ত হলেন মৃত্যুদেব। কষে ধমকও লাগালেন তিনি। তখন মৃত্যুদেবের কাছে শুধু একটিবারের জন্য গিয়ে পয়সা নিয়ে আসার অনুমতি চাইলেন সিসিফাস। আর মিনতি জানিয়ে বললেন, স্ত্রী তাঁর মৃতদেহকে সমাধিস্থ না করে খোলা জায়গায় ফেলে রেখে যে অমর্যাদা করেছে, সেটার সাজাও তাঁকে দিয়ে আসতে চান তিনি।
কাজ হলো এতে। নরম হলো মৃত্যুদেবের মন। তিনি বললেন, বেশ, যাও, তবে তা মাত্র একটা দিনের জন্য। কাল সূর্যাস্তের আগেই ফিরে আসতে হবে তোমাকে।
সিসিফাস তো আর মৃত অবস্থায় পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারেন না। ফলে তিনি এবার বেঁচে উঠলেন। জীবন ফিরে পেয়ে তো আনন্দে মাতোয়ারা সিসিফাস! আর তিনি ফিরলেন না পাতালে। বহুকাল বেঁচে রইলেন এবং দীর্ঘ জীবন ভোগ করে বুড়ো হয়ে তারপর মরলেন। তবে মরেও হলো না শান্তি! বলছি সেই কাহিনি। তবে তার আগে অন্য একটা কথা বলে রাখি। সেটা ওই জিউসের রাগারাগির ব্যাপার। অন্য এক বর্ণনায় আছে, জিউস রুষ্ট হয়ে সিসিফাসকে পাকড়াও করার আদেশ দিলেন। যিনি সেই হুকুম তামিল করতে এলেন, তার হাতে ছিল শিকল। বাঁধার জন্য আনা হয়েছিল সেই শিকল। সিসিফাসের তো বুদ্ধি ছিল প্রখর। শিকল কী করে কাজ করে, তা জানতে চাইলেন। এভাবে কায়দা করে শিকল হাতে নিয়েই ঝটপট বেঁধে ফেললেন তাকে। সিসিফাসকে বেঁধে নিয়ে মেরে ফেলার বদলে নিজেই বাঁধা পড়লেন। তখন ঘটল এক মহা অঘটন। মানুষের মৃত্যু গেল বন্ধ হয়ে। রাজায় রাজায় ঘোরতর যুদ্ধ হলো। কিন্তু মৃত্যুই তো থমকে গেছে, তাই কেউই মরছে না। যমরাজ্যে হাহাকার উঠল। মানুষই যখন মরছে না, যমপুরীর আর কাজ কী! কিন্তু দেবতাদের সঙ্গে নশ্বর মানুষ পারবে কেন? শেষমেশ মৃত্যু হলো তাঁর। অবশ্য মৃত্যুর পরের ঘটনা দুই বর্ণনাতেই এক। কী সেই বর্ণনা? বলছি এবার। মৃত্যুদেবের সঙ্গে চালাকি করায় ভীষণ খেপে উঠলেন তিনি। কঠিন সাজা দিলেন সিসিফাসকে। কী সেই সাজা? সাজাটা হলো বিশাল এক পাথর পাহাড়ের নিচ থেকে ঠেলতে ঠেলতে চূড়ায় তুলতে হবে। সিসিফাস ঠেলতে লাগলেন। মস্ত সেই পাথর তুলতে গিয়ে কী যে কষ্ট হলো তাঁর! কিন্তু যেই না পাহাড়চূড়ায় তুললেন, অমনি তা গড়িয়ে নিচে নেমে এল আবারও। আবারও তা ঠেলে তুললেন সিসিফাস। আবার তা গড়িয়ে নিচে পড়ল। যতবারই তিনি তোলেন, ততবারই তা নেমে আসে। এভাবে অনন্তকাল
সিসিফাসের গল্পের শিক্ষা: নিজেকে চালাক ভাবলেই চালাক হওয়া যায় না। প্রতারণার জবাব পেতেই হয়। তবে অনেক দার্শনিক এই গল্পের আরও গূঢ় অর্থের কথাও বলেছেন।