বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন। এ ম্যাগাজিনের ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় লুইস মার্ডেন নামের এক সাগরতলের আলোকচিত্রীর লেখা ছাপা হয়। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘ক্যামেরা আন্ডার দ্য সি’। জলে-স্থলে রঙিন ছবি তোলার প্রযুক্তি আবিষ্কার ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন এই মার্কিন আলোকচিত্রী। তাঁর জন্ম ১৯১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি, যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৫৫ সালে তিনি একদল ফরাসি সমুদ্র অভিযাত্রিকের সঙ্গে লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগর ভ্রমণ করেন। সমুদ্রতলের রঙিন ছবি তোলার দায়িত্ব ছিল মার্ডেনের। সেই দুঃসাহসিক অভিযানের কথাই তিনি তুলে ধরেছিলেন লেখাটিতে।
গত চার মাস আমি লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরের গভীরের নীল রঙের জাদু-দুনিয়া চষে বেড়িয়েছি। এ সময় আমাকে সত্যি সত্যি মাছের গা ঘেঁষে চলাফেরা করতে হয়েছে। মাছ আমার ভালো না লাগলে কী মুশকিলেই না পড়তে হতো!
আট বছর আগের কথা। আমি তখন প্যারিসে। সে সময় প্রথম শুনি ক্যাপ্টেন জ্যাক-ইভ কুস্তো আর তাঁর অভিযাত্রী দলের কথা। কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রে এই সাহসী ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমার হাতে ছিল তাঁর লেখা দ্য সাইলেন্ট ওয়ার্ল্ড বইটি। তিনি অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে বইটিতে লিখেছিলেন, ‘কথা দিলাম, একদিন একসঙ্গে কাজ করব।’
গত বসন্তে তাঁর সে কথা সত্যি হলো। আমি ক্যাপ্টেন আর তাঁর দলের সঙ্গে তাঁদেরই ‘ক্যালিপ্সো’ নামক জাহাজে করে রওনা হলাম। গোটা বিশ্বের সমুদ্র অভিযাত্রীদের কাছে এই ‘ক্যালিপ্সো’ কিংবদন্তিতুল্য। আমি ছিলাম ওই দলের আন্ডারওয়াটার কালার ফটোগ্রাফার।
আমরা কালার ফটোগ্রাফির জন্য একটি দারুণ জায়গা পেলাম। বিশাল আকৃতির ভারত মহাসাগরের একটি বিন্দু, নাম অ্যাজাম্পশন দ্বীপ। এই দ্বীপের ওপর দিয়ে তীব্র বেগে মৌসুমি বায়ু বয়ে যায়। এটি মাদাগাস্কারের ২৪০ মাইল উত্তরে। দ্বীপটিতে কিছু মানুষের বাস। দ্বীপের সাদা বালু ও ঝোপ ততটা আকর্ষণীয় নয়। তারপরও আমাদের ক্যালিপ্সো ধীরে ধীরে সেদিকেই এগিয়ে যেতে লাগল। একসময় হলদে-বাদামি রঙের একটি বিশাল প্রবাল প্রাচীর এলাকায় নোঙর করল।
আমাদের জাহাজের ফ্রেডেরিক ডুমা ও অ্যালবার্ট ফ্যালকো জলে নামলেন। কিছুক্ষণ পর তাঁরা শিলের মতো ভেসে উঠলেন এবং অক্সিজেনের মাস্ক মুখ থেকে সরিয়ে ‘অসাধারণ!’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। হয়তো অসাধারণই। এই ঝানু অভিযাত্রীদের তুলনায় আমার জানাশোনা নগণ্য। কিন্তু তারপরও বলতে হয়, এই প্রবাল প্রাচীর এলাকায় সাঁতরে আমার চোখে এখন পর্যন্ত মনোরম দৃশ্য চোখে পড়েনি। আমি সিঁড়িতে ঝুলে পেছনের দিকে মাথা কাত করে জলে ঝাঁপ দিলাম। প্রথম দফায় জলের মাত্র কয়েক ফুট নিচে যেতে পারলাম। তারপর গভীরতা দ্বিগুণ করে পায়ের পাতায় লাগানো রাবারের পাখনার সাহায্যে সোজা নিচের দিকে এগিয়ে গেলাম।
৩০ ফুট নিচে পেলাম একটি নিচু ‘প্রবালারণ্য’, যা হালকা হলদে, গোলাপি, নীল ও বেগুনি আলো ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন আকৃতির প্রবাল। বামন গাছ, ছাতা, কুণ্ডলী পাকানো গম্বুজ এবং বাঁকানো আঙুল ছড়িয়ে আছে। ক্রমেই যেতে যেতে দূর নীলের মধ্যে হারিয়ে গেছে প্রবালের সারি।
উষ্ণ জলের উজ্জ্বল স্বচ্ছতা ভেদ করে সূর্যের আলো এসে আমার গায়ে পড়ল। চাঁদের আলোর মতো কোমল আলোকধারায় মাছ, প্রবাল, এমনকি আমার শরীর অবয়ব পেয়েছে। মনে হচ্ছিল একটি তরল নীলকান্ত মণির মাঝখানে স্থির ঝুলে আছি। প্রবালারণ্যে অসংখ্য মাছের বসবাস। সবুজ, হলুদ, লাল, নীল ও কালো রঙের ছোট ছোট মাছ কখনো দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে, কখনোবা বোকার মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকছে। নিজেদের উচ্চবর্গীয় বিবেচনা করেই কিনা কে জানে, বড় মাছেরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে এই ভিতু ছোট মাছের ভিড়ের মধ্যখান দিয়ে চলে যায়।
আমি যখন দ্রুত নিচের দিকে ফিরলাম, তখন অগণিত মাছের নিরেট প্রাচীরের মাঝখানে ফুটো তৈরি হলো। আমাকে ফুটোর মাঝ বরাবর রেখে মাছগুলো চলতে লাগল—বাতাস যেমন করে নির্বিঘ্নে এয়ারফয়েলের (যেমন বিমানের ডানা) চারপাশ দিয়ে বের হয়ে যায় ঠিক সেভাবে। প্রাচীর অতিক্রম করার পর মাছগুলো আগের জায়গায় ফিরে এসে ফুটোটা পূরণ করে দিল। নিচের দিকের কিছু ছোট্ট মাছ আমার দিকে এসে ঢুলুঢুলু ও কৌতূহলী চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
একটু জিরিয়ে নিতে আমি সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি বড় প্রবালের ওপর উঠলাম। আমি যে প্রবালটির ওপর দাঁড়িয়ে আছি তার চূড়া প্রবালকীটে মোড়া এবং তার ওপর আঙুলের মতো দেখতে জলজ উদ্ভিদের আস্তর। উদ্ভিদগুলো সাপের মতো দুলছে। আমি এই প্রবালকীটের পুরু পরতের ওপর বসে একটু জিরিয়ে নিতে চাইছিলাম। কিন্তু আমি জানি, আমাকে ক্ষতবিক্ষত করতে এই পরতের এক ইঞ্চি নিচেই লুকিয়ে আছে নরম কিন্তু ক্ষুরের মতো ধারালো প্রবাল। আমার চোখ বরাবর ভাসছে জলজ উদ্ভিদের আঙুলের মতো দেখতে বিপজ্জনক অংশ। জোরালো জোয়ারের সময় এই উদ্ভিদগুলো সুন্দরভাবে নাচে। তখন এগুলোর মাংসল শরীর থেকে হঠাৎ হঠাৎ গাঢ় ম্যাজেন্টা রঙের আলো বের হয়।
দুটো কমলা রঙের ছোট মাছ জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলছিল। এই মাছগুলো নিশ্চিন্তে এই অঙ্গুলাকৃতির উদ্ভিদের আড়ালে থাকে। তারা জানে, উদ্ভিদগুলো তাদের বন্ধু, আর এ জন্যই উদ্ভিদগুলো নিজেদের বিপজ্জনক শুঁড়গুলো সরিয়ে রাখবে, যাতে বন্ধুদের কোনো ক্ষতি না হয়। বিনিময়ে ছোট মাছগুলো তাদের খাদ্য উদ্ভিদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়। আমি উদ্ভিদগুলোর একটি ছবি তুলে ক্যামেরার বাল্ব বদলাতে ক্যামেরার দিকে ঝুঁকলাম। অক্সিজেনের মাস্ক পরে সোজাসুজি দেখা গেলেও ডানে-বাঁয়ে দেখতে পাওয়া কঠিন। তা-ও দেখার চেষ্টা করলাম, চোখ ফেরাতেই আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। আমার কাছ থেকে এক ফুটেরও কম দূরত্বে দুঃস্বপ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে একটি ‘গ্রাউপার’ মাছ। আমার মাথার চেয়ে বড় এর মাথা। তাতে নানা দাগ ও রঙের ছোপ। ঝুলে থাকা মোটা মোটা ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছে সে অসন্তুষ্ট। মাছটি জ্বলজ্বলে বিরক্তিভরা চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
পাথরে আমার পিঠ ঠেকে গেছে। তাই নিচের বালুর দিকে ধীরে ধীরে নেমে যেতে লাগলাম। ঠিক তখনই প্রায় ৬০ পাউন্ড ওজনের গ্রাউপারটি নিজের লেজ ঝাপটাতে ঝাপটাতে আমার দিকে আসতে লাগল।
আগেই বলেছি, আমি মাছ পছন্দ করি। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে আসলে মাছও আমাকে পছন্দ করে। আমি যেখানেই যাব, এই দানবাকৃতির মাছটিও সেখানে যাবে। গ্রাউপারটি ধীরে ধীরে আমাকে অনুসরণ করছে। আমার সবকিছু বোঝার চেষ্টা করছে এবং নাক দিয়ে চাপ দিয়ে আমার ফ্ল্যাশ-বাল্ব রিফ্লেক্টরটিও পরখ করে দেখছে। আমি বুঝতে পারলাম, এই রিফ্লেক্টরটিই মাছটিকে আকর্ষণ করেছে।
কুস্তো বলেন, গ্রাউপাররা হলো সমুদ্রের বুদ্ধিজীবী। আসলেই তাই, এরা আমার দেখা সবচেয়ে কৌতূহলী মাছ। তারা যখন তোমার দিকে এগিয়ে আসবে তাদের মাথায় চলা কর্মকাণ্ডের শব্দ শোনা যায়। এগিয়ে এসে তোমার দিকে পেট দিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, যাতে তোমাকে এক চোখ দিয়ে দেখতে পারে। তারা যেমন জ্ঞানীর মতো আচরণ করে, অন্যদিকে তাদের আচরণটা অনেকটা গেঁয়ো মানুষের মতোও। তাদের কাছে যা নতুন ও জটিল, তার সামনে তারা আগ্রহ নিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে পড়ে।
সেই দিন থেকে এই গ্রাউপারটি আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হয়ে গেল। এই মাছটির বড় দাঁত নেই এবং সে বন্ধুর মতোই আচরণ করে। আকস্মিকভাবে পেছন থেকে কোনো মাছ এগিয়ে আসছে তা দেখার চেয়ে এই বন্ধুসুলভ আচরণ ঢের ভালো। মাছটি আমার চোখের সামনে থেকে সরে গেলেই আমার অস্বস্তি বোধ হয়। আমি এখন কিছুটা হলেও বুঝি, কেন কখনো পেছন দিক থেকে কোনো ঘোড়ার কাছে যেতে নেই।
আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন গ্রাউপারটির নাম রাখল ‘ইউলিসিস’। একবার এক ডুবুরি মাছটিকে ভয় পাইয়ে দিলে সে ছুটে পালায়। তারপর লেজ ঝাপটাতে ঝাপটাতে বুপ, বুপ, বুপ শব্দ করতে লাগল। আমি তার পেটে হাত বুলিয়ে দিলে সে শান্ত হয় এবং পোষা কুকুরের মতো আনন্দে চিত হয়ে যায়।
ইউলিসিসের উপদ্রব দিন দিন বাড়তে লাগল। এমনকি তার ছবি তোলাও কঠিন হয়ে পড়ল। আমি তিন ফুট দূরে ক্যামেরা স্থাপন করে ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখলাম। তখন দেখা গেল, ওই ভোঁতা মাথাওয়ালা মাছটিও ক্যামেরার কাছে চলে এসেছে। শাটার রিলিজ বোতাম চাপার আগেই দেখি সে ক্যামেরার লেন্সের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একে ফোকাস করতে আমাকে যে কসরত করতে হতো তা দেখে আমার সহকর্মীরা হাসিতে ফেটে পড়ত। তারা বলত, ‘তোমার এই গ্রাউপার লেন্সপ্রেমী। ক্যামেরার জন্য হুমকি এই গ্রাউপারকে ক্যামেরা থেকে দূরে রাখা উচিত।’
অ্যাজাম্পশন দ্বীপের প্রবাল প্রাচীরে অনাদিকাল থেকে মাছের বসবাস। তারা কখনো মানুষ দেখেনি, তাই মানুষকে তারা ভয় পায় না বললেই চলে। প্রথমে তারা একটু দূরেই থাকে। কিছুদিন পর যখন দেখে আমরা তাদের কোনো ক্ষতি করছি না তখন জাহাজের আশপাশের বেশির ভাগ মাছ আমাদের আপন করে নেয়।
ক্যালিপ্সো জাহাজে একমাত্র বাবুর্চিই মাছ শিকার করতে পারত। ক্যাপ্টেন কুস্তো অনুমতি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বলা আছে ছোট বড়শি ব্যবহার করতে হবে। একদিন জাহাজের নিচে সাঁতার কাটছিলাম, দেখি বড়শি নিচে নামছে। দুষ্টুমি করে বড়শিটি ধরে জোরে টান দিয়ে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু কিছু হলো না। যখন জাহাজে এলাম তখন বাবুর্চি হানেন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শোনো, আমি কিন্তু আমার ভাগের মাছ ধরে ফেলেছি। এখন তোমাদের জন্য মাছ খুঁজছি।’
ক্যালিপ্সোর নিচে যেসব মাছ দেখেছি তাদের বেশির ভাগই প্রবাল প্রাচীরের একই স্থানে বসবাস করে। কিন্তু জাহাজের মাঝ বরাবর দেড় শ ফুট নিচে প্রবালারণ্য। এই শূন্যস্থানে উন্মুক্ত সমুদ্র থেকে আসা মাছের ঝাঁক চলাচল করে। এদের মধ্যে হান্টার্স বোল্ড, সুইফট ফিশ, অর্ধচন্দ্রাকৃতির পাতলা লেজবিশিষ্ট দ্রুতগতির টর্পেডো অন্যতম। বড় বড় চোখবিশিষ্ট জ্যাক মাছ দেখতে চ্যাপ্টা ও ছোট। জ্যাকের শরীর গলিত রুপার মতো চকচকে। আমরা যখন প্রবালের ওপর দিয়ে যেতাম, তখন জ্যাক মাছগুলো আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করত। একবার প্রায় ৩০ পাউন্ড ওজনের একটি জ্যাক আমার পেছন দিক থেকে আচমকা এগিয়ে আসে। ফ্ল্যাশ রিফেলেক্টরে আঘাত লেগে জোরে ঝনঝন শব্দ হয়। মাছটি আমার পেছনে দিয়ে গিয়ে আবার ঘুরেফিরে আসে, ভয়ে আমার মুখ থেকে মাউথ পিসটি প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। কারণ, ভেবেছিলাম, এটি হাঙর অথবা বারাকুডা। আমি পেছনে ফিরলাম এবং মাছটির লেজ ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। এটা তার নিজের জগৎ, আমার নয়। আমি আর কখনোই এদের ধরার চেষ্টা করিনি।
খাদের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ঠিক নিচেই দেখতাম এক রহস্যময় নীল রঙের দুনিয়া। গভীরতা যত বাড়ে, নীল কোবাল্টের ঘনত্ব তত বাড়ে। এমনকি স্বচ্ছ জলেও অসংখ্য নীল ক্ষুদ্র কণা মিশে আছে। আলো এই কণাগুলোতে প্রতিফলিত হয় বলেই জল নীল দেখায়। স্বচ্ছ জলে দেখতে পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত হয় আলোছায়ার খেলায়। মেঘাচ্ছন্নতার কারণে দূরের কোনো কিছু একেবারে হারিয়ে যায় না, উজ্জ্বল নীল আলোতে অদৃশ্য হয়ে যায়।
সমুদ্রের জল এক রহস্যময় পদার্থ। কুস্তো বলেন, ‘মানুষ সমুদ্রের স্বচ্ছ জলকে রাসায়নিক প্রক্রিয়াজাত জল মনে করে, আকারহীন বিশুদ্ধ তরল পদার্থ হিসেবে জানে। এর চেয়ে বড় ভুল আর হতে পারে না। সমুদ্রের জল হলো জীবন্ত স্যুপ। এই মিশ্রণ লাখ লাখ মাইক্রোস্কোপিক জীবন্ত প্রাণী ও উদ্ভিদকণা দ্বারা তৈরি এবং অন্যান্য জীবের মতোই এরাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।’
ক্যালিপ্সোর ডুবুরিরা প্রতিদিন কমপক্ষে তিনবার ডাইভ দিত, মাঝেমধ্যে পাঁচবারও। এ সময় কোনো কিছুতেই আনন্দ পেতাম না, বারবার ডুবসাঁতারের ক্লান্তিকর অবসাদ কাবু করে ফেলত। বিশেষ করে জল থেকে জাহাজের সিঁড়ির দিকে উঠে যাওয়ার মুহূর্তে। তখন পিঠে বাঁধা স্টিলের তিনটি সিলিন্ডার এবং সিসার বেল্টের ওজন মনে হতো এক টন।
সিঁড়ি দিয়ে নিজেকে টেনে তুলতে তুলতে দেখি ক্যাপ্টেন কুস্তোর দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা পাখি আকৃতির অবয়ব। তার পা দুটো ছড়ানো, কোমরে দুই হাত, নিজের ভাঙা পাইপটি টানছেন। ডুবুরিরা কী তথ্য নিয়ে এল—তা গভীর মনোযোগসহকারে দেখছেন। জাহাজে উঠে আমি ভারী সিলিন্ডারগুলো খুলে ফেললাম এবং জাহাজের পাটাতনের জলে নিজেকে ছেড়ে দিলাম। রোদ থাকায় জলটা বেশ গরম ছিল। তারপর কুস্তোকে বললাম, ‘আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি বাজে জিনিস। ঈশ্বর যদি চাইতেন মানুষ জলের তলায় গিয়ে ছবি তুলবে, তাহলে তো তিনি মানুষকে মাছের মতো ফুলকোও দিতেন।’ ডুমা জাহাজের হ্যাচ কভারের ওপর হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিল, সে জবাব দিল, ‘আমি অনেক দিন আগে থেকেই এ কথার সঙ্গে একমত...’
একদিন আমরা দ্য সাইলেন্ট ওয়ার্ল্ড তথ্যচিত্রের জন্য জলের ১৪৪ ফুট নিচে শুটিং করছিলাম। অভিনয়শিল্পী, লাইটম্যান, ক্যামেরাম্যানসহ নয়জন ডুবুরি এতে অংশ নিয়েছিলেন। তথ্যচিত্রের নির্দেশক ক্যাপ্টেন কুস্তোর নির্দেশে আমরা শরীর বাঁকা করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এরপর যত দ্রুত সম্ভব চাপ বাড়িয়ে গভীর জলের নীলাভ অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
প্রবাল প্রাচীরের গোড়ার কাছে একটি প্যাঁচানো প্রবাল স্তম্ভ তৈরি হয়েছে, যার উচ্চতা ১০ ফুট। এখানে দেখলাম প্রায় সব প্রজাতির সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতিনিধি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে টকটকে লাল ও হলুদ রঙের পরাশ্রয়ী স্পঞ্জ, আঁশের মতো দেখতে হলদে রঙের সিফ্যান, থালার মতো দেখতে মুক্তোর ঝিনুক। আর স্তম্ভের শিরোমণি হয়ে আছে ব্ল্যাক কোরালের পালক আচ্ছাদিত মনোরম গুল্ম। এই খুদে অরণ্যের মধ্যেই দেখা যায় দ্রুতগতির নীল রাশ মাছ, কালো ও হলদে রঙের ভিতু ড্যামসেলফিশ আর অনবদ্য জোড়া বাটারফ্লাই ফিশ ছুটে বেড়াচ্ছে।
একটি দৃশ্য ধারণ করতে আমরা প্রবাল স্তম্ভের চারপাশে আমাদের সরঞ্জাম স্থাপন করলাম। বাতিগুলো স্তম্ভের মাঝ বরাবর পর্যন্ত ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। আমি হাঁটু গেড়ে বালুতে বসে পড়লাম। বালুতে যাতে বেশি দেবে না যাই, সে জন্য ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম। না হলে আমার চাপে বালু ছড়িয়ে পড়বে। সাধারণভাবে দেখতে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদগুলোকে নীল মনে হয়। তারপর নির্দেশক কুস্তোর ইশারায় ফ্লাডলাইটগুলো জ্বলে উঠল।
কী অপূর্ব রূপান্তর! বাতিগুলো টকটকে কমলা, লাল এবং সরষে হলুদ রঙের উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। গাঢ় নীল ও কালো রঙের জগতে থাকা মাছগুলো আমাদের আলোর নিচে আসতেই উজ্জ্বল কমলা ও হলুদ রঙে বদলে গেল। তারপর মাছগুলো আলো এড়িয়ে নিজেদের নীলাভ জগতে ফিরে গেল...
আমি আমার টুইন-বাল্ব ক্যামেরাটি তুলে ধরলাম, ঠিক তখন মৃদু কম্পন এবং পিঠে ভারী আঘাত অনুভব করলাম। হতবাক হয়ে দেখলাম, আমার ২০টি ফ্ল্যাশ-বাল্ব পড়ে ভেঙে গেছে। ব্যাগভর্তি বাল্ব আমার কাঁধে ঝোলানো ছিল। নিশ্চয়ই কোনো কিছু ব্যাগটির গা ঘেঁষে চলে গেছে, যে জন্য ব্যাগটি ছিঁড়েছে। বাল্বগুলো ইতিমধ্যে জলের তলার চাপের মধ্যে দিয়ে গেছে। বাল্বের ভেতরকার শূন্যতার বিরুদ্ধে চাপ। তাই একসঙ্গে বাল্বগুলো ভেঙেছে। আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম, চকচকে ধাতব ফয়েলের টুকরোগুলো রুপালি বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে আছে আমার সামনে।
আমার আট সহকর্মীর অট্টহাসি আমাকে ঘিরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। যেন ইকো চেম্বারে দুঃস্বপ্নের দৃশ্য রেকর্ড করা হচ্ছে। আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, ‘আমার বন্ধুরা!’ তারপর তাদের কাছে এগিয়ে গেলাম। তারা সত্যি সত্যি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। জলের নিচে সুবিধা হলো তুমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে পারবে, পাক খেতে পারবে এবং ডিগবাজিও মারতে পারবে। তবে সাবধান, হাসি হতে হবে চাপা, নইলে অক্সিজেন সরবরাহকারী মাউথ পিস মুখ থেকে ছুটে যেতে পারে...।
জলের গভীর থেকে উঠে আসা অনেকটা স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার মতো ব্যাপার। দ্রুত পাখনা চালিয়ে আমরা জাহাজে উঠি। অক্সিজেনের সিলিন্ডার ছাড়ার পর নিজেদের কিছুটা হালকা মনে হয়। তারপর ধীরে ধীরে মেঝেতে শুয়ে পড়ি। জল থেকে ওঠার পর সাবানের ফেনায় আমাদের গোসল করতে হয়। সেসময় মনে হলো যেন বুদ্বুদে ডুবে গোসল করছি।
জলের গভীর থেকে ওপরে উঠতে উঠতে চাপও কমতে থাকে, মাথাও ঝিমঝিম করে। একজন ডুবুরি এক নির্মল নীল জগতের সন্ধান পায় যখন সে ১০০ ফুট স্বচ্ছ জলের নিচের স্তরের দিকে চোখ দেয়। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সঙ্গে একমাত্র ফ্রান্সের ত্রয়োদশ শতকের শারট্রে ক্যাথেড্রালের জানালার কাচের মিল আমি খুঁজে পেয়েছি।