মার্কিন কবি মুরিয়েন রুকেসারকে চেনো? না চেনারই কথা। তাঁকে কিন্তু আমিও ঠিক চিনি না, তবে বাণী চিরন্তনীতে তাঁর একটা কথা পড়ে একবার মনে বেশ দাগ কেটেছিল। তিনি বলেছিলেন, মহাবিশ্ব পরমাণু নিয়ে নয়, বরং গল্প দিয়ে তৈরি। তাঁর এ ছোট্ট কথাতেই বোঝা যায়, মানুষ গল্প শুনতে বা পড়তে ভালোবাসে। সে কারণেই যুগে যুগে কবি–সাহিত্যিকেরা আমাদের মণিকোঠায় স্থান করে নেন, তাঁদের সাহিত্যকীর্তির মধ্য দিয়ে তাঁরা আমজনতার কাছে অমর হয়ে ওঠেন। সে কারণেই আড়াই হাজার বছর আগের পৃথিবীর আর কারও কথা তোমার মনে না থাকলেও ইশপের কথা ঠিকই মনে আছে। এই গ্রিক লেখকের নীতিকথা শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পেতে পৃথিবীতে নয়, যেতে হবে সুদূরের কোনো গ্রহের এলিয়েনদের কাছে।
ইশপের জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৬২০ সালে, গ্রিসে বলে ধারণা করা হয়। সেকালে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য না জানা গেলেও ইশপ যে দাস ছিলেন, সে ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত। চেহারাটাও খুব আহামরি টাইপের কিছু ছিল না। পিঠে একটা কুঁজ থাকায় একটু বেঁকে খুড়িয়ে হাঁটতেন। তবে তাঁর অমর হওয়ার পথে এগুলো কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কারণ, মুখে মুখে বুদ্ধিদীপ্ত গল্প বানিয়ে তাঁর মালিকসহ অনেকের মন কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। এভাবে একদিন দাসত্ব থেকেও মুক্তি পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। কথিত আছে, সে যুগের এক দেবীর দৈববাণী অমান্য করায় তাঁকে পাহাড়চূড়া থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু হত্যাকারীদের নাম কেউ মনে রাখেনি, অথচ এখনো বিশ্বজুড়ে অমর ইশপ। মজার ব্যাপার হলো, তাঁকে অমর করে রাখতে আধুনিক বিজ্ঞানীদেরও কিন্তু চেষ্টার কমতি নেই। সে কারণে পাখনাওয়ালা বিলুপ্ত একটি মাছের বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয়েছে ইশপের নামে। উত্তর আমেরিকায় প্রাগৈতিহাসিককালে বিচরণ করা এই মাছের নাম ইশপিচথিস (Aesopichthys erinaceus)। মাছটির ছোট দেহের তুলনায় তার পিঠটি বেশ প্রশস্ত, যা দেখতে অনেকটা কুঁজের মতোই মনে হয়। ঠিক যেন ইশপের পিঠের সেই কুঁজ। এই মিলের কারণেই মাছটির এমন নাম।
শুধু ইশপই নয়, প্রাচীন পৃথিবীর আরেক কিংবদন্তি কবি হোমার। ইলিয়াড এবং ওডিসি মহাকাব্য লেখার জন্য তিনি সুপরিচিত। তাঁর স্মরণে কাকড়াজাতীয় ছোট্ট একদল প্রাণীর গণের নাম দেওয়া হয়েছে হোমারিয়ন (Homeryon)। এই প্রাণীরা আসলে অন্ধ। কথিত আছে হোমারও অন্ধ ছিলেন। সে কারণেই এমন নাম। হোমারিয়ন গণে দুটি প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়, সেগুলো হলো: Homeryon armarium এবং Homeryon asper।
বলে রাখা ভালো, সুইডিশ বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস জীবের বৈজ্ঞানিক নামকরণ পদ্ধতির প্রচলন করছিলেন। তাঁর পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রতিটি উদ্ভিদ বা প্রাণীদের দ্বিপদী (দুই পদ) নামকরণ করা হয়। এর প্রথম পদটিকে বলা হয় গণ এবং দ্বিতীয় পদটিকে বলা হয় প্রজাতি। যেমন ধরা যাক, মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হোমো স্যাপিয়েনস (Homo sapiens)। এখানে হোমো হলো গণ এবং স্যাপিয়েন্স হলো প্রজাতি।
আগের কথায় ফিরি এবার। ধরা যাক, কোনো কারণে একদিন পৃথিবী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। বিশ্ব চরাচরজুড়ে কোনো জীবিত মানুষের চিহ্ন নেই। কোনো এলিয়েন পৃথিবীতে এসে মাটি খুঁড়ে মানুষের ফসিল আবিষ্কার করল একদিন। তারা এখন জানতে চায়, এই মানুষগুলো আসলে কেমন ছিল? কেমন ছিল তাদের সমাজ? সেসব প্রশ্নের উত্তর কি তারা কোনো দিন জানতে পারবে? এর উত্তরে অনেকে বলেন, পারবে, যদি তারা উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কোনো লেখা খুঁজে পান। ওই লেখার পাঠোদ্ধার করেই মানুষ নামক অদ্ভুত প্রাণীর আচার-ব্যবহার, জীবনযাপন, মায়া-মমতা, হিংসা-দ্বেষ, রাগ-ক্রোধ—সবই জানতে পারবে এলিয়েনরা। অদ্ভুত, তাই না! তাই এমন প্রভাবশালী লেখকের নামে কোনো প্রাণীর নামকরণ করা হবে না, তা কি হয়। শেক্সপিয়ারের নামে একটি ব্যাকটেরিয়ার নামকরণ করা হয়েছে, Legionella shakespearei। কারণ ব্রিটিশ এই নাট্যকারের জন্মস্থান স্ট্রাটফোর্ড-আপওন-অ্যাভনে আবিষ্কৃত হয়েছিল এই ব্যাকটেরিয়া। আবার শেক্সপিয়ার এবং জার্মান কবি গ্যোয়েটের নাম দুটি মিলিয়ে যৌথভাবে একটি বোলতারও নামকরণ করা হয়েছে। যার নাম Goetheana shakespearei। ডক্টর ফাউস্টখ্যাত জার্মান লেখক জোনান উলফগ্যাং ভন গ্যাটের নামে শুধু এই বোলতাই নয়, একটি ক্ষুদ্র অণুজীবের নামকরণও করা হয়েছে। এর নাম সাইক্লাডোফোরা গ্যাটেনা (Cycladophora goetheana)।
শালর্ক হোমসের কথা মনে আছে। শার্লক হোমসের প্রথম উদয় হয়েছিল ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত আ স্টাডি ইন স্কারলেট নামের উপন্যাসে। এ ছাড়া দ্য সাইন অব ফোর, হাউন্ড অব বাস্কারভিল এবং দ্য ভ্যালি অব ফেয়ারসহ মোট চারটি উপন্যাস আর ৫৬টি গল্পে গোয়েন্দা হোমসের দুঃসাহসিক অভিযানে গল্প লিখেছেন তার স্রষ্টা ব্রিটিশ লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। গোয়েন্দা কাহিনির ইতিহাসে এ রকম জনপ্রিয়তা বোধ হয় আর কোনো লেখকের কপালে জোটেনি। আবার তাঁরই আরেক জনপ্রিয় সৃষ্ট পাগলাটে চরিত্র প্রফেসর ড. চ্যালেঞ্জার। দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড নামের একটি উপন্যাসে তাঁকে হাজির করেছিলেন ডয়েল। সুকুমার রায়ের সৃষ্ট হেশোরাম হুঁশিয়ারি এবং সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কুর মধ্যেও রোমাঞ্চ ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ড. চ্যালেঞ্জার চরিত্রের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাই কোনান ডয়েলের নামে যে কোনো প্রাণীর নামকরণ হবে, সে আর বেশি কী! প্রাগৈতিহাসিক যুগে পৃথিবীতে বিচরণ করে বেড়ানো এক বিশাল আকৃতির উড়ন্ত সরীসৃপের নামকরণ করা হয়েছে ডয়েলের নামে। ব্রাজিলে এই প্রাণীটির ফসিল খুঁজে পাওয়া গেছে। প্রাণীটির নাম দেওয়া হয়েছে আর্থারড্যাকটাইলাস কোনানডয়েলি (Arthurdactylus conandoylei)। কারণ দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড–এ প্রায় এ ধরনের একটি প্রাণীকে জীবন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করতে দেখা গিয়েছিল অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকে।
অ্যাডভেঞ্চারের কথাই যখন উঠল, তখন বলি, টম সয়্যার আর হাকলবেরি ফিন কি কারও চেয়ে কম অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ছিল। একের পর এক দুঃসাহসী সব অভিযানে এই দুই চরিত্রকে হাজির করেছিলেন মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন, যাঁরা আজও কিশোরদের কাছে জনপ্রিয়। উত্তর আমেরিকার এক বিটলের বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে তাঁর নামে। বিটলটির নাম Sonoma twaini। তবে এই বিটলটি দুঃসাহসী কি না, তা কিন্তু এখনো জানা যায়নি। তবে কিম আর বাঘিরা কিন্তু নিঃসন্দেহে বেশ দুঃসাহসী ছিল। ভারতে জন্মানো নোবেল বিজয়ী লেখক রুডইয়াড কিপলিংয়ের দ্য জাংগল বুক বইটিতে এদের দেখা মেলে। বইটি নিশ্চয়ই তোমাদের সবার পড়া। নিদেনপক্ষে বইটি অবলম্বনে বানানো কার্টুন বা মুভিটি তো দেখার কথা। বইটির কিমের বন্ধু বাঘিরা নামের ব্ল্যাক প্যান্থার তো সবার মন জয় করে নিয়েছে। সে কারণেই কিনা কে জানে, বাঘিরা আর কিপলিংয়ের নামে একটি মাকড়শার নামকরণ করা হয়েছে। মধ্য আমেরিকার বাসিন্দা এই লাফানো মাকড়শার নাম Bagheera kiplingi।
লেখকদের নামে প্রাণীদের নামকরণের তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘ তালিকায় আরও আছেন জোনাথন সুইফট, টেরি প্যাচেট, হারমান মেলভিল, আর্থার সি ক্লার্ক, ব্রাম স্টোকার, হবিট ও দ্য লর্ড অব দ্য রিংসখ্যাত জে আর আর টোলকেইনসহ আরও অসংখ্য লেখক। তাঁদের কথা আরেক দিন বললে শুনবে নিশ্চয়ই।