জুলভার্নের টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি বইটি পড়লে তুমি হারিয়ে যাবে কল্পনার সমুদ্রজগতে। সেই বই পড়ে সাগরের তলদেশের অভিযাত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন আলেক্সান্ডার সেমেনভও। সাগরের তলদেশে থাকা অন্য এক জগৎ আর সে জগতের জানা–অজানা বহু জীব হাতছানি দিয়েছিল তাঁকে। স্বপ্নটা ঠিকেই পূরণ করেছিলেন সেমেনভ। ২০০৭ সালে রাশিয়ার মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি হোয়াইট সি বায়োলজিক্যাল স্টেশনে সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন। ধীরে ধীরে সত্যি হতে থাকে তাঁর স্বপ্ন।
সেমেনভ শুরু করেন সাগরতলের জীবের ছবি তোলা। সাগরের অজানাকে জানার লক্ষ্যে সেখানে তিনি ডুবুরিদের নিয়ে ‘অ্যাকোয়াটিলিস’ নামের একটি প্রকল্প গঠন করেন। এই প্রকল্প শুধু পানির নিচের আকর্ষণীয় আর অদ্ভুত জীবের ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সামুদ্রিক বিজ্ঞান সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াটাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
সাগরের গভীরে ঠান্ডা পানিতে কোনো অবলম্বন ছাড়া ভেসে থাকা নতুন ডুবুরিদের জন্য বেশ কষ্টের কাজ। তবে সাহসী সেমেনভ প্রচণ্ড ঠান্ডা পানির বিভিন্ন স্তরে ভেসে ভেসে অসাধারণ সব ছবি তুলে আনতে কখনো পিছপা হননি।
সাগরের তলদেশে ডুবে থাকা যেমন কষ্টের, তেমনই সেখানে ছবি তোলাও বেশ কঠিন। আলেক্সান্ডার সেমেনভ বলেন, ‘সাগরের তলদেশে ছবি তোলার ক্ষেত্রে আমরা যা খালি চোখে দেখি, তা সহজে ক্যামেরায় ধারণ করা যায় না। অথই সাগরে আলোর উপস্থিতি কম হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জীবগুলোর রং পরিবর্তন হয়ে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে অতি ক্ষুদ্র জীবের ছবি তুলতে গিয়ে অনেক ভালোমানের আধুনিক ক্যামেরাও সঠিকভাবে কাজ করে না। ফলে এডিটিং ছাড়া একটি ভালো ছবি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই জলের গভীরে ছবি তোলার ক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য থাকে এডিটিং ছাড়া রং ঠিক রেখে ছবি তোলা, যা দেখতে বাস্তব আর প্রাকৃতিক লাগবে।’
অক্সিজেন ট্যাংক নিয়ে অতল সাগরে ডুব দেওয়ার অনন্য অভিজ্ঞতা তাঁর এক যুগের। অভিজ্ঞ এই জীববিজ্ঞানী ল্যাবরেটরির চেয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশেই ছবি তুলতে বেশি পছন্দ করেন। কারণ, নরম দেহবিশিষ্ট প্লাঙ্কটনিক জীবগুলো সম্পর্কে বইয়ে বা ল্যাবরেটরিতে পড়াশোনা করে ততটা জানা যায় না, যতটা সেগুলোকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়।
বর্তমানে সেমেনভ কাজ করছেন একজন পেশাদার ডুবুরি আলোকচিত্রী হিসেবে। যুক্ত আছেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, বিবিসি, নেচার-সহ বেশ কিছু ম্যাগাজিনের সঙ্গে। তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেই দেখা যায় সাগরের অদ্ভুত প্রাণীদের অসংখ্য ছবি। তিনি তাঁর অনুসন্ধানগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও বাস্তব জীবনে বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
আমরা যখন ভিনগ্রহের প্রাণী বা বহু দূরের ভিন্ন একটা জগতের কথা চিন্তা করি, তখন সেমেনভ আমাদের খুব কাছেরই একটা জগতে একটি অক্সিজেন ট্যাংক পিঠে চাপিয়ে ঘুরে বেড়ান। যেখানকার জীবজগৎ আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা আমাদের ফিশবোল বা অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছগুলোর বাইরে পানির নিচের জীবজগৎ নিয়ে তেমন ভাবতেই পারি না। অথচ সেমেনভ এগিয়ে গিয়েছেন তাঁর চেয়েও অনেক গভীরে। বরফঠান্ডা পানি, যেখানে আলোটাও পৌঁছায় না ঠিকমতো, সেখান থেকে তিনি নিয়ে আসেন দুর্লভ সব জীবের ছবি।
শেষ করার আগে এসো দেখে নেই সেমেনভের তোলা বেশ কিছু জেলিফিশের ছবি—
তথ্যসূত্র: টাইম, বোরডপান্ডা
ছবি : আলেক্সান্ডার সেমেনভের ফেসবুক ও ফ্লিকার, বোরডপান্ডা