শহরগুলো যানজটে ভরা। যানজটকে একটু পাশ কাটানোর সেরা উপায় বাইসাইকেল। প্যাডেল চালিয়ে গোটা শহর চক্কর দিতে যেমন কোনো ঝক্কি পোহাতে হয় না, তেমনি পরিবেশও থাকে দূষণমুক্ত।
যান্ত্রিক বাহন চালু হওয়ার আগে মানুষ পেশিশক্তিকেই ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছে বারবার। ১৭৯০ সালের দিকে ফ্রান্সের এক সাধারণ কাঠমিস্ত্রি কমতে মেডে ডে সিভরাক (Comte Mede de Sivrac) প্রথম বাইসাইকেলের প্রাথমিক মডেল উদ্ভাবন করেন। তিনি সেটার নাম দিয়েছিলেন সেলেরিফেয়ার (celerifere)। বাইসাইকেলের মতো দুটো চাকা থাকলেও কাঠের বানানো এই ফ্রেমের এই বাইসাইকেল চালাতে ভালোই বেগ পেতে হতো চালককে।
এই নকশা দেখেই দুই চাকার বাহন বানানোর চিন্তা আসে সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারদের মাথায়। পুরানো নথিপত্র বলে, ১৫৩৪ সালের দিকে জিয়েন জিয়াকোমো কাপ্রোতির এক ছবিতেও বাইসাইকেলের নকশা পাওয়া যায়। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লেওনার্দো দা ভিঞ্চির শিষ্য ছিলেন তিনি।
একটু একটু করে সাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়তেই নড়েচড়ে বসেন নকশাবিদরা। বছর পনেরো যেতে না যেতেই বাইসাইকেলের নকশায় আমূল পরিবর্তন আনেন জার্মানির ব্যারন কার্ল ভন। আগের নকশা একটু বদলে এবার চাকাকে আরও বেশি মজবুত করে তোলেন তিনি। তবে প্যাডেলের পরিবর্তে তখনো বাইসাইকেলকে পায়ে ঠেলে চালাতে হতো।
পরের বিশ বছরে অনেকটা পথ এগিয়ে যায় বাইসাইকেল। প্রথমবারের মতো সাইকেলে প্যাডেল সংযুক্ত করেন স্কটিশ কামার ক্রিকপ্যাট্রিক ম্যাকমিলান। চারপাশের সবাইকে পায়ে ঠেলে সাইকেল চালাতে দেখে দুই চাকার মাঝে আরও একটা চাকা বসানোর চিন্তা করেন তিনি। বাইসাইকেলের পেছনের চাকার সঙ্গে অতিরিক্ত চাকা লাগিয়ে সেটায় জুড়ে দেন রড। ওই রডে চাপ দিয়েই ঘোরানো যেত চাকাটাকে। ফলে গোটা সাইকেলটি সামনে এগিয়ে যেত অনায়াসে। ২৬ কেজি ওজনের এই সাইকেলে করে ম্যাকমিলান যখন ৬৮ মাইল দূরে গ্লসগো শহরে গেলেন, তখনই চমকে গেল সবাই। বছরখানেক পেরোতেই ম্যাকমিলানের সাইকেলগুলো বাজারে নতুনভাবে আসতে শুরু করল। বাইসাইকেল আবিষ্কার করে প্রথমবারের মতো কিছু সম্মাননা পেলেন এই কালজয়ী মানুষটি।
তবে কিছু ইতিহাসবিদের মতে, আধুনিক সাইকেলের পথচলা শুরু হয় পাইরের এবং মিকাইক্সের হাত ধরে। বাবা–ছেলে মিলে নিজেদের ওয়ার্কশপে তৈরি করেন সাইকেলের নতুন নকশা। ১৮৬৭ সালের দিকে তাঁদের বানানো বাইসাইকেলটি ছিল বাচ্চাদের ট্রাই–সাইকেলের মতো। সামনের চাকার সঙ্গে অতিরিক্ত প্যাডেল বসিয়ে দেন তাঁরা। ফলে সাইকেলে বসেই প্যাডেল ব্যবহারের সুবিধা পায় চালক। লোহা আর কাঠের ফ্রেমে বানানো এই সাইকেলটির নাম দেওয়া হয় ভেলোসিপেড, যার অর্থ প্রথম পদক্ষেপ।
এ পর্যায়ে সাইকেলের সামনের চাকাকে বড় করে প্যাডেলে পা রাখার সুবিধা দিতে চেষ্টা করেন নতুন নকশাকারীরা। ১৮৭০ সালের দিকে ধাতব পদার্থ নিয়ে কাজকর্মে বেশ দক্ষ হয়ে ওঠেন তৎকালীন প্রকৌশলীরা। ফলে বাইসাইকেলের পুরোটাই বানানো হয় ধাতব পদার্থ দিয়ে। রাবারের প্যাডেলও অবশ্য বেশ আরামদায়ক হয়ে ওঠে। ইউরোপ আর আমেরিকাতে তৎকালে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ ধরনের বাইসাইকেলগুলো। তবু সামনের চাকা তুলনামূলক বড় হওয়ায় আরোহীরা নিরাপদে বাইসাইকেলে ভ্রমণ করতে পারতেন না।
সাইকেলের নকশা পরিবর্তনের চেয়েও এবার নকশাবিদদের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় নিরাপত্তা। দীর্ঘ পনেরো বছর গবেষণার পর সাইকেলের সর্বাধুনিক নকশা নিয়ে হাজির হন ইন্ডািস্ট্রয়ািলস্ট জন কেম্প স্টার্লি। দুরন্ত সাহসী যুবকের বাহন থেকে এবার ছোট–বড়নির্বিশেষে সবাই ব্যবহার করতে শুরু করে বাইসাইকেল। সমান আকৃতির চাকা, প্যাডেল, চেইন পদ্ধতি আর খুঁটিনাটি আরও অনেক সুবিধা মিলিয়ে চমৎকার এক বাইসাইকেল উপহার দেন তিনি। এ ছাড়া প্রথমবারের মতো তিনি পেছনের চাকাতে ধাক্কা দিয়ে গোটা সাইকেলকে সামনে আগানোর পরিকল্পনা করেন। রাবারের চাকা ব্যবহারের ফলে আরামদায়ক হয়ে ওঠে বাইসাইকেল। ফলে অচিরেই সাধারণ মানুষের জন্য আরও বেশি নিরাপদ হয়ে ওঠে দুই চাকার এই চমৎকার বাহনটি।
‘ডায়মন্ড ফ্রেম’ নামে পরিচিত বাইসাইকেলের এই নকশা এখনো সারা বিশ্বে সমাদৃত। দিন দিন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এই বাইসাইকেল। বিপুল পরিমাণে তৈরির ফলে সাধারণ মানুষের নাগালে চলে আসে বাইসাইকেলের দাম। উনিশ শতকের শুরুর বছরগুলো ছিল সাইকেলের স্বর্ণযুগ।
বাইসাইকেলের এই প্রবহমান পথচলায় মানুষের মাঝে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বাইসাইকেল রেসিং। ১৮৬৮ সালে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় বাইসাইকেল রেসিং। ১.২ কিলোমিটারের এই রেসিং প্রতিযোিগতায় পুরস্কার জিতে নেন জেমস মুর। কাঠের ফ্রেমের সাইকেলেই বাজিমাত করেন ইংলিশ এই সাইক্লিস্ট। ১৮৯৬ সালের গ্রিস অলিম্পিক গেমসে যোগ করা হয় বাইসাইকেল রেসিং।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি উত্তর আমেরিকার সেনাবাহিনীও এই বাইসাইকেল ব্যবহার শুরু করে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে দুর্গম পথে সৈনিকদের যাতায়তের জন্য বাইসাইকেল দেওয়া হতো।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বাইসাইকেল নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করতে শুরু করেন প্রকৌশলীরা। পাহাড়ে কিংবা জঙ্গলে অথবা সমুদ্রতটের বালুচরে চালানোর সুবিধার কথা চিন্তা করে আলাদা আলাদা রকমের বাইসাইকেল বানাতে শুরু করেন তাঁরা। মূল নকশা একই রেখে টাইটেনিয়াম আর কার্বন ফাইবার ব্যবহার করে বানানো হয় আরও মজবুত ও হালকা বাইসাইকেল। চেইনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে–কমিয়ে আলাদা আলাদা গতিতে সাইকেল চালানোর সুযোগ করে দিতে উদ্ভাবন করা হয় গিয়ার প্রযুক্তি। শিফটার ব্যবহার করে আরোহী সহজেই আরও আরামদায়কভাবে ব্যবহার করতে পারে বাইসাইকেলকে।
গত দুই শতকে কয়েক শত প্রকৌশলীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এখনকার বাইসাইকেল। অটোমোবাইল প্রযুক্তি আমাদের যতই গতি দিক না কেন, প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখা আর নতুন করে চিনতে বাইসাইকেলের জুড়ি নেই। বিশ্বের যেকোনো ব্যস্ত শহর থেকে শুরু করে গহিন জঙ্গলে—সব জায়গাতেই চলে যেতে পারো তোমার প্রিয় বাইসাইকেলে চেপে।