বাবার সরকারি চাকরির জন্য আমার শৈশবের শুরু হয়েছে বান্দরবানে। আমার বয়স যখন ছয়-সাত বছর, হঠাৎ একদিন পাশের বাসার একটা বাচ্চাকে দেখলাম সাইকেল চালাতে। প্রতিদিনই আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। সেটা থেকেই মূলত সাইকেল চালানোর শখ হয়। দিদির ছোটবেলার সাইকেলে অতিরিক্ত দুই চাকা জুড়ে দিয়েই আমার সাইকেল চালানোর শখ পূরণ করলেন বাবা। সেটাই শুরু। একটু একটু করে শিখছিলাম। একাই চালাতে পারতাম। কিছুদিন পরই দিদির ওই সাইকেলটা ভেঙে গেল। এরপর সাহস করে প্রতিবেশীর সাইকেল ধার করে চালাতাম। সেই সাইকেলটা আমার তুলনায় বেশ বড় ছিল। চালাতে গিয়ে পড়ে যেতাম প্রতিদিন। বাজেভাবে কেটে যেত হাত-পা। বাসায় ফিরলে এসব দেখে মা একটু রাগ করতেন। তবে মা যে মনে মনে খুশি হতেন, সেটাও বুঝতাম।
২০০৯ সালের দিকে আমাদের পুরো পরিবার ঢাকা চলে আসে। এত মানুষের এই ভিড়ের শহরে প্রথম দিকে বেশ জড়সড় থাকতাম আমি। নতুন শহরের ব্যস্ত রাস্তা চিনতেই হিমশিম খেতে হতো আমাদের।
আমার অনেক বন্ধুই সাইকেলে যাতায়াত করত। মায়ের কাছে সাইকেলের জন্য একটু–আকটু বায়না করলেও বাবাকে বলার সাহস হতো না। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের থেকে নিয়ে চালাতাম। সেটা জেনেও বকাবকি করতেন না মা।
২০১৪ সালে আমি জেএসসি পরীক্ষা দিই। ইতিমধ্যে মায়ের কাছে বাবা জানতে পেরেছিলেন যে আমার সাইকেলের খুব শখ। বাবা বললেন, জেএসসিতে এ-প্লাস পেলে সাইকেল কিনে দেবেন। পড়াশোনায় একটু ফাঁকিবাজ হলেও জেএসসিতে কীভাবে যেন এ-প্লাস পেয়ে গেলাম। তবু বাবা সাইকেল কিনে দিতে চাইছিলেন না। তাঁর ভয় ছিল যে ব্যস্ত শহুরে রাস্তায় আমি হয়তো সাইকেল সামলে উঠতে পারব না। মা এবার একাই আমার পাশে দাঁড়ালেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে সাইকেল কিনতে গেলেন। প্রায় পাঁচ বছর পর আমি আবার আমার নিজের সাইকেল পেলাম।
নতুন সাইকেল দেখে বাবা নিয়ম বেঁধে দিলেন। গলির বাইরে যেন না চালাই। বাসার সামনের খোলা মাঠ, স্কুলের রাস্তা—এগুলোতেই আমার সাইক্লিং সীমাবদ্ধ। তবুও বিপুল উৎসাহে রোজ সকালে বেরিয়ে পড়তাম। সে বছর পরীক্ষার শেষের ছুটিতে সকালে সাইকেল চালাতে বেরোতাম প্রতিদিন। আমার বন্ধু সাদ প্রতি সকালেই ওর সাইকেল নিয়ে চলে আসত। আমরা একসঙ্গে এলাকার রাস্তাতেই সাইকেল চালাতাম। দেখা যেত এলাকার ভেতরেই আমাদের দিনে ২০-৩০ কিলোমিটার সাইকেল চালানো হতো।
ভালোই চলছিল। তবে আমি যেন মরিয়া হয়ে উঠলাম সাইকেলে ঘুরে গোটা শহর দেখার জন্য। প্রায়ই একটু দূরে দূরে রাইড দিতাম আমরা। বাসায় ফিরে মায়ের সঙ্গে এসব গল্প করলেও বাবাকে ঘুণাক্ষরেও জানাতাম না। মা আমার ওপর রাগ করলেও ভেতরে–ভেতরে খুশিই হতেন।
সাদ একদিন জানাল বিডি সাইক্লিস্টের কথা। একসঙ্গে শহর থেকে দূরে দূরে সাইকেল চালাতে যায় ওরা। সাদ আমাকে ওদের সঙ্গে সাইকেল চালাতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করব। মাকে ভয়ে ভয়ে জানাই। সব শুনে মা একটু একটু সাহস দিলেও ঠিক যেন হয়ে উঠছিল না সবকিছু। এরপর এত কিছু না ভেবেই ২০১৬ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো বিডি সাইক্লিস্ট গ্রুপের সঙ্গে রাইডে যাই আমি। রাইডটা ছিল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ি পর্যন্ত। পুরো রাইডে সাদ ছাড়া আমি আর কাউকেই চিনতাম না। তবে অন্যরা বেশ সাহায্য করছিল আমাকে।
উত্তরা পর্যন্ত গিয়ে বেশ ভয় পেয়ে যাই আমি। বাসা থেকে এত দূরে কখনো সাইকেল চালিয়ে আসতে পারব, এটাই তো কল্পনা করতে পারছিলাম না। ভয়ের কারণে বাবাকে ফোন করার সাহসও হয়নি। শুধু এসএমএস করেছিলাম যে, ‘আমি উত্তরা এসেছি। বন্ধুদের সঙ্গে আছি। ঠিক আছি।’ সেদিনের রাইডে আমার নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে।
বাসায় ফেরার পর বাবা আমার থেকে সাইকেলের চাবি নিয়ে নিলেন। আর কিছুই বললেন না। পুরো বাড়ি থমথমে হয়ে গেল। আমিও ভয়ে বাবাকে কিছু বলতে পারছিলাম না। মাকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাইডের ছবি দেখাচ্ছিলাম। গল্প করছিলাম রাইডের বন্ধুরা কত সাহায্য করে, সেটা নিয়ে। মা ছবিগুলো দেখে খুবই খুশি হচ্ছিলেন।
পরের সপ্তাহেই আবার সাইকেল রাইড ছিল। মা এবার শান্তভাবে বোঝালেন বাবাকে। অনুমতি দিলেন বাবা। তবে একটু পরপর ফোনে বাসায় জানাতে হবে, আমি কোথায় আছি। এরপর থেকে বাবা আর আমাকে আটকাননি। আমি সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি শহর থেকে অনেক দূরে। পানাম নগর, নরসিংদী, ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে শুরু করে বেশ কিছু জায়গায় গিয়েছি আমি। তবে বাসার শর্ত ছিল, যত দূরেই যাই না কেন, সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে।
ছোট থেকেই আমি মোটা ছিলাম বলে আমার অনেক বন্ধুই ভেবেছিল, আমি ওজন কমাতে সাইকেল চালাই। কিন্তু সাইকেল চালানো আমার শখ। যেদিন সকালে আমার রাইডে যাওয়ার কথা থাকত, সেদিন কিন্তু আমার ঘুম ভাঙতে অ্যালার্মের প্রয়োজন হতো না। সাইকেলে চেপে গোটা শহর দেখার ইচ্ছাই আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে বারবার। কত কিলোমিটার চালালাম, কত দূর গেলাম, কত ক্যালরি ক্ষয় হলো—এসব হিসাবের চেয়ে সাইকেল চালানোটাই আমি বেশি উপভোগ করেছি। রাইডে গিয়ে অনেক বন্ধু পেয়েছি। রাইডে থাকা অবস্থায় প্রত্যেক সাইক্লিস্ট একে অন্যকে অনেক সাহায্য করে। একটা নতুন পৃথিবী পেয়েছি আমি।
এরই মধ্যে ২০১৬–এর দিকে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের পরিকল্পনা করে বিডি সাইক্লিস্ট। সেই দলে আমারও থাকার সুযোগ হয়। একই লাইনে সর্বোচ্চসংখ্যক সাইক্লিস্ট পরস্পরের মাঝে একই দূরত্ব বজায় রেখে সাইকেল চালানোর বিশ্বরেকর্ড করি আমরা। নির্বাচিত ১ হাজার ১৮৬ জনকে নিয়ে টানা তিন দিন অনুশীলন করতে হয় আমাদের। উত্তরায় দুপুরের রোদে টানা তিন-চার ঘণ্টা আমরা এর অনুশীলন করি। অবশেষে রেকর্ড গড়তে সক্ষম হই আমরা।
এই ঘটনার পর বাবা আমাকে সামনাসামনি কিছুই বলেননি। মা আর দিদি খুব খুশি হয়েছিলেন। তবে মজার ঘটনা ঘটল রাজশাহীতে বাবার অফিসে যাওয়ার পর। বাবার সহকর্মীদের সঙ্গে পরিচয়ের একপর্যায়ে তাঁদের অনেকেই বাবাকে বলছিলেন, ‘এটা আপনার ছোট মেয়ে না? ওই যে গিনেস রেকর্ডসে অংশ নিয়েছিল যে?’ আমার বুঝতে বাকি থাকল না, বাবা আমাকে নিয়ে তাঁর অফিসে গল্প করেন। বাবা আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন—এটা ভেবেই অনেক আনন্দ হচ্ছিল। বাবা আমাকে সেদিনের বিভিন্ন ছবি, মেডেল আর সার্টিফিকেট দেখাতে বললেন সবাইকে। সাইকেল চালিয়ে আমি জীবনে কী পেয়েছি বা আর কী পাব—জানি না, কিন্তু সেদিন আমার কাছে মনে হয়েছিল আমার সব পাওয়ার ঊর্ধ্বে আমি কিছু পেয়ে গেছি।
সাইকেল চালানো যে সব সময় খুব সোজা ছিল, তেমনটি কিন্তু নয়। বরং মাঝেমধ্যে খুব বাজেভাবে অ্যাকসিডেন্ট করতাম। হাইওয়েগুলোতে গাড়ি, ট্রাক-বাসগুলো সাইক্লিস্টদের জায়গা দিতে চায় না। অনেক সময় মেয়ে সাইক্লিস্ট দেখে অবহেলা করে, বিদ্রূপ করে। আগে এগুলো আমাকে কষ্ট দিত। বাসায় ফিরে ভাবতাম, হয়তো আমিই যা করছি, সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার মা-দিদি সব সময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। আমার ওজন বেশি হওয়ার পর শারীরিক ক্ষমতায় আমি কখনো নিজেকে কম মনে করিনি। আমার মানসিক শক্তিই আমাকে সাহায্য করেছে এসব রাইডে ভালো করার, যা দেখে অনেক অভিজ্ঞ সাইক্লিস্টও আমার প্রশংসা করেছে। আমাদের দেশের প্রচলিত ধারণায় আছে যে মেয়েরা এটা পারবে না, ওটা পারবে না। তখন আমার কাছে সাইক্লিং ছিল এসব ধারণাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার হাতিয়ার। আগে রাস্তায় সাইকেল চালানোর সময় অনেককেই দেখতাম মেয়ে সাইক্লিস্ট দেখে ব্যঙ্গ করতে। কিন্তু এখন সময় একটু একটু করে বদলাচ্ছে। সারা দেশেই এখন অসংখ্য মেয়ে সাইক্লিস্ট আছে। আর সাইকেল স্ট্যান্টেও অংশ নিচ্ছে মেয়ে সাইক্লিস্টরা। তাই আমিও বুকে স্বপ্ন ধারণ করি সারা বিশ্ব সাইকেলে চেপে ঘুরে দেখার।