মাথার ওপরে গ্রীষ্মের চড়চড়ে রোদ। সামনে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটারের পথ। সঙ্গে পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত বাবা। সম্বল বলতে দেড় হাজার টাকায় কেনা গোলাপি রঙের একটা সাইকেল। ঘরে ফেরার এমন সংগ্রামের বিজয়গাথা তৈরি করেছে ভারতের জয়তি কুমারী।
বয়স মাত্র ১৫ বছর। পরিবারের অভাব–অনটনে ক্লাস এইটের পর স্কুল ছেড়ে রান্নাঘরে মন দিতে হয় জয়িতাকে। মা আর পাঁচ ভাইবোনের সংসারে বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবা মোহন পেশওয়ান পেশায় একজন রিকশাচালক। রাজধানী নয়াদিল্লির কাছাকাছি আরেক শহর গুরুগাঁওতে রিকশা চালান তিনি। বিহারের দরভাঙ্গা গ্রামে মেয়ে আর স্ত্রীর সংসার চালান সেই রিকশা চালানোর আয় দিয়েই। সামান্য উপার্জনে টেনেটুনে চলছিল তাঁদের জীবন। কিন্তু এরই মধ্যে গত জানুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাত পান মোহন। বাবার সেবা করতে গ্রাম থেকে শহরে আসে জয়তি। একটু একটু করে মেয়ের সেবায় মোহন সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করলেও বিপদ যেন পিছু ছাড়ে না।
কোভিড-১৯–এর আক্রমণে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা ভারত। মার্চের শেষে ঘোষণা করা হয় লকডাউন। বন্ধ করে দেওয়া হয় বাস-ট্রেনের মতো গণপরিবহনগুলো। যে কারণে শহরে আটকে পড়েন গ্রাম থেকে কাজ করতে আসা অনেক শ্রমিক। কেউ কেউ হেঁটেই রওনা দেন কাছাকাছি গ্রামগুলোতে। পথে মারা যান অনেকেই। বয়স্কদের কাঁধে নিয়ে কিংবা শিশুদের ট্রলিতে ঠেলেই বেরিয়ে পড়ে এসব মানুষ। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতে ধার করা মোবাইলেই মাকে জানিয়ে দেয় জয়িতা, ‘বাবাকে নিয়ে নিরাপদেই ফিরব আমি।’
জয়িতার বাড়ি ফেরার জয়যাত্রা শুরু হয় এখান থেকেই। বাবা-মেয়ের শেষ সম্বলের দেড় হাজার টাকা দিয়ে সে কিনে ফেলে একটা পুরোনো সাইকেল। গোলাপি রঙের সাইকেলে একটা ব্যাগ নিয়ে চেপে বসেন মোহন পেশওয়ান। মেয়ের পেডেলের জোরে পথ চলতে শুরু করেন। চোখধাঁধানো রোদেই এগোতে শুরু করেন তাঁরা। শুরুতে মোহন নিজেও সন্দিহান ছিলেন যে তাঁরা পৌঁছাতে পারবেন কি না। কিন্তু একটু একটু করে বাবার বিশ্বাস অর্জন করে আত্মপ্রত্যয়ী জয়িতা। পথে মাঝেমধ্যে থেমে শুকনো খাবার আর পানি খেয়েছেন তাঁরা। রাতে ঘুমিয়েছে তেলের পাম্পের ছোট বেঞ্চে। ছোট্ট মেয়ের পেছনে এভাবে বয়স্ক লোককে বসে থাকতে দেখে বিদ্রূপ করেছে অনেকে। কিন্তু তারা তো আর জানে না বাবা-মেয়ের ভেতরের গল্প। পথে অনেকে খাবার দিয়ে সাহায্য করেছে। সামান্য পথ এগিয়েও দিয়েছেন এক ট্রাকচালক।
এভাবে টানা ১০ দিন সাইকেলে চেপে বাবাকে নিয়ে নিরাপদে বাড়ির চৌকাঠে পা রাখে জয়িতা। ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার সাইক্লিং করার ধকলে কাতর হলেও মায়ের কথা রাখতে পেরে মুখের হাসি অটুট ছিল তার। ভারত সরকারের নিয়ম অনুসারে শহর থেকে কেউ গ্রামে এলেই তাকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হচ্ছিল। তাই গ্রামপ্রধানের কথামতো কোয়ারেন্টিনে চলে যান বাবা-মেয়ে দুজনেই।
কিন্তু ততক্ষণে সাইকেলে চেপে জয়িতার এই অসাধ্য কাজের বিবরণ পৌঁছে গেছে ভারতীয় সাইক্লিং ফেডারেশনের কাছে। ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে জয়িতার কথা। যেখানে তাকে বারবার বলা হচ্ছিল, ‘লায়ন হার্টেড’ অর্থাৎ, অসীম সাহসী। ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ওঙ্কার সিং জয়িতাকে নয়াদিল্লিতে জাতীয় সাইক্লিস্ট দলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। বিশেষ ট্রেনে রাজধানীতে এনে কিছু পরীক্ষা উতরালেই জয়িতার সুযোগ মিলবে জাতীয় দলে।
সবার এত সম্ভাষণ আর ভালোবাসার মধ্যেও জয়িতা শুধু নিচু কণ্ঠে একবার বলে, ‘আমার মনে হয় আমি মেয়ে বলে সবাই এত অবাক হচ্ছে। কিন্তু আমি শুধু আমার বাবাকে নিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরতে চেয়েছি। আমার মাকে দেওয়া কথা রাখতে চেয়েছি।’
তথ্যসূত্র: নিউয়র্ক টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া