সাইকেল-সন্ন্যাসী

এ যুগের সাইকেল-সন্ন্যাসীদের একজন

একখানা সাইকেল থাকলে যখন খুশি, যেখানে খুশি চলে যাওয়া যায়। সে দেশের ভেতরেই হোক, আর বাইরে। একজন ভালো সাইক্লিস্ট ভালো পর্যটকও বটে। হাল আমলে অনেকে সাইকেল নিয়ে দলবেঁধে বনেবাদাড়ে ঘুরতে যায়। এঁদের অনেকে এ যুগের সাইকেল-সন্ন্যাসী বলেন। এই সাইকেল-সন্ন্যাসীদের অনেকে কাঁধে একখানা ডিএসএলআর ক্যামেরাও রাখেন। নিত্যনতুন জায়গায় ঘোরাঘুরি আর ছবি তুলে বেড়ানোই এঁদের নেশা।

এমনি নেশায় পড়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন খন্দকার আহম্মেদ আলী সায়েদ। সে ২০০৫ সালের কথা। দেশটাকে দেখার নেশা পেয়ে বসেছিল তাঁকে। পকেটে হাজার দশেক টাকা আর সঙ্গে একখানা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গী হলেন আরও তিনজন। উদ্দেশ্য ৬৪ জেলা ঘোরা। সেবার ৩৪ জেলা ঘোরার পর তিন সঙ্গী ফিরে আসেন। কিন্তু সায়েদ দমবার পাত্র নন। তিনি একা সব কটা জেলা ঘুরে আসেন। তখন সাড়ে চার মাস লেগেছিল তাঁর। আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধব যেখানে যাকে পেয়েছেন, তার বাড়িতে থাকা-খাওয়াটুকু সেরে নিয়েছেন।

দ্বিতীয়বার ২০১১ সালের অক্টোবরের কথা। এবার সঙ্গী হলেন এক দম্পতি। দীপু চৌধুরী ও এনজেলা চৌধুরী। এবারও সাড়ে চার মাসের মতো সময় লাগল সব কটা জেলা ঘুরতে। ওই দম্পতিও সফলভাবে তাঁদের অভিযান শেষ করলেন। প্রথমবার দেশ ঘুরতে বেরোনোর সময় সায়েদের মটো ছিল ‘সাইক্লিং পরিবেশ রক্ষা করে।’ দ্বিতীয়বার তাঁরা স্কুল-কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়েছেন।

সাইকেল-সন্ন্যাসীদের অনেকে সাইকেল নিয়ে দলবেঁধে বনেবাদাড়ে ঘুরতে যায়

বাধা-বিপত্তি ও বিড়ম্বনার কথা জিজ্ঞেস করতেই হাসলেন সায়েদ। বললেন, প্যাশনটা শক্ত হলে বিড়ম্বনা ব্যাপার না। ট্যুর করব, দেশকে জানব—এ উদ্দেশ্য থাকলে ছোটখাটো সমস্যা কোনো ব্যাপারই না।

যারা সাইকেল নিয়ে বেরোতে চাও, তাদের উদ্দেশে দুবার দেশ ঘুরে আসা এই সাইক্লিস্টের পরামর্শ, ট্যুরের জন্য টাকা আছে কি না, সেটা আগে নিশ্চিত হতে হবে। থাকলে ভালো, না থাকলে জমাতে হবে। কারও সহায়তা নিতে হলে, আগে ভাবতে হবে কেউ আমাকে এমনি এমনি সাহায্য করবে না। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অর্থ সহায়তা দিতে চায়, তার বা তাদের উদ্দেশ্য আগে পরিষ্কার হয়ে নিতে হবে তোমাকে। এ ছাড়া রাস্তাটা আগে ঠিক করে নেওয়া ভালো। তুমি কোন পথে যাবে, কত দিন লাগবে, কত টাকা খরচ হবে তার সম্ভাব্য প্রস্তুতি আগেভাগেই থাকা চাই।

দ্বিচক্রযানে চড়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর মতো এমন লোক ঢের আছে আমাদের দেশে। তবে বিশ্বপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের কথা না বললেই নয়। ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা যায়, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের এই মানুষটি সাইকেলে চড়ে দু-দুবার পৃথিবী ঘুরে এসেছেন। তাও আবার প্রায় এক শ বছর আগের কথা। প্রথমবার বের হন ১৯৩১ সালের দিকে। প্রথমে সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, জিত্রা শিয়াংলুং হয়ে প্রবেশ করেন থাইল্যান্ডে। থাইল্যান্ড থেকে ইন্দো-চীন, চীন, হংকং, কেন্টন, নানকিন, সাংহাই হয়ে পিকিং। পিকিং থেকে মাঞ্চুকো, মুকদেন, আন্তং হয়ে কোরিয়া। কোরিয়া থেকে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা হয়ে পাড়ি জমান ফিলিপাইন, বালি, জাভা, সুমাত্রাসহ ইন্দোনেশিয়ার নানা দ্বীপপুঞ্জে। সেখান থেকে ফিরে আসেন সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন। খানিক বিরতি দিয়ে ১৯৩৩ সালে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আবারও বিশ্বভ্রমণে বের হন তিনি।

১০০ বছর আগে সাইকেলে বিশ্ব ঘুরেছিলেন রামনাথ বিশ্বাস

রামনাথ বিশ্বাস তাঁর দীর্ঘ সাইকেল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভ্রমণকাহিনি, গল্প, উপন্যাস মিলিয়ে ৪০টি বই লিখে গেছেন। যেখানে রয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ১২ কিলোমিটার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। ১৮৯৪ সালে জন্ম নেওয়া বাংলার প্রথম এই ভূপর্যটক (সাইকেলে চড়ে) ১৯৫৫ সালে কলকাতায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

(কিশোর আলোর জানুয়ারি ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)