কিশোর আলোর জুন ২০২১ সংখ্যায় ‘বুদ্ধির ঝিলিক’ বিভাগে প্রকাশিত ছয়টি মজার প্রশ্নের একটি ছিল, ‘সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত কোথায় হয়?’ উত্তর হিসেবে ছিল চারটি বিকল্প। ক. ভারতীয় সিরিয়ালে, খ. গুলিস্তানে, গ. রাজশাহীতে এবং ঘ. ওপরের কোনোটিই নয়। মজার এই প্রশ্নের সঠিক জবাব কী হবে, তা নিয়ে ফেসবুক থেকে শুরু করে নানা গণমাধ্যমে বিভিন্ন কথা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনও ছেপেছে। তাতে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সমীক্ষায় এই প্রশ্নের সবচেয়ে বেশি উত্তর এসেছে—ক. ভারতীয় সিরিয়ালে।
প্রশ্নটি যথেষ্ট মজার, বলা বাহুল্য, ওপরের উত্তরটিও। কিন্তু এই প্রশ্ন যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপকও। আসলেই তো, কোথায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়? এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আরেকটি প্রশ্ন আসে। বজ্রপাত আসলে কী?
২
বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। সূর্যের তাপে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা বাতাস উষ্ণ হয়ে ওঠে। আমরা জানি, তাপ দিলে যেকোনো বস্তুর মধ্যকার অণুগুলো খানিকটা দূরে সরে যায়। সে জন্য তাপ দিলে বস্তু প্রসারিত হয়। বাতাসের ক্ষেত্রে, অণুগুলো দূরে সরে গেলে বাতাস হালকা হয়ে যায়। কারণ, একক ঘনত্বে বাতাসের অণুর পরিমাণ যায় কমে। এখানে একক হিসেবে যদি মিটার ধরে নিই, তাহলে ১ ঘনমিটার আয়তনে বাতাসের অণুর পরিমাণ কমে যায়। তুমি চাইলে অন্য যেকোনো একক ধরেও ভাবতে পারো, সমস্যা নেই। যা–ই হোক, হালকা এই উষ্ণ বাতাস ওপরের দিকে উঠে যেতে থাকে। আর ওপরের দিকের শীতল বায়ু নেমে আসতে থাকে নিচের দিকে। ফলে বিপরীতমুখী বায়ুর সংঘর্ষ হয় এবং এগুলোর মধ্যে ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটে।
ওপরের শীতল বায়ুর মধ্যে থাকে পানির ছোট ছোট ফোঁটা এবং বরফের ছোট্ট কণা। এসব ফোঁটা ও কণা ইলেকট্রন ছেড়ে দিয়ে ধনাত্মকভাবে চার্জিত হয়। আর ইলেকট্রন চলে যায় কোমল তুষারিত শিলায়, যাকে বলে গ্রাউপেলের মধ্যে। এভাবে তৈরি হয় বজ্রমেঘ। এই মেঘের চূড়ায় জমা হয় ধনাত্মক চার্জ, কেন্দ্র আর নিচের অংশে থাকে ঋণাত্মক চার্জের শিলাগুলো। ফলে তৈরি হয় প্রচুর পরিমাণে স্থির বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে চায়।
এ সময় কয়েকটি ঘটনা ঘটে। ভূপৃষ্ঠে থাকা ঋণাত্মক চার্জ আর মেঘের নিচের অংশে জমে থাকা ঋণাত্মক চার্জ একে অন্যকে প্রচণ্ডভাবে বিকর্ষণ করে। আবার পাশাপাশি থাকা অন্যান্য মেঘ এবং একই মেঘের বিভিন্ন অংশে জমা চার্জের পরিমাণে ভিন্নতা থাকে। সব মিলিয়ে শুরু হয় বিদ্যুতের প্রচণ্ড প্রবাহ। ঘণ্টায় প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার মাইল গতিতে প্রবাহিত হয় ইলেকট্রনের স্রোত। প্রচণ্ড এই বিদ্যুতের প্রবাহই বজ্রপাত। আমরা এটাকে আঁকাবাঁকা আলোকরশ্মি হিসেবে দেখি।
বিদ্যুৎশক্তির এই প্রবল প্রবাহের ফলে সৃষ্টি হয় প্রচুর তাপের। সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। বজ্রপাতে উৎপন্ন তাপ অনেক সময় এর চেয়েও বেশি হয়। ফলে বাতাস অতি দ্রুত সংকুচিত ও প্রসারিত হতে থাকে, সে জন্য তৈরি হয় সনিক শক ওয়েভ। এটিই বজ্রপাতের শব্দ।
এখানে পুরো ব্যাপারটি অনেকটা সরল করে বলা হয়েছে। কারণ, আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় এটি নয়। মূল আলোচ্য বিষয় হলো কোথায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়?
৩
বজ্রপাতের বিস্তার এবং কোথায় কতটুকু বজ্রপাত হয়, এ ব্যাপারে সে রকম কোনো তথ্য খুব বেশি দিন আগেও আমাদের হাতে ছিল না। বিজ্ঞানীরা তখন বজ্রপাতের শব্দ কোথায় কতটা হচ্ছে, এর ওপর নির্ভর করে বোঝার চেষ্টা করতেন, কোথায় বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। এখন কৃত্রিম উপগ্রহের কল্যাণে আমাদের হাতে সে তথ্য আছে। দেখা যাচ্ছে, বজ্রপাত বছরের একেক সময় একেক জায়গায় বেশি হয়। এটা নির্ভর করে স্থান, সময় ও জলবায়ুর ওপর। প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীতে প্রায় ৪৪টি বজ্রপাত হয়। অর্থাৎ বছরে বজ্রপাত হয় প্রায় ১.৪ বিলিয়ন বার! এর ৭০ শতাংশই হয় ক্রান্তি অঞ্চল বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে।
এখানে আমাদের একটুখানি ভূগোল বুঝতে হবে। পৃথিবীর দুই মেরু থেকে সমান দূরত্বে, অর্থাৎ মাঝবরাবর একটা কাল্পনিক রেখার কথা ভাবা হয়। এর নাম নিরক্ষরেখা। এই রেখার উত্তর পাশকে বলা হয় উত্তর গোলার্ধ, দক্ষিণ পাশকে বলে দক্ষিণ গোলার্ধ। সহজ করে বললে, এই নিরক্ষরেখার ঠিক দুই পাশের অঞ্চলকে বলা হয় ক্রান্তীয় অঞ্চল। উত্তর গোলার্ধের ক্রান্তীয় অঞ্চলের নাম কর্কটক্রান্তি অঞ্চল আর দক্ষিণ গোলার্ধের ক্রান্তি অঞ্চলের নাম মকরক্রান্তি অঞ্চল। এই ক্রান্তীয় অঞ্চলেই প্রায় ৭০ শতাংশ বজ্রপাত হয়। আর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে এবং সমুদ্রাঞ্চলগুলোতে সবচেয়ে কম বজ্রপাত হয়।
২০০৪-০৫ সালের তথ্যানুযায়ী, সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় ভেনেজুয়েলার মারাকাইবো হ্রদের ওখানে। প্রতি বর্গকিলোমিটার হিসাবে এখানেই সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়, প্রতি মিনিটে কয়েকবার। আর বছরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩২টির মতো। সংখ্যায় কিছুটা কম হলেও একবার হওয়ার পর সবচেয়ে দ্রুত পরপর অনেকবার বজ্রপাত হয় আফ্রিকার কঙ্গোতে, কিফুকা গ্রামের আশপাশের পাহাড়ি এলাকায়। এই অঞ্চলে বছরে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১৫৮টি করে বজ্রপাত হয়।
এই কঙ্গোরই কাহুজি-বিয়েগা জাতীয় উদ্যান সর্বোচ্চ বজ্রপাতের দিক থেকে আছে দ্বিতীয়তে। কঙ্গোর আরও কিছু অঞ্চল আছে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হওয়া ১০ স্থানের তালিকায়। তৃতীয় স্থানে আছে ব্রাজিলের তেরেসিনা। ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়া ও মালয়েশিয়ায়ও প্রচুর বজ্রপাত হয়।
২০১৭ সালে নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বে মার্চ থেকে মে মাসের সময়টায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে। সংখ্যা অবশ্য কম, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫টির মতো। ফিনল্যান্ডের গবেষণা সংস্থা ভাইসালার তথ্যমতে, ২০১৫-১৮ সালের মধ্যে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ করে বজ্রপাত হয়েছে। ২০১৯ সালে সংখ্যাটা কমে হয়েছে ১০ লাখ। ২০২০-এ সেটা আবার ২৫ লাখে চলে এসেছে। আর দেশে বেশির ভাগ বজ্রপাত হয় হাওর এলাকায়।
বজ্রপাত দূর থেকে খুব ভয়ংকর মনে না হলেও যে অঞ্চলে হয়, সে অঞ্চলের জন্য বিষয়টা খুব সুখকর নয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রতিবছর বজ্রপাতে প্রায় ১৫০ মানুষ মারা যায়। ‘১৫০’ সংখ্যাটি সংখ্যা হিসেবে ছোট, কিন্তু যাদের পরিবারের মানুষ মারা যায়, তাদের কষ্টের পরিমাণটুকু অকল্পনীয়। কোনো সংখ্যায় একে বাঁধা সম্ভব নয়। তার ওপর এই মানুষগুলোর মধ্যে ৭০ শতাংশই কৃষক। অর্থাৎ এ রকম একটি মানুষের মৃত্যু মানে একটি পরিবারের এলোমেলো হয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ সরকার সে জন্য হাওর এলাকায় বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সাধারণত বজ্রপাত হয় উঁচু কিছুর ওপর। অর্থাৎ ওপর থেকে নেমে আসার সময় সবচেয়ে কাছে, সবচেয়ে বেশি ইলেকট্রন পরিবাহী যা থাকে, তার ওপরেই নেমে আসে বজ্র। আশপাশে উঁচু গাছ থাকলে গাছের ওপর বজ্রপাত হয়। উঁচু লোহার দণ্ড বসিয়ে দিলে বজ্রপাত আর ঘরবাড়ি, গাছ বা মানুষের গায়ে পড়ে না, তার আগেই ওই দণ্ডের ওপর পড়ে ও পরিবাহিত হয়ে চলে যায় ভূপৃষ্ঠে। এ জন্য গ্রামে হোক বা শহরে, বাড়িঘর বা খেতখামারের পাশে বজ্র প্রতিরোধক দণ্ড থাকা আবশ্যক।