সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার ও মাসুদ রানা সিরিজের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন, সবার প্রিয় ‘কাজীদা’ ১৯ জানুয়ারি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। কিশোর আলোর পাতায় তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন লেখক ডিউক জন।
আমি তখন কাজ করি এক বায়িং হাউসে। মাঝেসাঝে ঢুঁ মারি সেবা প্রকাশনীতে। শুনে এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা ভাই, কাজীদার সঙ্গে দেখা হয় আপনার? উনি কি এখনো অফিসে বসেন পিস্তল নিয়ে?’
হ্যাঁ, প্রচারবিমুখতার কারণে অনেকের কাছে সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনের ইমেজটা এ রকমই—তিনিই মাসুদ রানা যেন। আমার সেই কলিগ কবে কার কাছে শুনেছেন যেন পিস্তলের কথাটা। ব্যস, বিশ্বাস করেছেন অবলীলায়।
শুধু তিনিই নন, কল্পনা আর বাস্তব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার উদাহরণ আরও রয়েছে। ভাবা যায়, রানার মতো স্পাই হওয়ার জন্য বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে যোগ দিতে চেয়ে ভূরি ভূরি চিঠি আসত এক সময় সিরিজটির স্রষ্টার কাছে!
৫০ বছরের বেশি আগে, ১৯৬৬ সালের মে মাসে শুরু হয় মাসুদ রানা সিরিজ। মোটরসাইকেলে করে চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি ঘুরে এসে সেই পটভূমিতে সিরিজের প্রথম বই ধ্বংস পাহাড় লেখেন কাজীদা, বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক স্পাই থ্রিলার।
সেবা প্রকাশনীর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্রজাপতি প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে মাসুদ রানার প্রথম ১০টি বইয়ের কিশোর সংস্করণ। পড়ে দেখতে পারো। কাহিনি একই। জমজমাট অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিল, হাস্য-কৌতুক—সবই ঠিক রেখে শুধু নিষ্ঠুর ভায়োলেন্স এবং বড়দের উপযোগী কিছু বিষয় ও বর্ণনা বাদ দেওয়া হয়েছে। কী বললে? বাকি বইগুলো পড়ার জন্য আকুলি-বিকুলি করছে মন? চিন্তা নেই; কাজীদা নিজেই বলেছেন, তোমার মানসিক বয়স (শারীরিক নয় কিন্তু) ২০ হলেই ওসব বই পড়ার যোগ্যতা অর্জন করবে তুমি।
কাজীদার লেখালেখির শুরুটা অবশ্য কুয়াশা সিরিজ দিয়ে। ১৯৬৪ সালের জুনে প্রকাশিত কুয়াশা ১ দিয়েই যাত্রা শুরু সেবা প্রকাশনীর। ৭০টির বেশি বই বেরিয়েছে এই সিরিজের। কিশোরদের সুরুচি ও ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টিতে বইগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।
সিরিজের পাশাপাশি বিদেশি বইও অনুবাদ করেছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে জিম করবেটের রুদ্রপ্রয়াগের চিতা, আলেকজান্দার দ্যুমার দ্য কর্সিকান ব্রাদার্স, জন বুকানের দ্য থার্টি-নাইন স্টেপস, ই নেসবিটের দ্য রেলওয়ে চিলড্রেন, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের মন্টেজুমার মেয়ে, রাফায়েল সাবাতিনির দ্য ব্ল্যাক সোয়ান, লাভ অ্যাট আর্মস, রূপসী বন্দিনী এবং লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের লিটল হাউস সিরিজের অবিস্মরণীয় বইগুলো। আর তো বলতেই হবে রবিন হুড বইটির কথা। কিআ বুক ক্লাবের অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে প্রায়ই পড়ে আসতে বলা হয় বইটি। কেউ যদি এখনো না পড়ে থাকো, তো পড়ে ফেলো এক্ষুনি।
এছাড়া কাজীদার লেখা ইসকুল বাড়ি, ছোটকুমার, ঘরের শত্রু, ফুলবাগান, ক্লাস এইট ও ইতিকথা বই ছটি অবশ্যপাঠ্য তোমাদের জন্য। ৬টি কিশোর উপন্যাস শিরোনামে এক মলাটে পাওয়া যাচ্ছে এখন বইগুলো।
কাজীদা এর বাইরেও লিখেছেন বেশ কিছু গল্প ও রহস্যোপন্যাস। তবে এ-ই শেষ নয়। বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে আত্ম-উন্নয়নমূলক গ্রন্থও রয়েছে তাঁর। সঠিক নিয়মে লেখাপড়া, খালিহাতে আত্মরক্ষা, নিজেকে জানো, জনপ্রিয়তা, সুখ-সমৃদ্ধি, আত্মসম্মোহন, আত্ম-উন্নয়ন, মন-নিয়ন্ত্রণ—বুঝতেই পারছ, কোন বইয়ের কী বিশেষত্ব।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে চুটিয়ে গান গাইতেন রেডিও-সিনেমায়। সুতরাং ছবির ‘এই যে আকাশ’, ‘তুমি আসবে বলে’, উর্দু তালাশ ছবির ‘ম্যাঁয় রিকশাওয়ালা বেচারা’ গানগুলো শুনে নিতে পারো তোমরা ইউটিউব থেকে। লেখালেখির চাপে গান ছাড়লেও কাজের ফাঁকে গুনগুন করে ওঠেন এখনো।
শখের মাছশিকারও ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন লেখালেখি ও প্রকাশনার কাজে সময় দিতে গিয়ে। তবে এখনো রয়েছে মাছের নেশা। তোমরা যদি কখনো সেগুনবাগিচায় সেবা প্রকাশনীর অফিসে যাও, গেট দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁ দিকেই দেখতে পাবে চৌবাচ্চাজুড়ে সাকারমাউথ ক্যাটফিশের জলকেলি।
কাজীদার সঙ্গে প্রথম দেখা ১৯৯৭ সালে। কিশোর আমি বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম কিশোরপত্রিকা অফিসে। কিশোর আলোর মতোই মাসিক প্রকাশনা ছিল সেটি। কাজীদা সম্পাদিত চমৎকার এ পত্রিকা একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেলেও ১৯৮৪ সাল থেকে শুরু হয়ে আজও তাঁর সম্পাদনায় প্রতি মাসে বেরোচ্ছে রহস্যপত্রিকা।
আমার দৃষ্টিতে কাজীদা হচ্ছেন বাংলা পেপারব্যাক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি। রানা, কুয়াশা, তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, শিকারকাহিনি, হরর, ফ্যান্টাসি, সায়েন্স ফিকশন, গল্প-উপন্যাস, সংকলন, নন-ফিকশন, মননশীল ধর্মীয় গ্রন্থ, ছড়া-কবিতা, রূপকথা—কী প্রকাশ করেননি তাঁর প্রকাশনী থেকে! বিশ্বসাহিত্যের অপার সমুদ্র মন্থন করে সুলভে কত যে অনুবাদগ্রন্থ তুলে দিয়েছেন পাঠকের হাতে, তার তো কোনো ইয়ত্তাই নেই!
সেই ষাটের দশকে যাঁদের ‘কাজীদা’ ছিলেন তিনি, আজ তাঁদের নাতিপুতিরাও ডাকছে তাঁকে ‘কাজীদা’ বলে! দারুণ না ব্যাপারটা?