শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার গল্প
আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে বর্ণাঢ্য উজ্জ্বল আর গৌরবময় স্মৃতি হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহ সান্নিধ্য ও স্পর্শের স্মৃতি।
ওয়ারীর আকাশে বাকাট্টা হয়ে যাওয়া একটা ম্যাজেন্টা রঙের ঘুড়ির পেছনে ছুটতে গিয়ে হেয়ার স্ট্রিট ও র৵াংকিন স্ট্রিট ইন্টারসেকশনের কাছে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের হাতে ধরা পড়ার পর দাদাভাই আমাকে সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ভেতরে একটা ছবি আঁকার ক্লাসে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন একজন শিক্ষার্থী হিসেবে। আমার বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে ওখানে ছবি আঁকছিল। ক্লাসে শিক্ষক হিসেবে পেলাম হরিদাশ বর্মনকে। দাদাভাই বললেন, বর্মন বাবু, আপনার জন্য নতুন একটা ছাত্র নিয়ে এলাম।
হরিদাশ বর্মন স্যার খুব আদর করে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন কয়েকটা তুলি আর বড় একটা কার্টিজ পেপার। ক্লিপ আঁটা একটা বোর্ডও দিলেন। আর দিলেন চ্যাপ্টা একটা শুভ্র থালা। থালায় নির্দিষ্ট একটা গ্যাপে গ্যাপে প্যালিকেনের ঝকঝকে কৌটা থেকে তুলে দিলেন কিছু লাল, নীল, হলুদ, সাদা আর কালো রং। অতঃপর শুরু হলো আমার ছবি আঁকা। কচিকাঁচার মেলার ছবি আঁকার ক্লাস ‘শিল্পবিতান’-এর নিয়মিত ছাত্র হয়ে উঠলাম আমি। সময়টা ১৯৭২। ইসলামিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র আমি তখন।
বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারির এক বিকেলে দাদাভাই আমাদের ক্লাসে এসে বললেন, তোমাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকতে হবে। একাত্তরের ছবি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার ছবি। খানসেনা আর ওদের দোসরদের নির্যাতন, নিপীড়ন, অগ্নিকাণ্ড, মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই, প্রতিরোধের ছবি।
মহা উৎসাহে আমরা লেগে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকায়। কী বিপুল উদ্যম আমাদের! কত ছবি যে আঁকলাম আমরা! হরিদাশ স্যার আমাকে উৎসাহ দেন। আমাকে শিখিয়ে দেন রঙের সঙ্গে রং মিশিয়ে নতুন একটা রং তৈরির ত্বরিত পদ্ধতি। আমার জানা হয়ে যায়, লালের সঙ্গে হলুদ মেশালেই কমলা রঙের আবির্ভাব ঘটে। নীলের সঙ্গে হলুদ মেশালে সবুজ কলাপাতা রং। লালের সঙ্গে সাদা মেশালে গোলাপি। সাদার সঙ্গে কালো মেশালে ধূসর। কালোর সঙ্গে লাল মেশালে চকলেট এবং লাল আর নীল মেশালে বেগুনি। অপরূপ ঝলমলে বর্ণাঢ্য এক পৃথিবীর সন্ধান পেয়ে গেলাম আমি। দাদাভাইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী একের পর আঁকলাম মুক্তিযুদ্ধের ছবি।
আমাদের আঁকা ছবিগুলো বড় একটা প্যাকেটে ভর্তি করে দাদাভাই এক সন্ধ্যায় (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) আমাদের নিয়ে গেলেন গণভবনে, বঙ্গবন্ধুর কাছে। সেই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে আমি দেখলাম একদম কাছ থেকে, যাকে বলে ছুঁয়ে দেওয়া দূরত্বে। খুব মনোযোগ দিয়ে আমাদের আঁকা ছবিগুলো দেখলেন বঙ্গবন্ধু। কোন ছবিটা কে এঁকেছে দাদাভাই সেটা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। আমার আঁকা একটা ছবি দেখে বঙ্গবন্ধু খুব অবাক হওয়ার মতো ভঙ্গি করে প্রশ্ন করলেন, ‘ওওও, এটা তুমি এঁকেছ!’ সগর্বে মাথা দোলালাম আমি...হ্যাঁ, আমিই তো আঁকলাম। এই যে ভয়ংকর পাকিস্তানি মিলিটারিরা গ্রামের একটা বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে! পরিবারের বাবাটিকে গুলি করে মেরে ফেলেছে একজন মিলিটারি। উঠানে বাবার লাশ। যুবক ভাইটিকে একজন মিলিটারি বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারছে! ছোট্ট একটা কোলের শিশুকে রাইফেলের ডগায় বেয়নেটে গেঁথে আকাশের দিকে উঁচু করে তুলে ধরেছে একজন মিলিটারি। একজন মিলিটারির পা জড়িয়ে মা কাঁদছেন। বোনটিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে একজন মিলিটারি। বোনটির গায়ের শাড়ি অর্ধেক খুলে গেছে, বাবার রক্তে বোনটির সাদা রঙের শাড়িটার কিছু অংশ লাল হয়ে গেছে...।
আমার কথাবার্তায় খুব খুশি হয়ে হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু আমার গালে আর মাথায় হাত ছুঁয়ে আদর করে দিয়েছিলেন, ‘বাহ্, খুব সুন্দর হয়েছে তো তোমার আঁকা ছবিটা!’
ছেলেবেলা থেকেই খুব চটপটে আর ছটফটে ছিলাম আমি। বড়দের সঙ্গে কথা বলতে একটুও ভয় পেতাম না। ভয় পাইনি বঙ্গবন্ধুকেও। আর বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে এমন আন্তরিকতা মিশিয়ে কথা বলছিলেন যে আমার মনে হচ্ছিল, তিনি আমাকে চেনেন। এই প্রথম আমাদের দেখা হচ্ছে না। এর আগেও দেখা হয়েছে বহুবার, এতটাই পরিচিত আমি তাঁর কাছে। সুতরাং তাঁকে ভয় পাব কেন?
রাতে ঘটল বিশাল ঘটনা। বিটিভির নিউজে আমাদের দেখাল! সাদা–কালো টিভি তখন। দাদাভাই ছাড়াও আমাদের সঙ্গে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী হাশেম খান এবং ডক্টর আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন।
আইডিয়াটা ছিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের। মাঝেমধ্যেই কচিকাঁচার মেলার ছবি আঁকার ক্লাসে আসতেন তিনি। প্রথমে র৵াংকিন স্ট্রিট সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেনের ক্যাম্পাসে, পরে জয়কালী মন্দির রোডে কেন্দ্রীয় মেলার ছবি আঁকার ক্লাসে। ইজেলে পিসবোর্ডের ক্লিপে কার্ট্রিজ পেপার সাঁটিয়ে ছবি আঁকতাম আমরা সারিবদ্ধ হয়ে। কত দিন শিল্পাচার্য আমার স্কেচ ঠিক করে দিয়েছেন! তো, সেই শিল্পাচার্যই চাইছিলেন আমরা শিশু–কিশোরেরা যেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকি। শিল্পাচার্যের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের আঁকা ছবি থেকে তিন শ ছবি বাছাই করা হলো।
আমাদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর একটা প্রদর্শনী হয়েছিল জয়কালী মন্দির মেলা ভবনেই। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সেই প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদ। (আমাদের আঁকা তিন শ ছবি থেকে সত্তরটি ছবি বাছাই করেছিলেন শিল্পাচার্য। সেই ৭০টি ছবি নিয়েই আমরা গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে।)
শিল্পাচার্য বিদেশ সফরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় আইডিয়াটা এসেছিল। তিনি সঙ্গে করে ছোটদের আঁকা কিছু মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে যেতে চান। তিনি চান বিশ্ববাসী দেখুক শিশুদের চোখে একাত্তরের ভয়াবহতা। নৃশংসতা। বঙ্গবন্ধুকে তিনি তাঁর পরিকল্পনার কথাটা বলেছিলেন। শুনে বঙ্গবন্ধুও একমত পোষণ করেছিলেন—হ্যাঁ, আমাদের শিশুদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো দেখে বিশ্ববাসী বলুক বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য ছিল কি না।
আমাদের আঁকা ছবিগুলো শিল্পাচার্য নিয়ে গেলেন লন্ডনে। লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে ছবিগুলোর প্রদর্শনী হলো ১৯৭২ সালের ২২ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত। এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেন। প্রদর্শনী উপলক্ষে শিল্পী হাশেম খানের তত্ত্বাবধানে দু–তিন ভাঁজের দৃষ্টিনন্দন একটা ফোল্ডার ছাপা হয়েছিল। সেই ফোল্ডারে আমার আঁকা একটা ছবিও স্থান পেয়েছিল। ছবির ক্যাপশনে খুদে হরফে ছাপা হয়েছিল আঁকিয়ের নাম—রিটন, বয়স ৯ বছর।
লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে পরে কানাডাসহ আটটি দেশের আটটি শহরে ছবিগুলোর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিপুল দর্শক সমাগম হয়েছিল সর্বত্র, সব প্রদর্শনীতেই। ওখানকার পত্রপত্রিকায় ছাপা এ–সংক্রান্ত রিপোর্ট এবং বিশেষ প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশের শিশুদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবি। খুব সাড়া পড়ে গিয়েছিল বিদেশের মাটিতে। শিশুদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার ছবিগুলো রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল মিডিয়াসহ নানা পেশার মানুষের হৃদয়ে। বিবিসিসহ অন্য সংবাদমাধ্যমগুলোও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিল অভিনব এই বিষয়টিকে। আমাদের মতো খুদে শিল্পীদের তুলিতে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করে হতভম্ব হয়েছিলেন ভিনদেশিরা। আর সেটা অবহিত হয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই কাহিনি আমাদের বলেছিলেন দাদাভাই ও হাশেম খান।
পরে দাদাভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, আমাদের আঁকা কয়েকটা ছবি মস্কোয় পাঠানো হয়েছিল উপহার হিসেবে। রাষ্ট্রীয় উপহার।
শিল্পাচার্যের পরিকল্পনা অনুযায়ী রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের নেতৃত্বে যেদিন সন্ধ্যায় আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম, সেদিন রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবরে আমাদের দেখিয়েছিল। সাদা–কালো টিভিতে বঙ্গবন্ধুর পাশে নিজেকে অবলোকন করে ছোট্ট আমার কী যে আনন্দ, কী যে আনন্দ!
তখন তো আর এখনকার মতো এত প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ছিল না। ছিল শুধু একটাই, সবেধন নীলমণি ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’। কোটি কোটি দর্শক ছিলেন বিটিভির। ন্যাশনাল নিউজের কয়েক সেকেন্ডের ফুটেজ রীতিমতো ‘বিখ্যাত’ বানিয়ে দিয়েছিল আমাকে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য আমাকে প্রায় তারকার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।
স্কুলে, রাস্তায় চেনা-অচেনা মানুষগুলো আমাকে আবিষ্কার করে বিস্মিত হয়—আরে! এই ছেলেটাকেই না দেখলাম টিভিতে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে!
গর্বে আমার পা পড়ে না মাটিতে। সেই রাতের টেলিভিশন ছাড়াও পরের দিন সকালে প্রায় সব দৈনিক পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে (কোনোটায় শেষের পাতায়) ছাপা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একদল শিশুর একটি ছবি। বঙ্গবন্ধুর পাশে তাঁর কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি আমি! দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া তিন কলাম সাত ইঞ্চি মাপের ছবিটা কেটে রেখে দিয়েছিলাম অনেক যত্ন করে। ইত্তেফাক, অবজারভার, টাইমস-এ ছাপা হয়েছিল ছবিটা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। কয়েক বছর পর সাপ্তাহিক খবর–এ প্রকাশিত সৈয়দ আলী নওয়াব রচিত আমি রাসেল বলছি নামের বইয়েও সেই ছবিটা মুদ্রিত হতে দেখেছি (বইটির পরবর্তী সংস্করণে লেখক হিসেবে মিজানুর রহমান মিজানের নাম ছাপা হয়েছে। প্রকাশক নভেল পাবলিশার্স)।
দুই
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কচিকাঁচার মেলার জাতীয় শিক্ষাশিবির বা ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়েছিল গুলিস্তানের পাশে, বঙ্গভবনের উল্টো দিকে, শহীদ মতিউর শিশুপার্কে। সারা দেশ থেকে কচিকাঁচার মেলার বিভিন্ন শাখার হাজারখানেক কিশোর-কিশোরী সেই ক্যাম্পে অংশ নিয়েছিল। আমিও অংশ নিয়েছিলাম সেই ক্যাম্পে কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে। মতিউর শিশুপার্কে আমরা থাকতাম তাঁবু খাটিয়ে। এই শিবির বা ক্যাম্পে কঠোর অনুশাসনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলত আমাদের নানা রকম কর্মকাণ্ড। শরীরচর্চা, প্যারেড-পিটি, ব্রতচারী, বাঁশনৃত্য, লাঠিখেলা, উপস্থিত বক্তৃতা, গান, আবৃত্তি কত কিছু! এই ক্যাম্পে ব্রতচারী শিক্ষক হিসেবে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত ‘ওস্তাদ ভাই’কে পেয়েছিলাম আমরা। বয়সে প্রবীণ কিন্তু শারীরিকভাবে শক্তিমান নবীন ছিলেন তিনি। ধনুকের ছিলার মতো টান টান শরীরের ওস্তাদ ভাই শেখাতেন লাঠিখেলা। ডানে-বাঁয়ে-সামনে-পেছনে বিদ্যুৎ গতিতে লাঠি চালিয়ে শত্রুকে কুপোকাৎ করার কৌশল শিখেছিলাম তাঁর কাছ থেকে। কী বিস্ময়কর দ্রুততায়ই না লাঠি চালাতেন সেই বৃদ্ধ! একাই লড়তেন চার–চারজন লাঠিধারীর সঙ্গে! ওস্তাদ ভাইয়ের কাছেই শিখেছিলাম ব্রতচারী নৃত্য এবং সেই ‘নৃত্যের সঙ্গে গীত’ অনবদ্য কিছু গান—ইয়া জসোবা ইয়া জসোবা গুরুজি ইয়া জসোবা/ অবাক করে গুরুজি তব মানব সেবা/ রায়বেশে কাঠি সারি ঢালি ঝুমুর ঝারি/ তাই গেয়ে প্রণাম জানাই যত ব্রতচারী/...(‘ইয়া’ একটি রিদমসমৃদ্ধ ধ্বনি এবং জসোবা হচ্ছে ‘জয় সোনার বাংলা’র সংক্ষিপ্ত রূপ)। শিখেছিলাম—মায়ের জাতের মুক্তি দে রে/ যাত্রাপথের বিজয় রথে চক্র তোদের ঠেলবে কে রে?/ মায়ের জাতের মুক্ত প্রভাব/ গড়বে তোদের বীরের স্বভাব/ বিশ্ব সভার উচ্চাসনে চড়বে না কেউ তোদের ছেড়ে...।
ক্যাম্পে, আমাদের প্রত্যেকের বুকে একটা ব্যাজ ও সংখ্যা লেখা একটা স্টিকার সাঁটানো থাকত। আমার সংখ্যাটি ছিল সম্ভবত ৩৮০। এই সংখ্যাটির মাধ্যমেই আমাদের আইডেন্টিফাই করা হতো। আমাদের সারা দিনের কর্মকাণ্ড, আচরণ ইত্যাদি গোপনে লক্ষ রাখতেন সিনিয়ররা, অর্থাৎ সাথি ভাইয়েরা। সাথি ভাইয়েরা আমাদের কীভাবে খেয়াল রাখতেন, সেটা আমরা টেরও পেতাম না। প্রতিদিন আমাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড, আচরণ ও সাফল্য–ব্যর্থতা অনুযায়ী তাঁরা নম্বর দিতেন (তাঁদের নোটবইয়ে টুকে রাখতেন)। সেই নম্বরগুলো যোগ করে মেলার সমাপ্তিতে তিনটি ক্যাটাগরিতে আমাদের কয়েকজনকে খেতাবে ভূষিত করে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। সেই ক্যাম্পের সর্বোচ্চ খেতাব ‘দলমণি’ অর্জন করেছিলাম আমি। দাদাভাই বলেছিলেন, ক্যাম্পের সমাপ্তিপূর্ব কোনো একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে অথবা দাদাভাই আমাদের নিয়ে যাবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করেছি—কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! কখন দেখব তাঁকে সামনাসামনি!
তো, আমাদের ক্যাম্পের তাঁবুবাসের শেষ দিকে, এক মনোরম বিকেলে অনেক বাস বোঝাই হয়ে আমরা গিয়েছিলাম গণভবনে, বঙ্গবন্ধুর কাছে। ১৯৭২-এর পর সেটা ছিল আমার ছুঁয়ে দেওয়া দূরত্ব থেকে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু দর্শন।
সেদিনের সেই বিকেলটা খুবই মনোরম ছিল। উজ্জ্বল সোনালি রোদের আভায় ভীষণ চকচকে ছিল। আমাদের পেয়ে কী রকম উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু! সহসা বঙ্গবন্ধু দাদাভাইকে বললেন, আসেন দাদাভাই, আপনার সঙ্গে একটু ব্রতচারী হয়ে যাক। তারপর ঝাউর গিজার গিজঘিনিতা/ ঝাউর গিজার গিজঘিনিতা/ এক ধামা চাল একটা পটোল/ এক ধামা চাল একটা পটোল...বলতে বলতে বঙ্গবন্ধু নির্দিষ্ট একটা রিদমে ব্রতচারীর একটা মুদ্রা এমন চমৎকার নিখুঁত দেহভঙ্গিতে আমাদের দেখালেন যে হাততালিতে মুখর হয়ে উঠলাম আমরা। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য! বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্রতচারী নৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন দাদাভাইও। দাদাভাই আর বঙ্গবন্ধুর যৌথ ব্রতচারী নৃত্যের অবিস্মরণীয় সেই দৃশ্যটি নিশ্চয়ই ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন কোনো আলোকচিত্রী। যদিও সেই আলোকচিত্র আমার দেখা হয়নি।
সেই বিকেলে আমাদের নিজস্ব কিছু আনুষ্ঠানিকতাও ছিল। আমার নেতৃত্বে মার্চপাস্ট হলো। মার্চপাস্টে ছেলেমেয়েদের স্যালুট গ্রহণ করলেন বঙ্গবন্ধু। মার্চপাস্টের শুরুতে ছোট্ট এইটুকুন আমি বিশাল দেহের বঙ্গবন্ধুর মাথায় পরিয়ে দিলাম কচিকাঁচার মেলার ক্যাপ। খুব নিচু হয়ে মাথাটা আমার নাগালের কাছে নামিয়ে এনে বিরাট-বিশাল বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করলেন আমার মতো একজন খুদে বন্ধুর স্মারক উপহার। বঙ্গবন্ধুর মাথা ও মাথার চুল স্পর্শ করতে হলো আমাকে, ক্যাপটা তাঁকে পরাতে গিয়ে। তাঁর শক্ত ও ঘন কালো চুলগুলো ভীষণ ঠান্ডা ছিল। আমাদের কাছে আসার আগ পর্যন্ত সারা দিন একটানা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে ছিলেন বলেই কি তাঁর সতেজ ঘন চুলগুলো এত শীতল লাগছিল আমার কাছে! কী জানি!
ক্যাপটা পরানোর পর বঙ্গবন্ধু হ্যান্ডশেক করলেন আমার সঙ্গে। আহা কী নরম তাঁর হাতটা! তারপর তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত তর্জনীটি, একাত্তরের সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের চিরস্মরণীয় সেই আঙুলটি আমার দিকে তাক করে খুবই হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বললেন, ‘আরে, এই ছেলেটাকে তো মনে হয় চিনি আমি!’
আমি আমার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে তাঁর হাতটা জড়িয়ে ধরলাম, হ্যাঁ, চেনেন তো! আমি রিটন। ছবি আঁকি। আমাদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম তো!
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আরে, তাই তো, এইটাই তো সেই আর্টিস্ট ছেলেটা। খুব সুন্দর ছবি
আঁকে! বড় হয়ে কী হবা তুমি?’
আর্টিস্ট হব।
‘কত বড় আর্টিস্ট হবা?’
জয়নুল আবেদিনের মতো বড় আর্টিস্ট হব।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাহ্, আমাদের তাহলে দুইটা জয়নুল আবেদিন হবে!’
আমাদের কথোপকথনের সময় পাশে থাকা কবি সুফিয়া কামাল আর রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই খুব হাসছিলেন। আমার গালে আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে আদর করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাতের এই ঘটনার একটাই স্টিল ছবি পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু স্যালুট নিচ্ছেন কচিকাঁচার মেলার ভাইবোনদের। তাঁর বাঁ পাশে কবি বেগম সুফিয়া কামাল আর দাদাভাইয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি আমি সেদিনের ছোট্ট বালক লুৎফর রহমান রিটন।
সম্প্রতি একটা ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। সেই ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে বিশাল দেহের বঙ্গবন্ধু মাথাটা নিচু করে আমার নাগালের মধ্যে এনে দিচ্ছেন আর আমি তাঁর মাথায় পরিয়ে দিচ্ছি ক্যাপ। তিনি আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন। তাঁর বিখ্যাত তর্জনীটি আমার দিকে তাক করে কথা বলছেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে। ছোট্ট বালক আমি একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে খুব হাসিখুশি ভঙ্গিতে কথা বলছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। আমাদের কথোপকথন শুনে হাসছেন দাদাভাই এবং সুফিয়া কামালও। অপরূপ হাসিমুখে সুফিয়া কামাল হাততালি দিচ্ছেন। একটা অসাধারণ ফ্রেম। সেই ফ্রেমে বঙ্গবন্ধুসহ আমরা সবাই হাস্যোজ্জ্বল। আহা কী গৌরব-সঞ্চারি একটা দৃশ্য। আমার সারা জীবনের এক অনন্য প্রাপ্তি এই ভিডিও ফুটেজটি। কুমার বিশ্বজিতের একটি গানে এই ফুটেজটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্রচারিত হয়েছে চ্যানেল আইতে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার এই দ্বিতীয় সাক্ষাতের ঘটনাটা বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবর ছাড়াও সিনেমা হলগুলোতে দেখানো হয়েছিল। সে আরেক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা ছিল আমার জীবনে।
তখন বাংলাদেশের সিনেমাহলগুলোতে সিনেমা শুরু হওয়ার আগে ‘চিত্রে বাংলাদেশের খবর’ নামে একটা সেগমেন্ট প্রচারিত হতো। বঙ্গবন্ধুর মাথায় আমি কচিকাঁচার মেলার ক্যাপ পরিয়ে দিচ্ছি, তিনি নিচু হয়ে ঝুঁকে আমাকে সহায়তা করছেন, ক্লোজ শটে এই দৃশ্যটি ‘চিত্রে বাংলাদেশের খবরে’ বহুদিন দেখানো হয়েছিল। গমগমে ভরাট হিরণ্ময় কণ্ঠে এই খবর পাঠ করেছিলেন বিখ্যাত সংবাদ পাঠক সরকার কবির উদ্দিন। মধুমিতা সিনেমা হলের বিরাট পর্দায় সেই দৃশ্য আমাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন অগ্রজ এ টি এম মিজানুর রহমান। আহা কী মধুর সেই দৃশ্য! কয়েক সেকেন্ডের সেই দৃশ্যটা দেখার জন্য সিনেমার দুটি টিকিট কিনতে হয়েছিল আমার অগ্রজকে। বাড়তি পাওনা হিসেবে সেদিন কোন সিনেমাটা দেখেছিলাম, সেটা আজ মনে নেই। তবে সিনেমার বড় পর্দায় সাদা–কালো ঝকঝকে চলমান ছবিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নিজেকে অবলোকনের সেই স্মৃতিটা আমার মস্তিষ্কে মুদ্রিত হয়ে থাকল স্থায়ীভাবে।
সে বছর ১০ জুলাই আমি বার্লিন গেলাম।
পূর্ব জার্মানির রাজধানী তখন বার্লিন। জার্মানি তখন দুই ভাগে বিভক্ত—পূর্ব আর পশ্চিম। পশ্চিম জার্মানি ধনতান্ত্রিক দেশ আর পূর্ব জার্মানি সমাজতান্ত্রিক।
ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে বাংলাদেশের শিশু প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য হিসেবে আমার সেই বার্লিন যাত্রা। সেই প্রতিনিধিদলে কচিকাঁচার মেলার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম আমিসহ তিনজন। ঢাকার মেয়ে ইশরাত নিগাহ্ বোখারী শাকিলা, কুমিল্লার মেয়ে শুক্লা রায় আর আমি। খেলাঘর থেকে নির্বাচিত হয়েছিল তিনজন, যাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার মেয়ে তাহমিনা সুলতানা স্বাতী (ছাত্রনেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ছোট বোন) এবং মিতা হক (সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের ভাতষ্পুত্রী)। আমাদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন খেলাঘরের পান্না কায়সার (শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী। অভিনেত্রী শমী কায়সারের মা)। ছয় সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদলে আমিই একমাত্র ছেলে। বাকি সবাই মেয়ে! সেই মেয়েদের একজন এখন খুবই বিখ্যাত, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক।
কুড়ি-পঁচিশটা দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা এসেছিল সেই ফেস্টিভ্যালে। বার্লিনে আমরা কুড়ি দিন ছিলাম। এক বিকেলে একটা স্টেডিয়ামে আমাদের পারফরম্যান্স ছিল। বিশাল স্টেডিয়ামভর্তি প্রায় হাজার পঞ্চাশেক মানুষের উপস্থিতিতে আমার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা একটা ছড়াগান গেয়েছিল—রেল চলে ঝিকঝিক/ ঝিকঝিক ঝিকঝিক/ চলছে তো চলছে চলছে/ হুইসেল বাজিয়ে যাত্রীকে ডাকছে/ ঘুম থেকে উঠতে সে বলছে/....। খুব ভালো হুইসেল দিতে পারতাম আমি। রেলের হুইসেল। গানটির মাঝখানে বারকয় আমি সেই হুইসেলটা দিতাম প্রাণপণে। এই গানটা বার্লিন ক্যাম্পে খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েরা আমাদের দেখলেই ‘ঝিক্ঝিক্ ঝিক্ঝিক্’ বলে উল্লাস প্রকাশ করত। গানটির সুর আর রিদম সম্ভবত মুগ্ধ করেছিল ওদের। স্টেডিয়ামেও আমাদের সঙ্গে ‘ঝিক্ঝিক্ ঝিক্ঝিক্’ করছিল ছেলেমেয়েরা। আমার হুইসেলটাও বিপুল করতালি কুড়িয়েছিল সেদিন।
বার্লিনের অনুষ্ঠানমালায় একটা দিন ছিল একেবারেই অন্য রকম। আগে থেকেই ঘোষণা দেওয়া সেই দিনটা ছিল সব দেশের ছেলেমেয়েদের জাতীয় পোশাক পরার দিন। পান্না ভাবিসহ দলের মেয়েরা সবাই পরল সুন্দর সুন্দর শাড়ি। কী যে সুন্দর লাগছিল মেয়েগুলোকে! ফিরোজা রঙের ঝলমলে একটা শাড়ি পরেছিলেন পান্না কায়সার। অসম্ভব রূপসী ছিলেন তিনি। তাঁকে পরির মতো লাগছিল। সেদিন বিকেলের সেই অনুষ্ঠানে মিডিয়ার দৃষ্টি কেড়েছিল আমাদের মেয়েরা, সব দেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রবল ঈর্ষা জাগিয়ে। সেদিন সব ক্যামেরাম্যান মানে ফটোসাংবাদিকেরা ঝাঁক বেঁধে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে অবিরাম শাটার টিপে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশের শাড়ি পরা মেয়েদের তাক করে।
বাংলাদেশের মেয়েদের না হয় জাতীয় পোশাক শাড়ি। কিন্তু ছেলেদের? আমি কি লুঙ্গিটুঙ্গি পরে নেমে পড়ব মাঠে?
না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি হাজির হলাম সেখানে, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিবকোট পরে। মুহূর্তেই বেধে গেল হুলুস্থুল কাণ্ড! ফটোসাংবাদিকেরা এবার একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার ওপর। অবিরাম শাটার টিপছেন তাঁরা। ফ্ল্যাশগানের আলোয় ভেসে যাচ্ছি আমি! শেষ বিকেলের যাই যাই রোদের আলো-আঁধারির অপরূপ বিভায় সে এক স্বর্ণালি সময়ের বর্ণালি মুহূর্ত! বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদলের নেতারা ছুটে এসে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে করতে মহাবিস্ময়ে উচ্চারণ করলেন—‘শ্যাক্ মুজিবুর রক্মান, ব্যাঙ্গালাডেস...!’
ফটোসাংবাদিকেরাও আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন—‘হ্যাল্লো শ্যাক্ মুজিবুর রক্মান’!
আমার খুশি দেখে কে! খুশিতে প্রায় লাফাচ্ছি আমি।
সদ্য স্বাধীন একটি দেশের মহান স্থপতিকে, আমাদের বঙ্গবন্ধুকে, আমাদের শেখ মুজিবুর রহমানকে পৃথিবীর সবাই চেনে! তাঁর নাম, তাঁর ফটোগ্রাফ, এমনকি তাঁর পোশাকটি পর্যন্ত পরিচিত বিশ্ববাসীর কাছে! ও রকম সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে হাফ স্লিভ কালো কোট পৃথিবীতে একজন নেতাই পরেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর পোশাকটাই ট্রেডমার্ক পৃথিবীর মানুষের কাছে। আর তাই তো বঙ্গবন্ধুর পোশাকে আমাকে দেখেই চারপাশের লোকজন উল্লাসে ফেটে পড়েছে—‘হ্যাল্লো শ্যাক্ মুজিবুর রক্মান’!
সেদিন রাতে বার্লিনের টিভি নিউজে আমাদের দেখিয়েছিল। টিভি পর্দায় নিজের রঙিন ছবি দেখার অভিজ্ঞতা আমার সেই প্রথম। এর আগে কালার টিভি দেখিনি আমি।
পরদিন বার্লিনের বেশ কয়েকটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিবকোট পরিহিত খুদে এক বঙ্গবন্ধুর ছবি! ছবির ক্যাপশনে এমনটাই বলা হয়েছিল। আমাদের ইন্টারপ্রেটার জার্মান তরুণী ডাচ ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকার ক্যাপশন অনুবাদ করে শুনিয়েছিলেন আমাকে।
আজ ৪৫ বছর পর আমার স্মৃতির অ্যালবামের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য পাতাটির দিকে চোখ রাখতে গিয়ে কেবলই মনে হচ্ছে জাতীয় পোশাক পরার সেই বিশেষ দিনটিতে, বার্লিনে, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে মুজিবকোট পরে, কাকতালীয়ভাবে, মনের অজান্তেই আমাদের জাতীয় পোশাকহীনতার বিষয়টিকে আড়াল করতে সক্ষম হয়েছিলাম (পোশাকের আইডিয়াটা ছিল আমার বাবার। তিনিই আমাকে দরজির কাছে নিয়ে গিয়ে বানিয়ে দিয়েছিলেন পোশাকটা)। অথচ স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও আমাদের কোনো ‘জাতীয় পোশাক’ নেই!
শৈশবে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যস্মৃতি আমার মনোজগতে চিরস্থায়ী একটা ছাপ ফেলে দিয়েছিল। তাঁর স্পর্শের সৌরভ আর সান্নিধ্যের গৌরব দীপান্বিত করেছিল আমাকে। সেই বৈভব আমি বহন করে চলেছি আজও। আমার করোটির চিরহরিৎ অলিন্দে থাকা, হৃদয়ের গভীর গোপন কুঠুরিতে থাকা একজন মুজিব প্রায়ই ছন্দ হয়ে হাসেন এবং ছড়া হয়ে আসেন। প্রকৃতি এক অদ্ভুত খেলা খেলে আমার সঙ্গে। একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে যেনবা প্রকৃতিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় শেখ মুজিবের ছড়া। একের পর এক। আর সেটা মুদ্রিত হয় আমার নামে—‘কান পেতে শোনো এই বাংলার মাটি বায়ু নদী সরোবর/ জপিতেছে নাম করিয়া প্রণাম মুজিবর আহা মুজিবর...।’