রাতের অন্ধকার ফিকে হওয়ার আগেই শুরু হয়েছিল।
ঝিনাইদহ গিয়েছি নাটকের কাজে। একটা রেস্ট হাউসে রাত কাটিয়ে কাল সকালে অন্যত্র চলে যাব সে রকম ব্যবস্থাই করা হয়েছে। অনেক রাতে ঢাকা থেকে এসে পৌঁছেছি, ক্লান্ত। ঘুমচোখে শুতে শুতে ভাবলাম একটু বেলা করেই উঠব। নতুন বিছানায় ঘুম আসে না কিন্তু ক্লান্তির কারণে সেই সমস্যা আর সমস্যা হয়নি। ঘুমিয়ে গেছি, তবে বেলা করে ওঠা আর হলো না। উঠতে হলো ভোর পাঁচটার দিকে।
অন্ধকার সবে সরে যাচ্ছে। কাছেধারে কোনো একটা পাখির চিৎকারে সারাটা পাড়া জেগে গেছে। পাখি তো আর এসব জানে না সে সমানে ডেকে যাচ্ছে। ডাকটা কেমন যেন চেনা লাগে অথচ ধরতে পারছি না। অনেকটা কোকিলের মতো কিন্তু কোকিল নয়। মনে হলো এ ধরনের পাখির ডাক আগে কখনো শুনিনি। ডাকাডাকিটা খুব কাছেই হচ্ছে। সুতরাং দেখার ইচ্ছাটা আর দমন করা গেল না। উঠে জানালার কাছে গেলাম। কোকিল হতে পারে, এমন চিন্তাও আমার মাথায় আছে। কোকিল যেখানে দূর থেকেও যখন-তখন দেখা যায় না সেখানে কাছ থেকে দেখতে পেলে মন্দ কি। এসব সাতপাঁচ চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জানালার কাছে ডাকটা আরও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। অদ্ভুত একটা শব্দ। কেমন ভাঙা ভাঙা। পরিণত পাখি যেমন করে ডাকে সে রকম নয়। খুব আস্তে করে জানালাটা খুললাম। এতক্ষণ আমি যে ডাকটা শুনছিলাম সেটা কোকিলের মতোই লাগছিল। সুতরাং ধরেই নিলাম পাখিটা কোকিলই হবে। ডাকের শুরুটা ঠিকই হচ্ছে কিন্তু একটু এগোতেই আর সুর থাকছে না। তৃতীয় একটা স্তরে এসে সুরটা মোটেও আর লাগছে না। ডাকটা ডাকই কেবল, সুর আর হছে না। ভাবলাম পাখিটা অসুস্থও হতে পারে।
চারদিক এখনো জাগেনি। নীরবতায় দূরের শব্দও কাছের মনে হয়। জানালা খুলতেই গ্রিলের কারিকুরির ভেতর দিয়ে কালো রঙের পাখিটা আমার চোখে পড়ল। অতটা স্পষ্ট নয় তবে দেখা যাছে। একেবারে কাছে। কাক আর কোকিলের রং একই, কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় কোনটা কী। আমি কিছুটা অবাক হলাম। বড় গাছের ফাঁকফোকরে এর আগে কোকিল দেখেছি কিন্তু কোনো দিন এত কাছ থেকে দেখিনি। কোকিল দূরের পাখি, দূরকে কাছে দেখলে একটু অবাক তো লাগেই।
জানালার গা ঘেঁষেই অন্য বাড়ির ছাদ। তারই কার্নিশে বসে ডাকছে পাখিটা। কোকিলই, তবে কোকিল বলা যাবে না, কোকিলের বাচ্চা। দেখলেই বোঝা যায় বাচ্চাটা কোকিলের। কাকের সঙ্গে তার মিল আছে বলেই প্রাকৃতিক নিয়মে কাকের ঘরেই কোকিল শিশুর জন্ম হয়। কিন্তু বেড়ে উঠতে শুরু করলেই বোঝা যায় বাচ্চাটা কাকের নয়। বাচ্চাটা এক জায়গা থেকে উড়ে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। ভালো করে উড়তে এখনো শেখেনি। উড়লেই পুচ্ছ ছড়িয়ে পড়ছে। গায়ে পায়ে কাকের বাচ্চার থেকে অনেকটা চিকন। দারুণ অস্থির লাগছে তাকে। একবার কার্নিশ থেকে উড়ে গিয়ে কী একটা ঝাঁকড়াগাছের ডালে বসছে। তখন আর ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু আমি চোখ ফেরাচ্ছি না। খানিক পরে আবার গাছের নিচে নামছে। একটু হাঁটছে, আবার উড়ে গিয়ে বসছে নারকেলগাছের পাতায়, সেখান থেকে আবার ছাদের কার্নিশে। বসেই স্বরভাঙা ডাকাডাকি। অবিরাম ডেকে যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই সুর লাগছে না। শুরুটা হচ্ছে কিন্তু তৃতীয় পর্যায়ে এসেই বেসুরো হয়ে যাচ্ছে। পঞ্চমে সুর একদম লাগছে না। হাঁ করলেই লাল মুখটা দেখা যাচ্ছে—মানে, এখনো নিতান্ত শিশু। ভালো করে এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। এমনকি একজন মানুষ যে তাকে দেখছে সে খেয়ালও তার নেই। অবিরাম ডেকে যাচ্ছে। তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করারও কেউ নেই। একেবারে একা। কাকের ঘরে ডিম ছেড়েই বাবা-মা চলে গেছে। তাদের দায়িত্ব শেষ। কোকিল বংশের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখার একটা পর্যায় পর্যন্তই তাদের দায়িত্ব। মানবশিশুর মতো দীর্ঘ সময় ধরে কেউ তাকে কিছু শেখায় না। নিজে নিজেই শিখে নিচ্ছে, দেখে নিচ্ছে। সবে অল্প দূর পর্যন্ত উড়তে শিখেছে বাচ্চাটা। কার্নিশ থেকে নারকেলগাছ পর্যন্ত। বুঝতে অসুবিধা হয় না এখন এ শিশুর অনুশীলন পর্ব চলছে। তৃতীয় এবং পঞ্চম ডাক যে এখনো পরিষ্কার হয়নি সে তার শিশু পর্যায়ের জন্যই। অবিরাম ডাকার কারণটাও হয়তো তাই। সংগীতের ভাষায় একে রেওয়াজও বলা যেতে পারে। এভাবে ডাকতে ডাকতেই একসময় কণ্ঠ আর ভাঙবে না। সুরেলা ভুবন মাতানো কুহু রব তখনই বেরোবে। দেখে এবং ভেবে দারুণ অবাক হলাম, তাহলে কোকিলও অনুশীলনের ভেতর দিয়েই তার কণ্ঠে সুরের মাধুর্য আনে? যখন কোকিলকে আমরা ডাকতে শুনি তখন তার গর্বিত কণ্ঠের ঐশ্বর্যই আমরা টের পাই, আড়ালের এই পরিশ্রমটুকুর খবর রাখি না।
মানুষের মধ্যে যারা সংগীতের সাধনা করে তাদের যেমন কঠিন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, এই পাখিটিকেও সে রকম একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তবেই না কোকিল কণ্ঠ। প্রকৃতির কোথাও কোনো অনিয়ম নেই। যার যা কাজ তাকে তাই করতে হয়। করে করেই নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়। মানুষই শুধু অনিয়ম করে। গান গায় কিন্তু গলা সাধে না, ইচ্ছা করে কিন্তু ইচ্ছাপূরণের জন্য প্রয়োজনীয় কষ্টটুকু করতে চায় না। তবে যারা করে তারাই জ্বল জ্বল করে ওঠে, সে তো চোখেই দেখা যায়।
লেখক: অভিনেতা ও নাট্যকার
অলংকরণ: ষুভ