দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে না বলে বাংলা ক্যালেন্ডারের ব্যবহার প্রায় উঠেই গেছে। তাই বাংলা মাসের পালাবদল এখন অনেকেই হয়তো খেয়ালই করে না। কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতা না দেখেই কিছু কিছু ঋতুর আগমন বেশ টের পাওয়া যায়। এই যেমন শরৎ ঋতু। এ সময় আকাশ থাকবে গাঢ় নীল। আর তার ওপর ডিটারজেন্ট পাউডারের বিজ্ঞাপনের মতো ছড়ানো ছিটানো হাসিখুশি ধবধবে সাদা মেঘ। এ ঋতুতেই দিকে দিকে ফুটবে মেঘের মতো সাদা কাশফুল আর শিউলি। তবে এ দুইয়ের মধ্যে শিউলিকেই বলা হয় শরতের প্রধান ও শ্রেষ্ঠ ফুল। গ্রীষ্ম ঋতুর অন্য সব ফুলও অবশ্য এ সময় থাকে, কিন্তু শরতের সেরা শিউলি। এ ফুলের আরেক নাম শেফালি। শিউলির কোমল সাদা পাঁচটি পাপড়ির সঙ্গে বোঁটার রং লালচে হলুদ। দুর্দান্ত ও দুর্লভ তার যুগল সৌন্দর্য। পাপড়িও একটু পুরু এবং তার কোমলতা চোখে পড়ার মতো। এ রকম ফুল ভূ-বাংলায় আর নেই। আর সুগন্ধও তেমনি স্নিগ্ধ ও মনকাড়া। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ ফুলটি সন্ধ্যায় ফোটে, সূর্য ওঠার আগে ঝরে পড়ে গাছতলায়। কেন?
এর উত্তর হিসেবে শিউলি সম্পর্কে ভারতীয় ও গ্রিক পুরাণে আছে এক কিংবদন্তি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ভৌগোলিকভাবে ভারত উপমহাদেশ আর গ্রিস পৃথিবীর দুই প্রান্তে অবস্থিত হলেও এ দুটি কাহিনিই প্রায় একই রকম। এটি কী করে হলো বলা খুব কঠিন। যাহোক, বাংলা-ভারতীয় কাহিনিটি হলো: পারিজাত নামে নাগরাজের এক কন্যা ছিলেন। নাম তাঁর পারিজাতক। তাঁকে খুব ভালোবাসতেন সূর্যদেব। তবে পরে সূর্যদেব অন্য এক নারীর ভালোবাসায় মুগ্ধ হন। এরপর পারিজাতককে ত্যাগ করেন সূর্যদেব। এই দুঃখ ও অভিমানে দেহত্যাগ করেন পারিজাতক। প্রাণত্যাগের ঘটনার জায়গায় তখন জন্ম নিল একটি গাছ। কিছুদিন পর তাতে ফুটল পবিত্র সাদা রঙের ফুল। কিন্তু বোঁটায় রইল ভালোবাসার লালচে হলুদ দুর্লভ রং। তবে রাজকন্যা মরে গাছ হয়েও ভোলেননি তাঁর বিগত দিনের দুঃখের কথা। ভোলেননি সূর্যের প্রতি তাঁর অভিমানের কথা। তাই সকালে সূর্য ওঠার আগে ঝরে পড়ে যায় শিউলি।
শিউলির বৈজ্ঞানিক নাম Nyctanthes arbortristis L., পরিবার হলো ঙষবধপবধব। এ নামের প্রথমাংশ বা নিকটেনথাস গ্রিক শব্দ, যার অর্থ রাতের ফুল। আর আরবট্রিসটিস অর্থ বিষাদিনী তরু। এ নামকরণের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিক উপকথাটি জড়িয়ে আছে। উপকথাটি এই, এক রাজকন্যে। অসাধারণ তাঁর রূপ-লাবণ্য। ভালোবাসলেন উজ্জ্বল দীপ্তিমান সূর্যদেবতাকে। সূর্যের প্রেমে রাজকন্যে মাতোয়ারা। কিন্তু এমন একাগ্র প্রণয়িনীকে সূর্য ত্যাগ করলেন। বঞ্চিত-লাঞ্ছিত রাজকন্যে অপমানে আত্মহত্যা করলেন একদিন। অভিমানী রাজকন্যের চিতার ছাই থেকে শেষে জন্ম নিল একটি গাছ। গাছের শাখায় শাখায় হতভাগিনী রাজকন্যের সব দুঃখ ফুটল ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে। তাঁর আশ্চর্য হৃদয়ের সব সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হলো বর্ণে-গন্ধে-লাবণ্যে-সুষমায়। কিন্তু ফুটল রাতের অন্ধকারে, সবার অগোচরে। কারণ, সূর্যের প্রতি তাঁর প্রবল ঘৃণা, প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা। সূর্য পুব আকাশে দেখা দিতে না দিতে ঝরে পড়ল সেই ফুল। ঘৃণা ও লজ্জায় মুখ ঢাকেন মা ধরণির কোলে। ভারতীয় আর গ্রিক কাহিনির এমন মিল হলো কী করে!
অনেকে বলেন শিউলি এসেছে বিদেশ থেকে। অথচ খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬ অব্দে জন্ম নেওয়া কবি কালিদাসের কাব্যে শিউলির কথা আছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে শিউলি। কবিতা-গানেও শিউলির আছে বিশেষ স্থান। এ ফুল নিয়ে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল লিখে গেছেন। গানে বেঁধেছেন। চিত্রশিল্পীরাও ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন শিউলিকে। রবীন্দ্রনাথের শরৎ ঋতু পর্যায়ের একটি গানের পঙিক্ত—
‘ওলো শেফালি, ওলো শেফালি,
আমার সবুজ ছায়ার প্রদোষে তুই জ্বালিস দীপালি।।
তারার বাণী আকাশ থেকে তোমার রূপে দিল এঁকে
শ্যামল পাতার থরে থরে আখর রুপালি।।’
আর নজরুল গেয়েছেন,
‘তোমারি অশ্রু-জলে শিউলি-তলে সিক্ত শরতে,
হিমানীর পরশ বুলাও ঘুম ভেঙে দাও দ্বার যদি রোধি।’
শিউলি মাঝারি আকারের গাছ। ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু হয়। বাঁচে ৪০ থেকে ৫০ বছর। কিন্তু গাছের গোড়ায় পানি জমলে বা বানে ডুবলে মরে যায়। অল্প জায়গায়, দেয়ালের পাশে ভালো জন্মে। একটি শিউলিগাছ না থাকলে বাগান অপূর্ণ থাকে। সবুজ ঘাসের ওপর ঝরা শিউলি খুব সুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি করে। শরতের ভোরে বড়দের দেখাদেখি শিশুরাও শিউলি কুড়োতে খুবই উৎসাহী। শিউলি কুড়ানো ছোটদের জন্য খুব আনন্দের। পায়েস ও মিষ্টান্নে শিউলির বোঁটার রং ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকালে চীনের বৌদ্ধভিক্ষুরা এই রং দিয়ে তাঁদের চীবর (কাপড়) রাঙাতেন।
তোমরা হয়তো লক্ষ করোনি, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ঢাকায় শিউলি ফুটেছিল আষাঢ়ের শেষ দিনগুলোতে। এ ঘটনা বিরল। কিন্তু প্রকৃতিতে এ রকম ঘটে। এ বছরও শ্রাবণে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারে শিউলি ফুটেছিল। এটিও মনে রাখার বিষয়। বাংলাদেশ শিশু একাডেমীতে এ রকম এক গাছ ছিল। সেটি বছর দশেক আগে মরে যায়।
শিউলির তেতো রস স্বভাবতই অরুচিকর আর অপছন্দের। কিন্তু এ তেতো গুণে ভরপুর। শিউলির পাতা, ছাল, বীজ কবিরাজি ওষুধে খুব মূল্যবান। এগুলো আমবাত, পুরোনো জ্বর, মাথার খুশকি, পিত্ত ও কফরোগে উপকারী। আবার মেদ বাড়লে, কৃমিতে, গলা বসে গেলে, দাহরোগে, মূর্ছায়, খাদ্যে বিষক্রিয়ায়, পিপাসা রোগে, সাইটিকায় শিউলি ভালো ওষুধ। বোঝাই যাচ্ছে, রাজকন্যে আত্মত্যাগ করেও মানুষের উপকার করতে ভোলেননি।