আজ থেকে সাড়ে তিন শ বছরের বেশি কাল আগের কথা। বাংলাদেশে তখন সৃষ্টি হয়েছিল মহা অশান্তি। হঠাৎ করেই জনপদগুলোতে পড়ে যেত কান্নার রোল। এই কান্নার কারণ ছিল মিয়ানমারের আরাকানি ও পর্তুগিজ দস্যুরা। তারা যখন-তখন যেখানে-সেখানে হামলা চালিয়ে লুট করে নিয়ে যেত সবকিছু। শুধু কি তাই? গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিত তারা। কাউকে কাউকে দাস বানিয়ে বিক্রি করে দিত দূরদেশে। অন্যদের কেটে টুকরো টুকরো করত। প্রথম প্রথম আরাকান থেকেই আসত তারা, কিন্তু পরে চট্টগ্রাম দখল করে সেখানেই ঘাঁটি বানাল। দুর্বৃত্তদের আরেকটা ঘাঁটি ছিল সন্দ্বীপ নামের দ্বীপে। সেসব জায়গা থেকে জাহাজে চেপে বাংলাদেশের ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে এসে তারা চালাতে শুরু করল ধ্বংসলীলা। রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলা লাটে উঠল। তখন বাংলাদেশে চলছিল মোগল শাসন। আর রাজধানী ছিল ঢাকায়। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও মোগলরা কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল না তাদের। ফলে চট্টগ্রাম এলাকাটাও বাইরেই থেকে গিয়েছিল মোগল শাসনের।
এই পরিস্থিতিতে বাংলার সুবাদার হয়ে এলেন শায়েস্তা খান। ঢাকায় এসেই তিনি সীমান্তের বিদ্রোহীদের ওপর কড়া নজর দিলেন। ঠিক করলেন, যেভাবেই হোক, পর্তুগিজ ও মগ দস্যুদের তিনি দমন করবেন। তাই প্রথমে তিনি সন্দ্বীপ দখল করলেন এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৬৬৬ সালে দখল করলেন চট্টগ্রাম। পর্তুগিজদের কৌশলে বশ করলেন, আর মগদের দেশছাড়া করে ছাড়লেন। রাজ্যে ফিরে এল শান্তি।
শায়েস্তা খানের আসল নাম ছিল মির্জা আবু তালিব। কিন্তু সেই আসল নামটা একসময় হারিয়ে গেল উপাধির আড়ালে। উপাধিটিই হয়ে উঠল নাম। সেই নামটা ছিল রুকুনুস সুলতান আমির-উল-উমারা নবাব শায়েস্তা খান।
সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন তাঁর ফুফা এবং সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ছিলেন তাঁর ফুফু। আর তাঁর দাদা ইতিমাদেদৗলা ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের উজির। সম্রাট শাহজাহান ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতি এবং সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহল ছিলেন তাঁর বোন। আর সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন তাঁর ভাগনে। তাঁর বাবা আসফ খান ছিলেন শাহজাহানের উজির। শাহজাহান তাঁকে শায়েস্তা খান উপাধি দিয়েছিলেন এবং আওরঙ্গজেব তাঁকে আমির-উল-উমারা, অর্থাৎ অভিজাতদের প্রধান করেছিলেন।
শায়েস্তা খান যে একজন ন্যায়পরায়ণ পতি, বিচক্ষণ, উদার ও দৃঢ়চেতা শাসক ছিলেন, তা আমরা জানি। কিন্তু এ কথা অনেকেরই অজানা যে তিনি একজন কবি ছিলেন। মোগল আমলে যতজন সুবাদার ঢাকায় থেকে রাজত্ব করেছেন, তাঁদের মধ্যে তাঁকেই সেরা বলে মানা হয়।
শায়েস্তা খানের আমলে বাংলাদেশে জিনিসপত্র খুব সস্তা ছিল। এই দেশ দেখার জন্য ইউরোপ থেকেও পর্যটকেরা আসতেন। সেই ১৬৬৬ সালে ঢাকায় এসেছিলেন বিখ্যাত এক ফরাসি পর্যটক, নাম তাঁর জ্যাঁ ব্যাপ্টিস্ট টাভারনিয়ার। একই সময়ে ফ্রান্সিস বার্নিয়ার নামে আরও একজন ইউরোপীয় পর্যটক বাংলায় এসেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, বাংলা হলো প্রাচুর্যের দেশ। সেখানে সবকিছুরই প্রাচুর্য। খাবারদাবার প্রায় বিনা মূল্যে বিকোতে দেখেছিলেন তিনি। টাকায় কুড়িটি বা তার চেয়ে বেশিসংখ্যক মোরগ ও হাঁস বিক্রি হতে দেখেছিলেন। বাংলা তখন ছিল সবচেয়ে দামি রেশমি ও সুতি কাপড়ের ভাণ্ডার।
টাভারনিয়ার ঢাকাসহ বাংলাদেশের অনেক জায়গা ভালোভাবে ঘুরেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুতি ও মসলিন কাপড় এখানে তৈরি হয়। কাপড় ছাড়াও চিনি, স্ফটিক, প্রবাল, ভোঁদড়ের চামড়া, শাঁখের চুড়ি, চাল প্রভৃতি রপ্তানি হতো নানান দেশে। আর এক টাকায় পাওয়া যেত আট মণ চাল। এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়ার সুবাদেই শায়েস্তা খানের আমলকে সবাই সস্তার আমল বলে।
শায়েস্তা খানের আমলের পাকারতলী প্রাসাদ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাবুবাজার ঘাট এলাকায় একটা মসজিদ, নহবতখানার ভিত্তি ও একটি দালান টিকে ছিল বলে বাডলি বার্টের বর্ণনা থেকে জানা গেছে। লালবাগের কেল্লা তিনিই তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। আসলে শায়েস্তা খানের আমল ছিল ঢাকার তথা বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় যুগ। তিনি দুই দফায় বাংলার সুবাদার ছিলেন। প্রথম দফায় ১৬৬৩ থেকে ১৬৭৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর ঢাকায় থেকে শাসনকাজ চালান। দ্বিতীয় দফায়ও ১৬৮০ থেকে ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮ বছর তিনি সুবাদার হিসেবে ঢাকায় ছিলেন। অর্থাৎ মোট প্রায় ২২ বছর তিনি বাংলার সুবাদার হিসেবে ঢাকায় ছিলেন।
লালবাগের কেল্লার বিস্ময়কর স্থাপত্য পরিবিবির মাজার তৈরি করেছিলেন শায়েস্তা খান। তিনি একটি সিংহদুয়ার তৈরি করেছিলেন ঢাকায়। সেটি পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় অবস্থিত ছিল বলে জানা যায়। ছোট কাটারার প্রাসাদ তাঁর আমলেই (১৬৬৩-১৬৬৪ খ্রি.) তৈরি হয়েছিল। বুড়িগঙ্গার ধারে হাকিম হাবিবুর রহমান লেনে এই মস্ত প্রাসাদটি অবস্থিত। চকবাজার মসজিদও (১৬৭৬ খ্রি.) শায়েস্তা খানের সময়কারই কীর্তি। তাঁর আমলে ঢাকায় বহু ইমারত-অট্টালিকা ও পথঘাট তৈরি হয়েছিল। তবে সব কটির নির্মাণসাল জানা যায়নি। কারণ, সব কটিতে বিবরণসমৃদ্ধ শিলালেখ পাওয়া যায়নি। নির্মাণরীতি দেখে বোঝা যায় যে সেগুলো তৈরি হয়েছিল শায়েস্তা খানের আমলে। যেমন মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদের সাতগম্বুজ মসজিদ।
শায়েস্তা খানের আমলের ইমারত নির্মাণের বিশেষ রীতি বা স্টাইলকে এখন বলা হয় শায়েস্তা খানি রীতি। ব্রাডলি বার্টের লেখা থেকে জানা যায় যে শায়েস্তা খানের আমলে শহরতলিসহ ঢাকা শহরের এলাকা টঙ্গী পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। তাই সবকিছু বিবেচনা করলে দেখা যায়, শায়েস্তা খানের আমলই ছিল বাংলায় মোগল যুগের শ্রেষ্ঠ সময়।