: ভিজবি?
: নাহ্।
: ক্যান?
: এই বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকবে না।
: থাকবে। দেখ, কেমন কালো হয়েছে আকাশ। মেঘও ডাকছে জোরে জোরে।
: হবে না দেখিস। বেশি কালো হলে এরপর আর বেশি জোরে বৃষ্টি হয় না।
: আন্দাজে!
কয়েক মুহূর্ত পরই বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল টুপটাপ। একটা… দুইটা…শত শত! পরস্পরের দিকে তাকাল দুই বন্ধু।
: দৌড়া!
একছুটে তারা ঢুকে পড়ল সবচেয়ে কাছের বিল্ডিংটায়। বেশ জোরেশোরেই নেমেছে বৃষ্টি। রাস্তার গরম পিচ আর বৃষ্টির ফোঁটা তৈরি করেছে সেই মনমাতানো ঘ্রাণ, যা শুধু বৃষ্টি নামার প্রথম কয়েক মিনিটই স্থায়ী হয়। এলাকার একেকটা বিল্ডিং থেকে ‘ইয়ে...বৃষ্টি নামসে’ বলে হই হই করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে ধুপধাপ লাফিয়ে নামছে ছেলেমেয়েরা। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগতেই তারা হেসে উঠছে অকারণে। ছোট মেয়েগুলো খুশিতে দিশেহারার মতো ছুটছে এদিক–ওদিক। বাজ পড়ার বিকট আওয়াজে ক্ষণে ক্ষণে চমকে ওঠার আনন্দ হাসি বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের।
: কী রে? চল, ভিজি।
: তুই যা। ধোয়া কাপড়টা ময়লা হলে আম্মা বকবে।
: গাধা! থাক তুই। গেলাম আমি!
আশ্রয় নেওয়া বিল্ডিং থেকে ছুটে ঝুমবৃষ্টির ভেতরে ঢুকে গেল বন্ধু। বৃষ্টি একেবারে গিলে নিল তাকে।
বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বাইরে আসা মানুষের সংখ্যা। খালি গায়ে সাবান মাখতে মাখতে বেরিয়েছেন লুঙ্গি পরা মুরব্বিরা। মাথায় মাখা সাবানের ফেনা ঘাড়, গলা হয়ে ঝরনার মতো নেমে গেছে ভুঁড়ি বরাবর। বৃষ্টিতে ভিজে ঢিলা হয়ে গেছে লুঙ্গির গিঁট। কিছুদূর হেঁটে সেই গিঁট শক্ত করার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
: দোস্ত, এই বৃষ্টি আর পাবি না! আয়!
বন্ধুর এই ডাকই দ্বিধা কাটাতে যথেষ্ট। ধোয়া কাপড়, টনসিলের ব্যথা, জ্বরের শঙ্কা কিংবা মায়ের বকা—সব ভুলে ছুটে গেল সে-ও।
বারান্দায় তখনো উদাস কিছু বৃষ্টিদর্শক। তিনতলায় গ্রিল ধরে নিচে তাকিয়ে থাকা ছেলেটার মনেও দ্বিধা। একটু আগেই গোসল সেরেছে সে। গোসলের পরই সব সময় কেন ঝুমবৃষ্টি হয়, এ নিয়ে হালকা অভিমান তার মনে। হঠাৎ পানি জমে যাওয়া রাস্তা ধরে বন্ধুদের আসতে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল তার। ‘এই, খবরদার বৃষ্টিতে ভিজতে যাবি না’, মায়ের চিৎকারটাকে পেছনে রেখেই একছুটে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল সে। ‘আজকে আয় বাসায়, ঢুকতে দেব না’, এ কথা যখন চেঁচিয়ে বলছেন মা, ততক্ষণে লাফিয়ে নিচে নেমে গেছে ছেলে।
আরও একজনকে নামতে দেখেই হই হই করে উঠল বাকিরা!
: আরে, অনেক বৃষ্টি তো!
: হ্যাঁ। চোখ বন্ধ করে ওপরে মুখ পেতে দাঁড়া, সুইয়ের মতো ফুটবে দেখবি। মজা!
তিনজন চোখ বন্ধ করে মুখ তুলে রাখে আকাশের দিকে। বেশিক্ষণ থাকা যায় না এভাবে। হঠাৎ ঠান্ডা বাতাসে গা কেঁপে ওঠে ওদের।
: চল দৌড় দিই। ঠান্ডা কম লাগবে।
: দৌড় দিলে কিন্তু চাপা ব্যথা করে।
: আসলেই?
: হুঁ।
: তাইলে চল দৌড় দিই।
রাস্তা ধরে তিনজন ছুটতে থাকে, অযথাই। পেরিয়ে যায় ভিজতে থাকা লাজুক আন্টির দল, জড়সড় তরুণী, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ, রাস্তায় হঠাৎ থামা রিকশার ভেতরে গুটিসুটি দিয়ে বসে থাকা রিকশাচালক, ব্রেক ফেল করে ড্রেনে পড়ে যাওয়া সাইকেল।
ছুটতে ছুটতে তিনজনে চলে আসে মাঠে। মাঠ ততক্ষণে পানিতে ভরে উঠেছে। ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে গেছে ছেলেরা। বৃষ্টিভেজা মাঠে ফুটবল খেলার মতো আনন্দের কোনো তুলনা হয় না। ওরা ঢুকে গেল কোনো একটা দলে। কে কোন দলে বোঝার উপায় নেই। সবাই ছুটছে বলের পেছনে। কাদায় আছাড় খাচ্ছে বারবার। বল রেখে পিছলে পোস্টে ঢুকে যাচ্ছে স্ট্রাইকার। ডিফেন্স ভুলে কাদাপানি ছিটাচ্ছে ডিফেন্ডার। গোলকিপার স্যান্ডেলের বার তুলে নিয়ে ছুটে পালাচ্ছে গোল বাঁচাতে। নিয়মের কোনো বালাই নেই।
কোত্থেকে টেনিস বল জোগাড় করে বোম বাস্টিং খেলছে একদল ছেলে। ছুটে গিয়ে কাদায় পিছলে কে কত দূর যেতে পারে, সেই খেলাও খেলছে কয়েকজন। ভিজে ভিজে হাঁটতে থাকা একদল তরুণ কথা বলছে ওপেনিংয়ে তামিমের সঙ্গী কে হবে, লিটন না সৌম্য, তা নিয়ে। মাঝেমধ্যে বিকট শব্দে মেঘ ডেকে দ্বিমত প্রকাশ করছে তাদের সঙ্গে, কেউ পাত্তা দিচ্ছে না।
ক্লান্ত বৃষ্টির গতি কমে আসছে। বিল্ডিংগুলোর সানশেডের ফুটো দিয়ে কলের মতো পানি পড়ছে। ছাতা মাথায় কিছু মুরব্বি কাঠির গুঁতোয় পরিষ্কার করছেন সানশেডের পানি আসার পথ। ছেলেমেয়েদের ঘরে ফেরাতে ছুটে আসছেন মায়েরা। ভয় না পেয়ে উল্টো দিকে ছুটছে ছেলেরা। তারাও জানে, মায়েরা দৌড়ে ধরতে পারবে না তাদের। কিছু কিছু ভালো ছেলে কাঁপতে কাঁপতে ধরছে বাড়ির পথ। মায়ের ভয়ে না ঠান্ডায়, তা বলা কঠিন।
কোনো কোনো ছাদ থেকে জলপ্রপাতের মতো পড়ছে বৃষ্টিতে জমা পানি। কাদামাখা শরীর, জামাকাপড় সেই পানিতে ধুয়ে নিচ্ছে ছেলেরা।
: বাসায় গেলে যে মার খাব আজকে!
: খেলাম না হয়!
: বিকেলে নিচে নামতে দিলে হয়!
: মাঠে তো পানি, খেলা হবে আজকে?
: শর্টপিচ খেলব।
ভেজা কাপড় নিয়েই বাড়ির পথ ধরে সবাই। সিঁড়িজুড়ে ভেজা পায়ের ছাপ চলে গেছে বিভিন্ন তলায়। দরজাটা আলতো করে খুলে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে যায় একেকজন। মায়েদের চড়া গলা পাওয়া যায়,
: এইবার খালি যদি জ্বরটা আসে, আমি কিন্তু দেখব না। তখন বুঝিস।
বৃষ্টি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মেঘরা যেমন ডাকতেই থাকে, মায়েরাও তেমনি শ্রোতা ছাড়াই কথা বলে চলে একাই। মেঘের ডাকের মতো মায়েদের এই হুমকিতেও পাত্তা দেয় না কেউ।