বাংলা ভাষা প্রচুর ইংরেজি শব্দ বাংলা করে নিয়েছে। তারপরও চার থেকে সাড়ে চার হাজারের বেশি ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষায় পাওয়া যায়। কোনোটার অবয়বের একটু এদিক-ওদিক হয়েছে। যেমন হসপিটাল হয়েছে হাসপাতাল। আবার কোনোটা পুরো ইংরেজিই রয়ে গেছে। যেমন টেলিফোন, টেলিভিশন। কোনোটা বদলেছে, সেই সঙ্গে অর্থও পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন জেনারেল হয়েছে জাঁদরেল। বাংলা ভাষায় বসবাস করা ইংরেজি শব্দের অনেকগুলোর রয়েছে নানান বৃত্তান্ত, নানান ইতিহাস। অভিধানের গল্পতে সেসব নিয়েই কিছু কথা।
ম্যাগাজিন
সাময়িক পত্রিকা, পাঁচমিশালি বিষয় নিয়ে কোনো টিভির অনুষ্ঠান, কার্তুজের কুঠরি, অস্ত্রভান্ডার ইত্যাদি বিষয়কে বাংলায় ম্যাগাজিন বলা হয়। ম্যাগাজিন শব্দটা ইংরেজি। বাংলায় সম্ভবত এর জুতসই কোনো প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শব্দটা তাই ইংরেজিই রয়ে গেছে।
আসলে শুধু বাঙালিই নয়, জুতসই প্রতিশব্দ ইংরেজরাও খুঁজে পায়নি। এমন কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে ম্যাগাজিন শব্দটি ইংরেজিও নয়। শব্দটিকে তারা আত্মসাৎ করে নিয়েছে। ইংরেজরা বিদেশি শব্দের উচ্চারণ পাল্টাতে মহা ওস্তাদ। তাই ম্যাগাজিন শব্দটা অন্তত যে ইংরেজি নয়, তা বুঝতে যথেষ্ট মাথা ঘামাতে হয়।
আসলে ইংরেজি ম্যাগাজিন শব্দটি আরবি মাখজান শব্দের উচ্চারণ বিকৃতিমাত্র। বাংলা ভাষা শব্দটিকে ইংরেজি থেকে নিয়েছে বলে উচ্চারণ বিকৃতির দায় তাকে বহন করতে হয় না। কিন্তু মূল মহাজনের নাম ভুলতে হয়।
আরবি মাখজান শব্দের অর্থ হলো ভান্ডার। ইংরেজরা শব্দটিকে সামরিকীকরণের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করেছিল। অর্থাৎ ম্যাগাজিন বলতে তারা বোঝাত অস্ত্রপাতি, গোলাবারুদ ইত্যাদির ভান্ডার এবং রাইফেল, রিভলবার, মেশিনগান ইত্যাদির কার্তুজ-কুঠরি।
১৭৩১ সালে ম্যাগাজিন শব্দটি নতুন এক তাত্পর্য লাভ করে। আর সেটি ঘটে ব্রিটেন থেকে The Gentle Mans’s Magazin নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের সূত্রে। পত্রিকাটির সম্পাদক প্রথম সংখ্যাতেই জানিয়ে দেন—এটি অস্ত্রভান্ডার নয়, এটি হলো জ্ঞানবিজ্ঞানের তথ্যভান্ডার। প্রতি মাসে এ ভান্ডারে অজ্ঞানতা বিনাশকারী বিবিধ অস্ত্র জমা হতে থাকবে। আর সে জন্যই এটির নাম ম্যাগাজিন রাখা হলো।
বলা বাহুল্য, বাংলার ম্যাগাজিন শব্দ ইংরেজি ম্যাগাজিন শব্দের সব অর্থই বহন করে চলেছে।
অ্যালবাম
অ্যালবাম শব্দটি ইংরেজি হলেও এখন তা বাংলা শব্দের মতোই। বাংলায় এর যথার্থ প্রতিশব্দ নির্ণয় করাটা বেশ মুশকিল। তাই সে চেষ্টা বাদ দিয়ে আমরা অ্যালবাম শব্দটিকে এখন বাংলা শব্দভান্ডারের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছি।
বাংলা ভাষা অ্যালবাম শব্দটি নিয়েছে ইংরেজি থেকে। ইংরেজরা তা ধার করেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে। তাই, শব্দের মালিকানা নিয়ে টানাটানি না করাই ভালো।
ইংরেজিতে অ্যালবাম বলতে বোঝায় আলোকচিত্র, হস্তলিপি, ডাকটিকিট, নানান দেশের মুদ্রা ইত্যাদি রাখার জন্য বাঁধানো বিশেষ ধরনের খাতা। আবার, একই গায়ক-গায়িকার সংগীতসংবলিত লং প্লেয়িং রেকর্ডকেও অ্যালবাম বলা হয়।
বাংলা অ্যালবাম ইংরেজি অ্যালবামের সব অর্থই গ্রহণ করেছে। বাংলায় অবশ্য অ্যালবাম শব্দের কাব্যিক ব্যবহারও রয়েছে? যেমন স্মৃতিকথা জাতীয় বইয়ের নাম ধূসর অ্যালবাম, স্মৃতির অ্যালবাম।
অ্যালবাম শব্দটি ল্যাটিন Albus থেকে তৈরি। শব্দটির অর্থ হলো সাদা। প্রাচীন রোমে জনসাধারণের উদ্দেশে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তি শহরের মাঝখানে রাখা সাদা প্রস্তরফলকে লিখে দেওয়া হতো। লিখিত এই প্রস্তরফলকের নাম ছিল অ্যালবাম।
জাঁদরেল
বাংলা অনেক কিছুই জাঁদরেল হয়। যেমন জাঁদরেল লোক, জাঁদরেল মহিলা, জাঁদরেল মেজাজ, জাঁদরেল ব্যাপারস্যাপার, জাঁদরেল অভিনয় কিংবা অভিনেতা ইত্যাদি। বাঙালি সমাজে জাঁদরেল ব্যক্তির একটি নির্দিষ্ট চিত্র ও অবস্থান রয়েছে। চেষ্টা করলেও সবার পক্ষে জাঁদরেল হওয়া সম্ভব নয়। প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও বিরলকেশ, হালকাপাতলা দেহ, মোলায়েম বা মিহি কণ্ঠবিশিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে আর যা-ই হোক বাঙালি কখনো জাঁদরেল বলবে না।
জাঁদরেল হতে হলে দশাসই চেহারা লাগে, বাজখাঁই গলা লাগে, পোশাকআশাক পরার ভঙ্গি লাগে। সেই সঙ্গে আরও লাগে গুরুগম্ভীর মেজাজ ও দৃঢ় চরিত্র। জমাট গোঁফে জাঁদরেলকে আরও বেশি মানানসই মনে হয়।
মজার ব্যাপার, চেহারাসুরত ঠিকমতো থাকা সত্ত্বেও বাঙালি কিন্তু কোনো দিন কোনো দুর্বৃত্ত বা চরিত্রহীনকে জাঁদরেল বলবে না। বাঙালি জাঁদরেল লোক দেখে ক্রুদ্ধ বা ক্ষুব্ধ হয় না, মুগ্ধ হয়। বাঙালি জাঁদরেল পুরুষ বা মহিলাকে সামনে নয়, আড়ালে জাঁদরেল বলে।
জাঁদরেল শব্দটি চেহারায় বাংলা হলেও আসলে তা ইংরেজি শব্দ। ইংরেজি জেনারেল (General) শব্দটি হিন্দি জবানে ঘুরপাক খেয়ে বাংলায় এসে জাঁদরেল হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে সাধারণ মানুষজন অতিদূর থেকে ইংরেজি জেনারেলকে দেখে যে ভাবনায় ভাবিত হয়েছে তারই বিমূর্ত প্রকাশ হলো জাঁদরেল শব্দটি।
লাট
ভারতবর্ষে একদা বড় লাট, ছোট লাট, জঙ্গি লাট প্রমুখ লাটগণ শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। এঁরা ছিলেন শাসক রাজপুরুষ। ভারতবর্ষে তখন ইংরেজ রাজত্ব।
লাটগণ সবাই ইংরেজ ছিলেন। অন্য ইংরেজদের কাছে তাঁরা লাট ছিলেন না। তাঁরা লাট ছিলেন বাঙালিদের কাছে। গভর্নর জেনারেল ছিলেন বড় লাট, লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছোট লাট এবং আর্মি জেনারেল জঙ্গি লাট।
লাট শব্দটি বস্তুত ইংরেজি লর্ড (Lord) শব্দের উচ্চারণ বিকৃতি। লর্ড প্রথমে ছিল লার্ড। পরে তা লাটে রূপান্তরিত হয়। এই লর্ড শব্দটি আদালতের মাই লর্ড নয়, এটি অভিজাত ইংরেজদের উপাধি, যা দিতেন ইংল্যান্ডের রাজা বা রানি।
ভারতের সব গভর্নর জেনারেলই ছিলেন লর্ড উপাধিধারী। লেফটেন্যান্ট গভর্নর ও জেনারেলদের প্রায় সবাই লর্ড ছিলেন। বাঙালিদের মুখে এঁরা ছিলেন লাট বাহাদুর বা লাট সাহেব।
মজার ব্যাপার, ইংরেজ রাজত্বকালেই বাংলায় শব্দটির অধঃপতন ঘটে। কালে কালে বাঙালির মুখে শব্দটি ব্যঙ্গার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। যেমন ‘কোথাকার লাট বাহাদুর এলেন রে’, ‘ভারি আমার লাট সাহেব এসেছেন’, ‘কত লাট বেলাট দেখলাম’ ইত্যাদি। সম্মানিত লাট শব্দ দিয়ে বাঙালি এখনো তার মনের ঝাল মিটিয়ে থাকে। বাংলা ভাষায় লাট শব্দটা আর কখনো জাতে ওঠেনি।