সালটার কথা মনে আছে—১৯৭৯। আমি তখন পশ্চিম জার্মানিতে। তখনো দুই জার্মানি এক হয়নি। সেই তখনই এক দিন আমার বাসায় দাওয়াত করি আমার বন্ধুস্থানীয় এক পর্তুগিজ দম্পতিকে। তাদের খুব শখ আমাদের বাংলাদেশি খাবার খাওয়ার। বন্ধু দম্পতির জন্য প্রচুর আহারের আয়োজন করি। ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পর তারা সোজা বিছানার ওপরে উঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসে। গ্রীষ্মকাল। একটু গরম গরম লাগছিল। পর্তুগিজ বন্ধু আমাকে ঘরের বন্ধ জানালাটা খুলে দিতে বলে। জানালা শব্দটা বলতে গিয়ে সে ‘জানেলা’ উচ্চারণ করে। শব্দটা শোনামাত্রই তাকে আমি ধরে বসি, ‘দোস্ত, তুমি বাংলা শিখলে কবে থেকে?’
সে অবাক হয়ে বলে, ‘বাংলার মাথামুণ্ডু আমি কিস্সু জানি না।’
‘তাহলে তুমি যে “জানেলা” বললে!’
‘ওটা তো আমাদের ভাষার শব্দ।’
এতক্ষণ আমাদের কথা হচ্ছিল জার্মান ভাষায়। হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ে যায়, আরে, পর্তুগিজরা তো আমাদের দেশে গিয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ব্যবসা বাণিজ্য, তারপর ধর্মপ্রচার সূত্রে বহুকাল তারা আমাদের ভারত উপমহাদেশে ছিল। ছিল অবিভক্ত বঙ্গের দুই অংশেই। আমি ঘরে থাকা বাংলা অভিধান খুলে বসি। পাতা উল্টে ‘জানালা’ শব্দটা বের করি। দেখি, শব্দটার উত্স পর্তুগিজ। ‘জানেলা’ (Janella) থেকে ‘জানালা’। কীভাবে একটা বিদেশি শব্দ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে! জানালার পরিবর্তে আমরা আর খাঁটি বাংলা শব্দ ‘বাতায়ন’ বা ‘গবাক্ষ’ ব্যবহার করি না। কেবল পড়ি পাঠ্যবইয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ‘বাতায়নপাশে গুবাক তরুর সারি’।
শব্দ আমাদের কত রকমভাবেই যে ভাবায়! যেমন ‘সড়ক’ শব্দের কথাটাই ধরা যাক। আরবি ‘শরক’ শব্দ থেকে শব্দটার উৎপত্তি। সংস্কৃতেও শব্দটা পাই। বানান ভিন্ন—‘সরক’। বানানের হেরফের শব্দটাকে উচ্চারণগত হেরফেরের ভেজালে ফেলে দিচ্ছে। আবার ‘পথ’ শব্দটাও বাংলা। ইংরেজিতে সেটাই হয়ে গেছে ‘পাথ’ (Path)। ‘পথ’ আর ‘পাথ’-এর মধ্যে মাত্র একটা আ-কার উচ্চারণগত ভিন্নতা এনে দিয়েছে। উৎপত্তিস্থল থেকে সরতে সরতে মূল শব্দের হেরফেরের নমুনা দিতে গেলে শেষ হবে না। যেমন, আমরা সারা দেশে ‘পানি’-কে ‘পানি’ বলি। কিন্তু নোয়াখালী জেলার বৃহত্তর অংশে সেটা ‘হানি’। চট্টগ্রামের কোথাও কোথাও তা ‘ফানি’। একইভাবে ‘রাস্তা’ শব্দটা এসেছে ফারসি থেকে। সংস্কৃতে শব্দটা ‘রথ্যা’। আবার ইংরেজি ‘রোড’ (Road) শব্দের প্রায় কাছাকাছি ‘রাস্তা’। অন্তত ইংরেজি অক্ষর ‘জ’ এবং বাংলা অক্ষর ‘র’ দিয়ে ‘রোড’ এবং ‘রাস্তা’র শুরু। কারণটা কী? কারণ আর কিছুই নয়, বিশাল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত যে আমরা। একই শব্দ স্থান থেকে স্থানান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে গিয়ে কতটা যে বাঁক ফেরে, মূলেরও ছাপ রেখে যায়, মোচড় খায়, অর্থেরও হেরফের ঘটায়, উদাহরণ দিতে গেলে তার শেষ হবে না।
আরও একটা শব্দের কথা বলি। শব্দটা আমাকে খুবই ভাবিয়েছে। এখনো ভাবায়। বাংলা শব্দ ‘শ্লথ’-এর অর্থ ঢিলে, শিথিল। ইংরেজি শব্দ ‘শ্লথ’ (Sloth)-এর অর্থ হচ্ছে অলসতা, ঢিলেমি। অভিন্ন অর্থ। ইংরেজি শব্দটার উৎপত্তির মূলে দক্ষিণ আমেরিকার একটা জন্তু। ডালে ঝুলে থাকে, যার চলার গতি খুবই মন্থর। বস্তুর ক্রিয়া থেকেই শব্দটার উৎপত্তি। শুদ্ধ বাংলা অভিধানে কিন্তু ‘শ্লথ’ নামের এই জন্তুটার কথার উল্লেখ নেই। শব্দটা তাহলে কীভাবে এল বাংলা ভাষায়? ভাবনার কথাই বটে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, বিশ্বের প্রধান-অপ্রধান প্রায় বেশির ভাগ ভাষায় মাতৃ ও পিতৃবাচক শব্দের উচ্চারণ কোনোটা প্রায় অভিন্ন, কোনোটা প্রায় কাছাকাছি। ‘ম’ বা ‘মা’ কিংবা ‘প’, ‘ফ’ ‘পে’, ‘পি’ দিয়ে সেগুলোর প্রতিটির শুরু। বাংলা ‘মানব’ শব্দেরও উচ্চারণ বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষার একই অর্থের শব্দের উচ্চারণের একেবারেই কাছাকাছি।
একটা খুব মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করছি আজকের লেখা। আমরা যারা ইতিহাসসচেতন, তারা জানি যে আমাদের এই উপমহাদেশ থেকেই বৌদ্ধধর্ম বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল ষষ্ঠ কী সপ্তম শতাব্দীর দিকে। কিন্তু মধ্য আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এই ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টধর্মেরও আগে। গুয়াতেমালা দেশটির নাম কীভাবে হয়েছে জানো? দুটি শব্দের সমাহারে। ‘গৌতম’+‘মালা’ (গৌতমবুদ্ধ ও ফুলের মালা) শব্দ দুটির যোগে হয় প্রথমে ‘গৌতমমালা’। অর্থাৎ গৌতমবুদ্ধকে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় যে দেশে, সামান্য অপভ্রংশে সে দেশের নাম হয়েছে শেষ পর্যন্ত গুয়াতেমালা। সোজা কথায়, ‘গৌতমমালা’ থেকে ‘গুয়াতেমালা’। অবশ্য গুয়াতেমালায় এখন খ্রিষ্টধর্মের প্রাধান্য। কিন্তু দেশটির নামের হেরফের এখনো হয়নি।
যা-ই হোক, আজ এ পর্যন্তই। ভাষা নিয়ে, শব্দ নিয়ে যতই ভাববে, ততই মজা পাবে। শুধু মজাই পাবে না, এ ভাবনাও মনে জাগবে যে ভাষা ও শব্দের সাগরে ডুবতে হলে সাঁতারও জানতে হবে। না হলে ডুবে যাওয়ার শঙ্কা প্রায় শতভাগ। থুক্কু, বালাইষাট, ডুববে কেন? ভাষা ও শব্দের সাগরে ডুবতে যারা জানে, তারা ভাষার সাগর হয়। তুমিও এক দিন ভাষার সাগর হবে।