বাদ্যের তালে তালে নাচছেন বলী (কুস্তিগির)। হেলেদুলে রিংয়ের (মঞ্চ) দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তারপর মুখোমুখি। তুমুল উত্তেজনা দর্শকদের মধ্যে। শিশু-কিশোর, ছেলে-বুড়ো সবার মুখে হর্ষধ্বনি আর টেনশন। এর মধ্যে এক বলী ফেলে দিলেন অপরজনকে। রেফারি হাত উঁচিয়ে ধরে ঘোষণা করলেন বিজয়বার্তা।
এটি স্পোর্টস চ্যানেলের সৌজন্যে দেখা ডব্লিউডব্লিউএফের কোনো দৃশ্য নয়। এই দৃশ্য চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের। শতবর্ষ ধরে প্রতিবছর এই দৃশ্য দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসেন অনেকে। এই প্রতিযোগিতার নাম আবদুল জব্বার স্মৃতি বলীখেলা। প্রতিবছর ১২ বৈশাখ এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়। এবার হয়ে গেল এই প্রতিযোগিতার ১০৬তম আসর।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে বকশিরহাট এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর লালদীঘি মাঠে এই বলীখেলার প্রবর্তন করেছিলেন। সেই থেকে তাঁর নামেই এই খেলার নামকরণ করা হয়।
বলীখেলা উপলক্ষে প্রতিবছর তিন দিনব্যাপী এখানে বসে মেলা। মেলায় গৃহস্থালির বিভিন্ন সামগ্রী থেকে শুরু করে কী না পাওয়া যায়! দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা তাঁদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসেন। প্রায় চার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে এই মেলা।
শিশু-কিশোরদের খেলনা, গৃহসজ্জার জিনিস, তৈজসপত্র, ঝাড়ু, খুন্তি, কুড়াল, আসবাবপত্র, গাছপালা, কী নেই এই মেলায়! তবে মেলাকে ছাপিয়ে সামনে চলে আসে বলীদের ‘যুদ্ধ’। প্রতিবছর শ খানেক বলী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসেন। নিজ দায়িত্বে তাঁরা এসে খেলায় অংশগ্রহণের জন্য নাম দেন। এঁদের মধ্যে তরুণ, যুবক যেমন থাকেন, তেমনি বৃদ্ধ ও কিশোরও দেখা যায়।
এবার সত্তরোর্ধ্ব বলীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নূরুচ্ছাফা, শহীদ ও মফিজ বলী। তরুণদের মধ্যে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফাহাদ ও মিজানের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। প্রতিবার বেশ কয়েকজন কিশোরকেও দেখা যায় নিজেদের মধ্যে বলী খেলতে।
তাঁদের সবারই মত, নেশার টানে ছুটে আসেন বলী খেলতে। প্রতিবছর এই দিনে তাঁরা যেখানেই থাকুন না কেন, বলীখেলায় আসতেই হবে। এই যেমন এবারের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন রামুর দিদার বলী। ২০০১ সাল থেকে তিনি জব্বারের বলীখেলায় অংশ নিচ্ছেন। প্রথম দিকে কেবল একটি মেডেল দেওয়া হতো। কয়েক বছর ধরে পুরস্কার হিসেবে ট্রফির পাশাপাশি টাকাও দেওয়া হচ্ছে। তবে একজন বলী হয়ে উঠতে এই টাকা খুব নগণ্যই।
দিদার বলী জানালেন, ‘আমি প্রতিদিন দেশি মুরগি, ডিম ও দুধ খাই। প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা খরচ আছে। নিজেদের ব্যবসা আছে, তাই শখের বশে এই খেলা খেলি। প্রতিবছর চলে আসি খেলায়।’
দিদার এ পর্যন্ত ১০ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন জব্বারের বলীখেলায়। গত ২৫ এপ্রিল লালদীঘি মাঠে মাইকে যখন দিদারের নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল, তখন উপস্থিত দর্শকেরা হর্ষধ্বনির পাপাপাশি করতালি দিয়ে উঠল। বাঁশের বেড়া ভেঙে দর্শকেরা আরও কাছাকাছি হতে চায় দিদার বলীর। তাই ফুটবলের মামুনুল, ক্রিকেটের তামিম কিংবা সাকিব-মুশফিকদের মতো জব্বারের বলীখেলারও সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন এই দিদার বলী।