সেই পাথরযুগের সূচনাকাল থেকেই মানুষকে পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। প্রথমে তার সংগ্রাম ছিল নিজের সঙ্গে। একা অসহায় মানুষ। নিজে কিছু উত্পাদন করতে পারত না। ক্ষুধা মেটানোর জন্য গাছের ফল পেড়ে খেত। পাখি, খরগোশের মতো ছোট ছোট প্রাণী ফাঁদ পেতে ধরত বা পাথর ছুড়ে মারত। এসবই ছিল তার খাদ্য। দিনে দিনে মানুষের সংখ্যা বাড়ে। তারা দলবদ্ধ হয়। নানা রকম পাথুরে অস্ত্র বানিয়ে শিকার করে বড় বড় পশু। এর মধ্যে আগুনের আবিষ্কার করে আদিকালের মানুষ। আগুনের যে শক্তি আছে, তা অনুভব করে। আগে একা একা মাটির গর্তে বা গাছের ডালে রাত কাটাত। এখন বড় দল পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় খোঁজে। বেশির ভাগ গুহা এর মধ্যে দখল করে রেখেছে হিংস্র পশু। এখন টিকে থাকার সংগ্রামে পশুদের তাড়িয়ে গুহা দখল করতে হবে। এ সময় আগুনের শক্তিকে কাজে লাগায়। আগুনের মশাল জ্বালিয়ে ছুড়ে দেয় গুহাতে। হিংস্র পশু পালিয়ে যায় গুহা থেকে। মানুষ দখল করে নেয় সেই গুহা। যুদ্ধের ইতিহাস এভাবেই তৈরি হয়। কখনো শিকারের অধিকার নিয়ে একদল মানুষ আরেক দলের সঙ্গে যুদ্ধ করত। কখনো যুদ্ধ করত দলের অধিপতি হওয়ার জন্য। এভাবে বেঁচে থাকার জন্য—টিকে থাকার জন্য আদিকাল থেকেই মানুষকে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
সভ্যতার যুগে এসে যুদ্ধের ইতিহাস আরও বড় হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের পৃথিবীতে। অনেক তাক লাগানো আবিষ্কার ও উদ্ভাবন হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের রাজা ও সম্রাটদের মনে কাজ করত রাজ্য জয়ের নেশা। ফলে রাজ্যের সীমা বাড়াতে অথবা বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে আয়োজন করত যুদ্ধের। এভাবে অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে।
আধুনিক বিশ্বে যুদ্ধের প্রয়োজন ও আয়োজন কিছুটা ভিন্ন হয়ে যায়। এই পর্বে ধীরে ধীরে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে রাজ্য থেকে সাম্রাজ্য গড়ার ধারণা পাল্টে যেতে থাকে। এ যুগে বিশ্বের বড় বড় শক্তিশালী দেশ নানা দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। প্রভাব বিস্তার করে এরা নানা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা পেতে চায়। বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্র একের পর এক মারাত্মক অস্ত্র তৈরি করছে। এমন অনেক রাষ্ট্র একে অপরের শত্রুও হচ্ছে প্রতিদিন। নিজেদের শক্তি বাড়াতে নিজ নিজ পক্ষে বাড়াচ্ছে বন্ধুরাষ্ট্র। এভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্র নানা উপলক্ষ নিয়ে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিপন্ন হচ্ছে মানুষ। অনেক সময় জোটবদ্ধ হয়ে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র দুই ভাগ হয়ে যায়। এভাবে অনেকগুলো রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত বৃহৎ পক্ষগুলো যদি একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন এমন যুদ্ধকে আমরা বলি বিশ্বযুদ্ধ। তেমন যুদ্ধ যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা একটু ভাবলেই বোঝা যাবে।
এমন দুটো ভয়ংকর আর মর্মান্তিক বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা হয়েছে বিশ্ববাসীর। যে যুদ্ধের পরিণতিতে লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। পঙ্গু হয়েছে বহু লাখ মানুষ। ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক নগর। যুদ্ধের কারণেই পৃথিবীর অনেক দেশ একে অপরের শত্রু হয়ে যায়। অর্থনৈতিকভাবে দারুণ ক্ষতির শিকার হয় বিভিন্ন দেশ। কষ্ট পায় সাধারণ মানুষ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে ১৯১৪ সালের ২২ আগস্ট। যুদ্ধের সূত্রে পৃথিবীর বড় রাষ্ট্রগুলো দুই পক্ষে ভাগ হয়ে যায়। একে অপরকে হারানোর জন্য ব্যবহার করতে থাকে মারাত্মক সব অস্ত্র। এক দিন দুই দিন নয়, টানা চার বছর চলতে থাকে এই ভয়ংকর যুদ্ধ। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর অবসান ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। ক্যাল্লোরের হিসাবে এই নভেম্বরে শত বছর পার হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। তাই আজ এই বিশাল পৃথিবীর অধিবাসী হিসেবে আমরা একটু ফিরে তাকাতে চাই। বুঝতে চাই যুদ্ধপাগল কিছুসংখ্যক মানুষ কেন উন্মাদ হয়েছিল ভয়ংকর খেলায়।
আসলে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার একটি প্রত্যক্ষ কারণ হয়তো ছিল। তবে সেটি একমাত্র কারণ নয় অমন ভয়ংকর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার। ছোট-বড় আরও অনেক কারণ হয়তো ইন্ধন দিয়েছে যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
একটি হত্যাকাণ্ডকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে ধরা হয়। এ সময় বসনিয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলছিল। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরির ভবিষ্যৎ রাজা ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করে আন্দোলনকারীরা। এ ঘটনার পরই বড় দেশগুলো দুই পক্ষ হয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। আসলে এর পেছনে অনেক রাষ্ট্রেরই নানা ক্ষেত্রে ক্ষোভ এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা রকম সুবিধা লাভের হিসাব ছিল। প্রথম যুদ্ধ শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে। একদিকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি আর অন্যদিকে সার্বিয়া। ধীরে ধীরে দুই পক্ষের সমর্থনে মোট ৩২টি দেশ জড়িয়ে যায়। মিত্র পক্ষে উল্লেখযোগ্য দেশ ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র আর অন্য পক্ষে ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া। এসব অনেক দেশের সঙ্গেই আগে থেকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল। এবার সুযোগ বুঝে এরা দুই পক্ষ হয়ে যায়। প্রথমে অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর জার্মানি রাশিয়া ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯১৭ সালে এসে যুদ্ধ আরও ভয়ংকর রূপ নেয়। এ বছর ৬ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এক দেশের বোমারু বিমান আরেক দেশে বোমা ফেলে। সমুদ্রে এক দেশের জাহাজ ডুবিয়ে দেয় অন্য দেশের ছোড়া টর্পেডো। মারা যেতে থাকে অসংখ্য মানুষ। অনেক দেশের অর্থসম্পদ ধ্বংস হতে থাকে।
চার বছর যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধরত দেশগুলো দিনে দিনে মারাত্মক সব অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার করতে থাকে। সাগরে, আকাশে ও স্থলে যুদ্ধ করার মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা যেন লেগে যায়। যুদ্ধের আগে থেকেই ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বেশ খ্যাতি ছিল। সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াত ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ক্রুজার, ক্রেসি, হগ এমনি নানা ধরনের যুদ্ধজাহাজ। ব্রিটিশ নৌবহরকে মোকাবিলার জন্য জার্মানি তৈরি করে ইউবোট। এটি একধরনের সাবমেরিন। পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো সাবমেরিন যুদ্ধ বলা যায় জার্মান ইউবোটগুলোই শুরু করে। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রথম পর্যায়েই ১০টি জার্মান ইউবোট ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির ওপর আক্রমণ করে। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে ইউবোট থেকে ছোড়া টর্পেডোর আঘাতে ব্রিটিশ ক্রুজার ‘পাথফাইন্ডার’ ডুবে যায়। এতে ২৫৯ জন ক্রুর সবাই মারা যান। এরপর আরও ইউবোট আক্রমণ হয়। ডুবে যায় অনেক ব্রিটিশ জাহাজ। এসব আক্রমণে প্রাণ হারান প্রায় দুই সহস্র ব্রিটিশ নাবিক।
আকাশযুদ্ধের মহড়াও চলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। তখনো এ সময়ের মতো অতসব নানা নামের ও ক্ষমতার যুদ্ধবিমান তৈরি হয়নি। ব্রিটিশ বিমান বহরের শৈশবও কাটেনি তখন। ১৯১৫ সালে জার্মান উদ্ভাবন করে ফেলে ‘ফকার’ নামে অধিক শক্তিশালী যুদ্ধবিমান। এই বিমান মিত্রবাহিনীর অনেক ক্ষতি করেছিল। ১৯১৭ সালে ভয়াবহ রূপ লাভ করে আকাশযুদ্ধ। এ সময় ধ্বংস হয় ব্রিটিশ বিমানবহরের ২৪৫টি বিমান। জার্মান হারায় তাদের ৬৬টির মতো বিমান।
বর্তমান সময়ে স্থল যুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর যুদ্ধযান ট্যাংক। এই ট্যাংক প্রথম ব্যবহৃত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধে ব্রিটিশরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এবার নতুন চিন্তা করে। ভাবে, কী করে কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে শত্রুর অঞ্চলে প্রবেশ করা যায় আর শত্রুপক্ষের মেশিনগানের গুলি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এই চিন্তা থেকেই তৈরি হয় ট্যাংক। প্রথম তৈরি ট্যাংকের নাম ছিল ‘উইলি’। একসময় ট্যাংকে বসানো হয় মেশিনগান।
এভাবে বিশ্বযুদ্ধ শুধু যুদ্ধকালেই রক্ত ঝরায়নি—মানবতাকেও ধ্বংস করে এবং এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর পৃথিবীর নানা যুদ্ধবাজ দেশ আরও সব মারাত্মক অস্ত্র তৈরি করে পৃথিবীর মানুষকে ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধরত কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন—জার্মানির সম্রাট দ্বিতীয় উইলহেম, রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাস, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট রেমন্ড পয়েনসার, ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ, ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ, সার্বিয়ার রাজা পিটার, ইতালির রাজা ভিক্টর তৃতীয় ইমানুয়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন, অটোমান সুলতান পঞ্চম মেহমেদ প্রমুখ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২ লাখ সৈন্য জীবন দেয়। আহত হয় এর চেয়েও বেশি। ধ্বংসযজ্ঞ চলে যুদ্ধে যুক্ত নানা দেশে। ধ্বংস হয়ে যায় খাদ্যশস্যসহ নানা সম্পদ। এত সব ক্ষতির পর একসময় যুদ্ধবাজ দেশগুলো সিদ্ধান্ত নেয় যুদ্ধ বন্ধের। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর জার্মান ও মিত্রবাহিনীর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় অস্ত্রবিরতি চুক্তি। তবে চূড়ান্ত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে আরও কিছুটা সময় লাগে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দুই পক্ষকে নিয়ে প্যারিসে শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি শুরু হয় এই সম্মেলন। বিশ্বের প্রায় ৩২টি দেশের নেতারা এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। ২৮ জুন প্যারিসের কাছে ভার্সাই নগরীতে চূড়ান্তভাবে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মারাত্মক পরিণতির পর মানবিক হতে পারেনি শক্তিধর দেশগুলোর ক্ষমতাবান মানুষগুলো; বরং এদের ক্ষমতার নেশা আরও পেয়ে বসে। তাই বছর কয়েক না যেতেই বাধিয়ে দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধ আরও ভয়ানক পরিণতি ডেকে এনেছিল পৃথিবীতে। এখনো মাঝেমধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যায়। কিন্তু পৃথিবীর কোনো মানবিক মানুষই চায় না যুদ্ধ। চায় শান্তি। আমরা আকাশে ধ্বংসের কালো ধোঁয়া দেখতে চাই না। ওড়াতে চাই শান্তির পায়রা।
লেখক: অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়