পেশীবহুল শরীর, ঝাঁকড়া চুলওয়ালা মাওয়ি ডিজনির অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘মোয়ানা’র একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র মোয়ানার পাশাপাশি মাওয়ি চরিত্রটি বেশ নজর কেড়েছে সবার। এই চরিত্রের ধারণাটি নেওয়া হয়েছে পলিনেশীয় উপদেবতা মাওয়ি থেকে। চলচ্চিত্রে মাওয়ি তার শরীরে আঁকা যে চিত্রগুলো দেখিয়ে ‘ইউ আর ওয়েলকাম’ গানটি গেয়েছিল, সেগুলো আসলে ওই উপদেবতার জীবনের ঘটনা বলেই জানে পলিনেশীয় অধিবাসীরা। পলিনেশীয় পুরাণমতে মাওয়ি হলো যুদ্ধ, শিকার ও চাষাবাদের দেবতা তুমাতা উয়েঙ্গার বংশধর। স্বাভাবিক ও পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় জন্ম না হওয়ায় মাওয়িকে সমুদ্রে ফেলে দেয় তার মা–বাবা। সমুদ্রের দেবতা রাঙ্গি তাকে খুঁজে পায় এবং রাঙ্গির কাছেই মাওয়ি বড় হতে থাকে। বড় হয়ে মাওয়ি তার জন্মপরিচয় জানতে পেরে যখন তার পরিবারের কাছে ফিরে যায়, তারপরেই ঘটে পুরাণে উল্লেখিত সেই কিংবদন্তি ঘটনাগুলো।
দিগন্তহীন আকাশের গল্প
বহু বহুকাল আগে আকাশ ছিল পৃথিবীর অনেক কাছে। দেখলে মনে হতো প্রায় পৃথিবী ছুঁয়ে যায়। আকাশ এত নিচে থাকায় বিভিন্ন জায়গা অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকত। মানুষের কাজকর্ম, হাঁটাচলায় অসুবিধা হতো। মানুষের এত অসুবিধে দেখে মাওয়ি সিদ্ধান্ত নিল আকাশটাকে ঠেলে ওপরে তুলে দেবে। কিন্তু সে হলো অর্ধদেবতা। তার একার পক্ষে এই কাজ সম্ভব নয়। এই কাজে সাহায্য করল তার পিতা মাকেয়াতুতারা। দুজনে মিলে মাটিতে শুয়ে দুই হাত দিয়ে ঠেলে ধরল আকাশটাকে। এভাবে ঠেলতে ঠেলতে তারা আকাশ এতই ওপরে উঠিয়ে দিয়েছিল যে তার সীমানা মানুষের চোখের আড়াল হয়ে গেল। সেই থেকে আকাশের সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব অনেক।
সূর্যকে শিক্ষা দেওয়া
মাওয়ি একসময় বুঝতে পারল রাতের তুলনায় দিন অনেক ছোট। মানুষ দিনের অল্প একটু সময়ে সব কাজ শেষ করতে পারে না। তাই মাওয়ি ভাবল সূর্যটাকে আটকে রেখে বলবে তাড়াহুড়া করে চলে না যেতে। সে এই ব্যাপারে তার ভাইদের সাহায্য চাইল। প্রথমে ব্যাপারটি তার ভাইদের কাছে অসম্ভব মনে হলেও মাওয়ির জাদুশক্তি সম্পর্কে ধারণা ছিল তাদের। তাই তারা মাওয়িকে এই কাজে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিল। মাওয়ি দেবী মুরিরাঙ্গা হেরিনোয়ার কাছ থেকে তার চোয়ালের হাড় এনে বানাল বড়শির মতো দেখতে এক অস্ত্র। এটিই মাওয়ির সেই বিখ্যাত অস্ত্র মানাইয়াকালনি। এই অস্ত্রের মাথায় দড়ি বেঁধে সে নিয়ে চলল হালেয়াকালা পর্বতের দিকে। যেখান থেকে প্রতিদিন সূর্য উদয় হয়। সূর্যের চোখের আড়াল হতে সে ও তার ভাইয়েরা রাতের আঁধারে পথ চলত। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে অপেক্ষা করতে লাগল সূর্যোদয়ের। পরদিন যেই সূর্য আকাশের অন্য প্রান্তের উদ্দেশ্যে ছোটা শুরু করল, মাওয়ি আর তার ভাইয়েরা পেছন থেকে সূর্যকে বেঁধে টেনে ধরল। মাওয়ি তার মানাইয়াকালনি দিয়ে পিটিয়ে সূর্যকে শিক্ষা দিল এবং বলল তাড়াহুড়া না করে আস্তেধীরে অস্ত যেতে। শক্তিশালী মাওয়ির কথা অমান্য করে, সেই সাহস কি আর সূর্যের আছে!
হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের আবির্ভাব
পলিনেশীয় পুরাণমতে, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের উত্থান হয় মাওয়ির সেই মানাইকালানির মাধ্যমে। একদিন মাওয়ি তার ভাইদের সঙ্গে মাছ ধরতে গেলে তারা মাওয়িকে নিয়ে উপহাস করতে থাকে। মাওয়ি অপমানিত হয়ে তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য মানাইয়াকালনিতে দড়ি বেঁধে সমুদ্রে ফেলে এবং সবচেয়ে বড় মাছটি ধরে দেখাবে বলে জানায়। কিন্তু বড়শি টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে আস্ত এক দ্বীপ। এভাবে সে আরও কয়েকবার বড়শি ফেলে সমুদ্রের নিচ থেকে দ্বীপ উঠিয়ে আনে। এভাবেই গড়ে ওঠে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ।
হাওয়াইয়ের নারকেলগাছ
মাওয়ি একবার তার বড়শিতে উঠে আসা দ্বীপগুলো ভ্রমণ করতে গেল। সে দেখল, প্রায় প্রতিটা দ্বীপেই ঘর আছে। কিন্তু কোনো বসতি নেই। মাওয়ি একটি দ্বীপে গিয়ে বসতি শুরু করে। একদিন তার মা সাগরে পানি আনতে গেলে বিরাট এক ইল মাছ তাকে তাড়া করে। এ রকম পরপর কয়েকবার হওয়ার পর মাওয়ি ব্যাপারটি জানতে পারে। মাওয়ি তখন ইল মাছের জন্য ফাঁদ পাতে। পরদিন যখন আবার একই ঘটনা ঘটতে যায়, তখন ইল মাছটি মাওয়ির ফাঁদে আটকা পড়ে। মাওয়ি সবার জীবন অতিষ্ঠ করা ইলটিকে মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলে। সেখান থেকেই জন্মে নারকেলগাছ। মানুষ ফল হিসেবে পায় নারকেল।
মাওয়ির উপকারের গল্প হাওয়াই, তাহিতি, মাওয়ি, সামোয়ান উপকথা ও পুরাণে উল্লেখ আছে। মাওয়ির নামে রয়েছে একটি দ্বীপও। সেখানে মাওয়িকে ‘দ্য লেজেন্ড অব মাওয়ি’ বলেই চেনে সবাই। পলিনেশীয় অঞ্চলগুলোর লোকগান ও উপকথায় এখনো জীবিত আছে মাওয়ি। সেই ঝাঁকড়া চুলওয়ালা শক্তিশালী উপদেবতা।
সূত্র : হাওয়াইয়ান গেজেট ও জার্নাল অব পলিনেশিয়ান সোসাইটি