বন্দী রাজকুমারী, দুঃসাহসিক রাজপুত্র, সাত সমুদ্র তেরো নদী, তেপান্তরের মাঠ, রাক্ষস আর পঙ্খিরাজ—এই নিয়েই আমাদের চিরচেনা রূপকথার জগৎ। আর আছে বনের পশু, আছে পাখিরাও। পাখি ছাড়াও রূপকথা হয়। কিন্তু ব্যাঙ্গমা–ব্যাঙ্গমী, শুক-সারি কিংবা ধরো সিন্দবাদের সেই রক পাখি—এগুলো বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপকথার জগৎ কল্পনা করা যায়! রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, বিভূতিভূষণের গল্পে-উপন্যাসে, জীবনানন্দের কবিতায় কিংবা সব ধরনের গানে পাখিরা ফিরে ফিরে এসেছে বারবার। তারও বহু আগেই সেই পৌরাণিক যুগের রূপকথার রাজ্যেও বাস করত আজব, বুদ্ধিমান কিংবা হিংসুটে পাখিরা। ব্যাঙ্গমা–ব্যাঙ্গমীর গল্প কাউকে বলে দিতে হয় না। হাজার বছর ধরে এই পাখিরা বাংলার ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েদের স্বপ্নের জগৎ তৈরি করেছে রুপালি জ্যোৎস্নার রাতে কিংবা ঘোর অমানিশায়। ঘুমপাড়ানি গানের সঙ্গে এ দেশের দাদি-নানিরা ব্যাঙ্গমা–ব্যাঙ্গমীদের গল্প শুনিয়ে এ দেশের শিশু-কিশোরদের জন্য মায়াবী শৈশব গড়ে দিয়েছেন।
ব্যাঙ্গমা–ব্যাঙ্গমী রূপকথার পাখি। কোন সুদূর অতীতে কোনো এক গরিব জেলের দুর্দশা দেখে তাকে প্রতিদিন একটা করে মাছ উপহার দিত ব্যাঙ্গমা–ব্যাঙ্গমী জুটি। কিন্তু সেই জেলেই লোভের বশে রাজার কাছে ব্যাঙ্গমা–ব্যাঙ্গমীকে সর্বনাশ করার চেষ্টা করে। রাজার পাইক-বরকন্দাজদের সঙ্গে নিয়ে ধরতে চেয়েছিল উপকারী পাখি দুটিকে। কিন্তু সৎ, বুদ্ধিমান পরোপকারী পাখি দুটি সেদিন জেলে, পাইক-বরকন্দাজদের উড়িয়ে নিয়ে হারিয়ে যায় তেপান্তরের ওপারে রহস্যময় জগতে। আর ফেরেনি কখনো। রূপকথায় জনপ্রিয় হলেও বাস্তবে ব্যাঙ্গমা–ব্যাঙ্গমীর দেখা তুমি পাবে না পৃথিবীর কোনো জঙ্গলে। যেমন ধরো চাকমা রূপকথার ওই রংরাং পাখি। অতিকায় পাখিটা হাঁ করে হাওয়া খাচ্ছিল চিবিদ নামের এক কাল্পনিক গাছের মগডালে। তখন দুষ্টু এক ব্যাঙ তার বন্ধু টুনটুনিকে ভয় দেখিয়ে বলে, শহরের লোকেরা নাকি বলাবলি করছে, আজ ভীষণ ঝড় হবে। ঝড়ের আতঙ্কে টুনটুনি রংরাং পাখির হাঁ-টাকেই গাছের কোটর ভেবে তার ভেতর ঢুকে পড়ে। রংরাং পাখি ভড়কে যায়। কান ফাটানো চিৎকার দিয়ে গোটা বন আতঙ্কিত করে তোলে। চিৎকারে দিশেহারা হয়ে এক হরিণ মাড়িয়ে দেয় এক সাপের লেজ। সাপ রেগেমেগে পিঁপড়ার বাসা ভাঙচুর করে। সেই রাগে পিঁপড়ারা কামড় দেয় হাতির শুঁড়ে। যন্ত্রণাকাতর হাতি তছনছ করে দেয় এক বুড়ির জুমখেত। বুড়ি গিয়ে রাজাকে নালিশ করে। রাজা তদন্ত করে জেনে যান, যত নষ্টের গোড়া মিথ্যাবাদী ওই দুষ্টু ব্যাঙটাই, তাকে শাস্তি দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন রাজা।
টুনটুনি আমাদের অতিপরিচিত পাখি। কিন্তু রংরাং কিংবা ব্যাঙ্গমা–ব্যাঙ্গমীদের মতোও তার সদর্প বিচরণ রূপকথার রাজ্যে। টুনটুনিকে নিয়ে এত এত গল্প আছে, সেগুলো সারা দেশ থেকে সংগ্রহ করে বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী একটা বই লিখে ফেলেছিলেন। নাম টুনটুনির গল্প। টুনটুনি আর বিড়ালের গল্প যেমন ছিল সেই বইয়ে, তেমনি আরেক গল্পে নাক কেটে দুষ্টু নাপিতকে সাজা দিয়েছিল টুনটুনি। টুনটুনির গল্প আছে ঠাকুরমার ঝুলিতেও। ‘রাজার ঘরে যে ধন আছে টুনির ঘরেও সে ধন আছে’—এই বুলি আউড়ে, প্রখর বুদ্ধি খাটিয়ে দুষ্টু-লোভী রাজাকেও শাস্তি দিয়েছিল টুনটুনি।
নীতিকথার গল্পগুলোতে দুই রকম কাক দেখতে পাই—বোকা আর ভীষণ বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান কাকের কথাই ধরো। পানির তৃষ্ণায় যখন তার প্রাণ যায়, তখন অর্ধেক পানি ভরা একটা কলস আবিষ্কার করে সে। কলসির মুখে দাঁড়িয়ে সেই পানির নাগাল পায় না কাক। তখন বুদ্ধি করে ছোট ছোট পাথর কুড়িয়ে, সেই পাথর কলসিতে ফেলে পানির উচ্চতা বাড়িয়ে পানি পান করে। বুদ্ধিমান কাকের গল্প সারা বিশ্বে প্রচলিত। শিশুরা এ গল্প পড়ে আর নিজেদের ওই কাকের মতো বুদ্ধিমান ভাবতে ভালোবাসে।
বোকা কাকেরও অভাব নেই রূপকথার রাজ্যে। ওই যে শিয়ালের ফিচেল বুদ্ধিতে নাকাল হয়েছিল যে কাক, তার কথা ভাবো একবার। তার বোকামির কথা কে না জানে। কাক এক টুকরা মাংস জোগাড় করে নিয়েছিল নিজের পেট ভরাবে বলে, বসেছিল এক গাছের মগডালে। সেই পথে যাচ্ছিল এক দুষ্টু শিয়াল। ব্যাটার খুব লোভ হলো কাকের মুখের ওই মাংসের টুকরাটার প্রতি। কীভাবে খাওয়া যায় সেই বুদ্ধি আঁটে শিয়াল। ইনিয়ে–বিনিয়ে কাকের সৌন্দর্যের প্রশংসা করে। বলে, এত সুন্দর যে পাখি, তার কণ্ঠ না জানি কত মধুর! আহা যদি গান শোনাত পাখিটা, কী ভালোই না লাগত। প্রশংসায় গলে গিয়ে কাক ‘কা-কা’ করে ডেকে ওঠে। ফলে মুখ থেকে পড়ে যায় মাংসের টুকরা। সেই মাংস বগলদাবা করে পালিয়ে যায় দুষ্টু শিয়াল।
আবার ধরো সিন্দবাদের রক পাখির কথা। সিন্দবাদের কাহিনিকে আরব্য উপন্যাস বলা হয় ঠিকই, তবু সেই গল্প রূপকথা ছাড়া কিছু নয়। সিন্দবাদ অভিযানে বেরিয়েছে, কত দেশ ঘুরে অবশেষে পড়েছে এক মহাসাগরের কোলে। জাহাজ নেই, সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার উপায় কী। তখন অতিকায় এক রকম পাখি এসে উদ্ধার করে। রক পাখি। তার পিঠে চড়িয়ে সিন্দবাদকে চড়িয়ে পার করে দেয় উত্তাল মহাসমুদ্র।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে যে আলিফ লায়লা হতো, সেখানে এই পাখিটাকে দেখানো হয়েছিল বিশাল এক ইগল হিসেবে। কিন্তু ইগল পাখিই যে রক পাখি, এ কথার কোনো প্রমাণ কোথাও নেই। তাই বলে ভেবো না রূপকথার বেশির ভাগ পাখি বাস্তবের সঙ্গে মিলবে না। শুক-সারিদের কথা ভাবো একবার, যারা কথা বলতে পারে, মৈমনসিংহ গীতিকা কিংবা ঠাকুরমার ঝুলিতে যাদের কথা বলতে দেখা যায় মানুষের ভাষায়, সেই পাখি কিন্তু আমাদের বসতবাড়ির আশপাশেই বাস করে। শুক পাখি মানে শালিক, আমাদের অতিপরিচিত ভাতশালিক। আর সারি মানে টিয়া। এখন দুশ্চিন্তা হতে পারে, টিয়া কথা বলতে পারে, সে কথা সবাই জানে। কিন্তু শালিক কি বলে? ময়না আর শালিক একই গোত্রের পাখি। ময়নাকে শেখালে যেমন কথা বলতে পারে, ঠিক একইভাবে চাইলে শালিককেও কথা বলা পাখিতে পরিণত করা যায়। তবে হ্যাঁ, রূপকথার পাখিরা বুদ্ধিমান হয়, কথাগুলো তারা বুঝেই বলে। বাস্তবের শুক-সারি, ময়না, তোতা, কাকাতুয়াদের কথা বলতে দেখা যায় হরহামেশাই, কিন্তু সেই কথা তারা ভেবে-বুঝে বলে না। মানুষের কথা বারবার শুনে আন্দাজে কিছু শব্দ বা বাক্য মুখস্থ করে ফেলে। কিন্তু সে কী বলছে, তার মানেটা সে বোঝে না; এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। আর শুক পাখির ট্র্যাজিক কাহিনি আছে। তা যদি জানতে চাও, তাহলে মৈমনসিংহ গীতিকার ‘কাজলরেখা’ গল্পটা পড়ো।
মানুষের কথা বারবার শুনে আন্দাজে কিছু শব্দ বা বাক্য মুখস্থ করে ফেলে। কিন্তু সে কী বলছে, তার মানেটা সে বোঝে না; এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। আর শুক পাখির ট্র্যাজিক কাহিনি আছে। তা যদি জানতে চাও, তাহলে মৈমনসিংহ গীতিকার ‘কাজলরেখা’ গল্পটা পড়ো।
আজ যেসব রূপকথা শুনি, অতীতে এগুলো একটু অন্য রকম ছিল। ধরো, গরুড় পাখির কথা মহাভারতে পাওয়া যায়। কিন্তু গরুড় যে কী পাখি, তার হদিস এখনো মেলেনি। তবে পৌরাণিক আরেকটা পাখি আছে, সেটা হলো চাতক। গল্পটা জানো তো। চাতক পাখি কখনো মাটিতে নামে না, বৃষ্টির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে থাকে। বৃষ্টি এলে মুখের মধ্যে ফোঁটা পড়ে। চাতক সেই পানি খায়। যত দিন বৃষ্টি না হয়, চাতক পানি পান করে না। একসময় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। চাতক তখন বৃষ্টির জন্য চিৎকার করে। তবু বৃষ্টি হয় না। তখন চাতকের গলা দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হয়—পুরোটাই একটা গল্প। চাতক মোটেও বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা করে না। এই চাতক হলো আমাদের দেশের দুর্লভ পাখিগুলোর একটি। আসল নাম পাকড়া পাপিয়া। এরা পরিযায়ী। বছরের বেশির ভাগ সময় এ দেশেই থাকে। শীতকালে চলে যায় আফ্রিকায়। ফিরে আসে শীত শেষে। আগে যেখানে থাকত আবার সেখানে ফিরে যায়। এরা গাছের উঁচু ডালে একা একা বসে থাকে। তখন আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে হাঁ কারে ডাকে। এদের এই হাঁ করা দেখে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষার গল্পটা প্রচলিত হয়েছে। আসলে মাটিতে নামতেও এদের কোনো অনীহা নেই।
ফুল যেমন বেশির ভাগ মানুষই পছন্দ করে, পাখির সমাদরও ঠিক ততটাই। তাই মানুষ পাখি পোষে, তাদের কথা শেখানোর চেষ্টা করে। এ জন্যই এদের নিয়ে দুনিয়াজুড়ে তৈরি হয়েছে কতশত রূপকথা। রূপকথায় যেভাবেই দেখানো হোক, পাখিকে খাঁচায় বন্দী করার চেষ্টা অমানবিক। সবাই তো স্বাধীনতার কাঙাল। ইচ্ছা করে সেই স্বাধীনতা হরণ করা কিন্তু অন্যায়!