রূপকথা নয় রজ্জুপথ

ছাতকে রজ্জুপথের খালাস স্টেশনছবি: আনিস মাহমুদ

‘পথ কত প্রকার? কেউ বলতে পারবে?’ নীরব ক্লাসরুমে গর্জে উঠল শিক্ষকের কণ্ঠ। ‘চার প্রকার স্যার। নৌপথ, সড়কপথ, আকাশপথ, রেলপথ।’ প্রথম বেঞ্চ থেকে ভয়ে ভয়ে বলল একজন।

‘শাবাশ!’ ক্লাসরুম ফাটিয়ে হুংকার দিলেন শিক্ষক। ‘ঠিক বলেছিস।’ অনেকে চমকে উঠল তার হুংকারে। এমন সময় হাত তুলল পেছনের বেঞ্চে বসা একজন। শিক্ষক অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই হাত তুলেছিস কেন? টয়লেটে যাবি? ফার্স্ট পিরিয়ডে টয়লেট কিসের?’

‘টয়লেটে যাব না স্যার। আরেকটা পথের কথা বলতে হাত তুলেছিলাম। রজ্জুপথ।’ শিক্ষক চোখ কুঁচকে বললেন, ‘আরেকটা পথ আছে বৈকি। বিপথ। যেটাতে তুই অলরেডি চলে গেছিস অনেক আগেই। রজ্জুপথ না, রজ্জুপথটা আবার কী?’ ‘স্যার এই রজ্জুপথের কথা অনেকেই জানে না। রজ্জুপথ মানে রশির পথ। ইংরেজিতে রোপওয়ে লাইন। রশির সাহায্যে মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য ব্রিটিশ আমলে রেলওয়ের ব্যবস্থাপনায় শুধু পাথর পরিবহনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল এটি।’

‘অ্যা?’ মুখ হাঁ হয়ে গেল শিক্ষকের। ‘জি স্যার। এটা বাংলাদেশ রেলওয়েরই। একই কাঠামোর বলে রজ্জুপথকে রেলপথের যমজ ভাই বলেও ডাকা হয়। হাওর-নদী-পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় একসময় পাথরের সঙ্গে মানুষও চলাচল করত রজ্জুপথ দিয়ে।’

‘সত্যি বলছিস?’ শিক্ষক এখনো দ্বিধায় ভুগছেন। ‘সত্যি স্যার। “বাংলাদেশের একমাত্র রোপওয়ে কোথায় অবস্থিত?” এ রকম প্রশ্ন পাঠ্যপুস্তকেও ছিল একসময়।’

‘ও, তাই নাকি? আমি তো জানতামই না। আচ্ছা, বস তুই।’

স্যারের মতো অনেকের কাছেই হয়তো রূপকথার মতো শোনাচ্ছে! রূপকথা নয়, রজ্জুপথ কিন্তু এখনো আছে। চলছেও। তবে আগের মতো নয়। গ্রাম থেকে শহরে বিভিন্ন মুঠোফোন কোম্পানির উঁচু উঁচু টাওয়ার দেখা যায়, ঠিক সে রকম উঁচু খুঁটির পর খুঁটি। সঙ্গে তার। মানে রশি আরকি। তাতে লোহার বাক্স ঝোলানো। চালু করলে চলন্ত তারে বাক্সগুলো দ্রুতগতিতে চলে। থিমপার্কের কেবল কারের মতো। চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে দুদিকে রয়েছে দুটি স্টেশন। একটি ‘বাংকার’, অপরটি ‘খালাস’ স্টেশন। এ জন্য প্রতিটিতে ৩৫৯ একর জায়গা সংরক্ষিত।

হাওর-নদী-পাহাড় পেরিয়ে রজ্জুপথ চলছে পাথর নিয়ে
ছবি: আনিস মাহমুদ

বাংকারের অবস্থান সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভোলাগঞ্জে। আর খালাস স্টেশনটা সুনামগঞ্জের ছাতকে সুরমা নদীর তীরে।

যেখান থেকে পাথর উত্তোলন হয়, সে স্থানকে পাথর কোয়ারি বলা হয়। দেশের অন্যতম বড় একটি পাথর কোয়ারি ভোলাগঞ্জ। উত্তোলিত পাথর পরিবহনে স্থল কিংবা জলযানের বিকল্প হিসেবে রজ্জুপথ স্থাপিত হয়। ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত ১৯ দশমিক ২০ কিলোমিটারের এই রজ্জুপথ নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। তখনকার সময়ে সোয়া দুই কোটি টাকা খরচ হয় এটি তৈরি করতে। রেলওয়ের ‘রোপওয়ে প্রকল্প’ হিসেবে ‘ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে।

ভারতের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ভোলাগঞ্জের ধলাই নদ। সেখান থেকে প্রতিবছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদের তলদেশেও রয়েছে পাথরের বিপুল মজুত। এই পাথর পরিবহনে রজ্জুপথ একটানা ব্যবহূত হয় ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত ১২০টি খুঁটি হাওর-নদী-পাহাড়ি এলাকা দিয়ে চলেছে। রেলের পরিভাষায় এগুলোকে বলে ‘টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্ট’। মধ্যখানে চারটি সাবস্টেশনও আছে। দুই প্রান্তে ডিজেলচালিত দুটি ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউসের মাধ্যমে এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্টের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করতেই রজ্জুপথের প্রতিষ্ঠা। যাতায়াত দুর্গম হওয়ায় মানুষেরও যাতায়াত ছিল রজ্জুপথে।

রজ্জুপথ দিয়ে ২০০টি বক্স চলাচল করে। প্রতি বক্সে ৬০০ কেজি ওজনের ১২ দশমিক ঘনফুট পাথর পরিবহন হয়। সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার প্রসার ঘটলে ট্রাক দিয়ে পাথর উত্তোলন দ্রুত হওয়ায় রজ্জুপথের গুরুত্ব কমে যায়। ১৯৯০ সালের পর রজ্জুপথ চলাচল অনিয়মিত হয়ে পড়ে।

ছাতক থেকে ভোলাগঞ্জে যোগাযোগ প্রথম রজ্জুপথ দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছিল। দুই এলাকার দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। রজ্জুপথ তাই বিস্তৃত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ।

রেলগাড়ির এই যমজ ভাই চলার সময় ছন্দময় শব্দ শোনা যায়। রেলগাড়ি চলে কু...ঝিক ঝিক... করে। আর রজ্জুপথ চলার শব্দ অনেকটা বাতাসের বেগের মতো—শন্ শন্...ঝন ঝন...।

ভোলাগঞ্জে রজ্জুপথের বাংকার স্টেশন
ছবি: আনিস মাহমুদ

সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার প্রসার ঘটায় রজ্জুপথ এখন রেলওয়ের ঐতিহ্য রক্ষার একটি স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। বছরে অন্তত তিন মাস রুটিন করে চলে রজ্জুপথ। বর্ষার দেড় মাস আর শুষ্ক মৌসুমে দেড় মাস। সকাল আর দুপুর—এ দুই বেলা চলে। এ দুই মৌসুমের যেকোনো দিন ছাতক কিংবা ভোলাগঞ্জ গেলে রজ্জুপথ চলার দৃষ্টিনন্দন আরেক রূপের দেখা মেলে। এ জন্য তোমাদের যেতে হবে ছাতক। রেলস্টেশনের এক পাশে রজ্জুপথ স্টেশন। সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে এসে মিলেছে। রজ্জুপথ যখন চলে, তখন পুরো ছাতক শহর যেন আকাশপানে তাকিয়ে রয় চাতক পাখির মতো!

(কিশোর আলোর ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)