স্নো হোয়াইটের গল্পে যে সাত বামনের কথা বলা হয়েছে, তাদের সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? কোথা থেকে এল তারা? বনের ভেতরে একটা কুটির বানিয়ে কেনই বা তারা একসঙ্গে থাকে? শহরে বা গঞ্জে থাকে না কেন? স্নো হোয়াইটকে বাড়ির মধ্যে রেখে তারা যে প্রতিদিন বাইরে চলে যায়, কোথায় যায়? কী করে তারা?
আমরা যারা স্নো হোয়াইটের গল্পটা পড়েছি এবং ঘুরেফিরে বারবার পড়েই যাচ্ছি, তাদের কজন এই প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পারব? খুব বেশি না। তার কারণ, সাত বামন কখনোই আমাদের নজর কাড়ে না। আমাদের চোখ থাকে স্নো হোয়াইট নামক মিষ্টি সরল মেয়েটির দিকে। হিংসুটে সৎমায়ের সঙ্গে তার বিরোধ আর রাজপ্রাসাদ থেকে তার বিতাড়িত হয়ে বনবাসের কষ্ট আমাদের মনজুড়ে থাকে। আর আমাদের মুগ্ধ করে রাখে কথা বলতে পারে এমন একটা জাদুর আয়না। ওই আয়না সত্যবাদী।
স্নো হোয়াইট সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপকথা। ভোটাভুটি করলে সিন্ডারেলার চেয়ে স্নো হোয়াইট বেশি ভোট পাবে, আমি নিশ্চিত। জনপ্রিয় এই রূপকথা বিচিত্র লোকের হাতে এত বিচিত্রভাবে লিখিত হয়েছে যে এর আদি গল্পটি হারিয়ে গেছে। শুরুতে গল্পটি কেমন ছিল, জানতে হলে আমাদের গ্রিম ভাইদের আদি বইটা খুলতে হবে, যেটার নাম চিলড্রেনস অ্যান্ড হাউসহোল্ড টেলস। ওখানেই প্রথম লিখিত আকারে হাজির হয়েছিল কাহিনিটি।
কী বলা আছে সেখানে?
সেখানে সাত বামন সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়া আছে। বলা আছে, এই সাত বামন একটা খনিতে কাজ করে। প্রতিদিন ভোরে তারা কাজে যায়। ফিরে আসে সন্ধ্যায়। আমরা কল্পনা করে নিতেই পারি, তারা খুব ক্লান্ত হয়ে ফেরে। কেননা ফিরেই তারা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এ জন্য তার কুটিরের ভেতরটা খুবই অগোছালো, ছন্নছাড়া।
তাহলে আমরা বনের মধ্যে আসলে পেলাম সাত খনিশ্রমিক। শুধু কি খনিশ্রমিকই পেলাম? আরে, একটা আস্ত খনিও যে পেয়ে গেলাম আমরা। নিশ্চয়ই বনের ধারে কাছাকাছি কোথাও আছে খনিটা। এমন একটা খনি, যার শ্রমিকেরা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। খনির শ্রমিকেরা বামন আকৃতির—ক্ষুদ্র, খর্ব। আচ্ছা, খনির সব শ্রমিকই কি এ রকম বামন আকৃতির? নাকি এই সাত শ্রমিক ব্যতিক্রম?
এমন কি হতে পারে না, এই সাত বামন অন্য কোথাও থেকে এসেছে? অন্য কোনো দেশ থেকে, যেখানে মানুষজনের আকার ও রকমই ক্ষুদ্র, খর্ব। মানে এরা আসলে অভিবাসী শ্রমিক, মেসিং করে আছে, আমাদের দেশ থেকে যেমন মালয়েশিয়া বা ইতালিতে গিয়ে মেসবাড়িতে থাকে শ্রমিকেরা। তারা অত খর্বকায় নয়, কিন্তু গরিব তো বটে।
রূপকথায় হোমসগিরি
তাহলে ভালো করে লক্ষ করলে স্নো হোয়াইটের রূপকথার রাজ্যটার একটা বাস্তব ভূগোল কিন্তু আমরা পেয়েই যাচ্ছি: একটা রাজপ্রাসাদ, তার কাছাকাছি একটা বন। গহিন বন। আর বনের বাইরে খুব কাছেই একটা খনি। বনের যেদিকে রাজপ্রাসাদ সেদিকেই কি খনিটা? নাকি উল্টো দিকে? খনির বাকি শ্রমিকেরা কোথায় থাকে? কিসের খনি? হীরকের খনি? অভ্রের? নাকি কয়লার?
গল্পে কিছুই বলা নেই। কিন্তু আমরা কল্পনা তো করে নিতেই পারি। কিংবা চালাতে পারি অনুসন্ধান।
গ্রিম ভাইরা যে এলাকা থেকে গল্পটা সংগ্রহ করেছেন, সেই পশ্চিম ইউরোপ এলাকায় ওই সময় কী ধরনের খনি চালু ছিল, খোঁজ করলে কিছু ক্লু পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি এটা কী শুরু করলাম? রূপকথার গল্প তো
রূপকথারই গল্প। সেগুলোকে এমন সিরিয়াসলি নিয়ে শার্লক হোমসের মতো ক্লু খোঁজা শুরু করেছি কেন? রূপকথার গল্পগুলোকে ডিটেকটিভ গল্প হিসেবে দাঁড় করানোর মতলব আছে নাকি আমার?
আছে। আমি এখানে হোমসগিরি করছি, কেননা আসলেই কিছু সন্দেহজনক জিনিস আমার চোখে পড়েছে। স্নো হোয়াইটের গল্পের এই সাত বামনের ভাই-ব্রাদার জ্ঞাতি-গুষ্টিকে আরও বিভিন্ন রূপকথায় উঁকিঝুঁকি দিতে দেখছি আমি। শুধু কি
রূপকথা? কাল্পনিক রাজ্যের যত গল্পই মানুষ লিখেছে, ভালো করে লক্ষ করলে সেখানেও এই সাত বামনের বংশধরদের দেখা মিলবে।
সাত বামনের জ্ঞাতিগুষ্টি
চার্লি অ্যান্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি বইটার কথাই ধরা যাক। উইলি ওয়াংকার ওই দুর্গের মতো ফ্যাক্টরির ভেতর চকলেট বানানোর কাজে ব্যস্ত উম্পা-লুম্পা আসলে কারা? বামন আকৃতির এই শ্রমিকেরা কোথা থেকে এল? কারখানার মালিক উইলি ওয়াংকা জানাচ্ছেন, লুম্পাল্যান্ড নামে একটা জায়গা থেকে এদের আনা হয়েছে। কোথায় এই লুম্পাল্যান্ড?
শোনা যায়, বই আকারে প্রকাশ করার আগে রোয়াল্ড ডাল প্রথম যে পাণ্ডুলিপিটি তৈরি করেছিলেন, সেখানে তিনি উম্পা-লুম্পাদের নাম রেখেছিলেন হুইপল-স্ক্রামপেট। আর তাদের আফ্রিকান পিগমি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে ডাল শুধু ওদের নাম আর দেশটাই বদলে দেননি, শ্রমিকদের গায়ের রংও বদলে দিয়েছেন: উম্পা-লুম্পারা হয়ে গেছে সাদা চামড়ার আর লাল চুলের। তবে সিনেমায় কিন্তু উম্পা-লুম্পাদের আবার কালো জংলিই বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিংবা লর্ড অব দ্য রিংস সিরিজের কথা ধরা যাক। বামন আকৃতির হবিটগুলো কারা? ইঁদুরের মতো গর্তের মধ্যে বসবাস করে কেন তারা? আবার আংটিটা যখন একটা হ্রদের মধ্যে তলিয়ে যায়, তখন সেটার তলদেশে যে লোকটা আংটি সংরক্ষণ করে রাখে, সেই লোকটা এক রুগ্ণ, অপুষ্ট, খর্বকায় বহুবর্ষজীবী বৃদ্ধ। লোকটার নামটা লক্ষ করো। তার নাম গোলাম। গোলাম মানে ভৃত্য, দাস।
রূপকথা আসলে লোককথা
যেসব রূপকথা আমাদের সবচেয়ে প্রিয়, যেমন সিন্ডারেলা, স্লিপিং বিউটি, ফ্রগ প্রিন্স, রাপুনজেল, হ্যানসেল অ্যান্ড গ্রেটেল—এগুলো সবই গ্রিম ব্রাদার্স নামে দুই ভাইয়ের সংগ্রহ। আজ থেকে দু শ বছর আগে এই দুই জার্মান ভাই তাঁদের দেশের আনাচকানাচে ঘুরে সংগ্রহ শুরু করেন গ্রাম্য লোককথা। সেগুলোকে একসঙ্গে করে তাঁরা যে বইটা বের করেন সেটার নাম দেন চিলড্রেনস অ্যান্ড হাউসহোল্ড টেলস (জার্মান ভাষায় নাম ছিল কিন্ডার উন্ড হাউসমার্খেন)। লক্ষ করার বিষয়, তাঁরা কিন্তু বইটার নাম রাখেননি, জার্মান দেশের রূপকথা বা এ রকম কিছু। তার কারণ রূপকথা বা ফেইরি টেল কথাটা তখনো চালুই হয়নি। আর তা ছাড়া তাঁদের সংগ্রহ করা গল্পগুলো ছিল লোকমুখে চালু গল্প।
শুরুতে এ রকমই ছিল। লোকের মুখে মুখে তৈরি হয়েছে
রূপকথা। অনেক পরে যদিও সাহিত্যিকেরা নিজেরা রূপকথা লিখতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের অনেকে শুধু রূপকথার লেখক হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। যেমন হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন।
তবে বেশির ভাগ রূপকথাই লোককাহিনি। সুনির্দিষ্ট কেউ লেখেনি এগুলো, দীর্ঘদিন ধরে এর-ওর মুখে মুখে তৈরি হয়েছে। একজন বলেছে আরেকজনকে, সেইজন বলেছে আরেকজনকে। বলতে বলতে গল্পগুলো বদলে গেছে। গ্রিম ভাইয়েরা লিখে রাখার পরও এগুলোর বদলে যাওয়া বন্ধ হয়নি। নানান বইতে নানা লেখক নানানভাবে গল্পগুলো লিখেছেন, লিখছেন। আবার অ্যানিমেশন ও সিনেমা তৈরির সময় এগুলো আরেক দফা বদলাচ্ছে। এখন স্নো হোয়াইট আর সিন্ডারেলার যে নির্দিষ্ট চেহারা দাঁড়িয়ে গেছে, সেটা হলিউডি সিনেমা কোম্পানি ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্সের কল্যাণে।
রূপকথা বনাম কিংবদন্তি
কিন্তু কোন কাহিনিগুলোকে আমরা ফেইরি টেল বা রূপকথা বলব? এসব গল্পে পরি থাকতেই হবে? রাজা-রানি, রাজপুত্র-রাজকন্যার কথা থাকতেই হবে? না। থাকলে ভালো। না থাকলেও সমস্যা নেই। নাহলে হ্যানসেল আর গ্রেটেলকে আমরা রূপকথা বলতাম না।
পরি বা রাজপ্রাসাদ বা অলৌকিক জাদুটোনা রূপকথার আসল বৈশিষ্ট্য নয়। আসল বৈশিষ্ট্য দুটি। প্রথমত, এগুলোকে হতে হবে শিশুদের উপযোগী। বড়দের কোনো রূপকথা থাকতে পারে না। আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, রূপকথার গল্পকে রূপকথার গল্প হিসেবেই শুনতে হবে। মানে এগুলোকে অবাস্তব কল্পকথা হিসেবে শুনতে হবে। সত্যি গল্প হিসেবে শোনা যাবে না।
এখানেই রূপকথার সঙ্গে কিংবদন্তি বা লিজেন্ডের তফাত।
রূপকথার মতোই আরেক ধরনের কল্পকাহিনি মুখে মুখে চালু দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোকে বলে লিজেন্ড বা কিংবদন্তি। যেমন ধরা যাক আটলান্টিস নামে একটা ডুবে যাওয়া মহাদেশের কথা। কিংবা রবিনহুডের কাহিনি।
রূপকথার সঙ্গে কিংবদন্তির মূল তফাত হলো কিংবদন্তি লোকে সত্য কাহিনি বলে মনে করে। সেভাবেই এগুলো প্রচার হয়। লোকে জানেই না যে কিং আর্থার বা রাজা বিক্রমাদিত্য নামে আসলে কোনো রাজাই কখনো ছিল না।
বিপরীতে রূপকথা বলাই হয় বানানো কাহিনি হিসেবে। শোনার সময় লোকে আগে থেকেই জানে ফ্রগ প্রিন্সের ঘটনাটা কখনো ঘটেনি, কিংবা কোনো দিনই মৎস্যকুমারীর দেখা মিলবে না।
মিথ্যা আসলে সত্য
তা-ই যদি হয়, রূপকথার জন্মই যদি হয় গুলতানি হিসেবে, তাহলে সাত বামনের পরিচয় নিয়ে শুরুতে ও রকম হট্টগোলটা কেন করছিলাম আমি? কেন এমনভাবে খোঁজখবর করছিলাম, যেন তারা সত্যিকারের লোকজন?
তার কারণ হলো, আমরা যখন বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করি, মানে যখন ঠিক করি যে আমরা মিথ্যা কথা বলব, শুধু তখনই আমরা নিজের অজান্তে নিজের সম্পর্কে সত্য কথাগুলো বলতে শুরু করি। রূপকথার গল্প মুখে মুখে বানায় সাধারণ মানুষেরা—তারা অশিক্ষিত, অভাবী গ্রাম্য অভাজন। অথচ তারা গল্প বানায় রাজরাজড়াদের, রাজপুত্র-রাজকন্যার। তাদের গল্প জুড়ে থাকে রাক্ষস-খোক্কস, ডাইনি, গবলিন, এলভ আর পরি। সেসব গল্প বানাতে গিয়ে গ্রাম্য মানুষেরা নিজেদের লুকাতে চায়, চেষ্টা করে গল্পের ভেতর নিজেদের ছায়া যাতে না পড়ে, কোথাও যাতে নিজেদের দেখা না যায়। আর এ কারণেই গল্পের এখানে-সেখানে তাদের উঁকি দিতে দেখা যাবে।
গ্রিম ভাইয়েরা যখন জার্মানির প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে লোককাহিনি সংগ্রহ করছিলেন, হতে পারে তখন তাঁরা কোনো এক খনি এলাকার শ্রমিকদের মুখেই স্নো হোয়াইটের গল্পটি শুনেছিলেন। রাতের খাবারের পর নক্ষত্রখচিত আকাশের নিচে আগুনের ধারে গোল হয়ে বসে শ্রমিকেরা দুই ভাষাবিশারদ পণ্ডিত ভাইকে শুনিয়েছেন একটা প্রাসাদ আর এক অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যার গল্প। কালিঝুলি মাখা কয়লাশ্রমিকদের কল্পনা বলেই হয়তো ওই রাজকন্যা অমন বরফের মতো সাদা।