ইউক্রেনে ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলা চালায় রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে এটাই সবচেয়ে বড় সামরিক হামলা। অর্থাৎ গত ৬৬ বছরে এত বড় সামরিক হামলা দেখেনি ইউরোপের জনসাধারণ। এ হামলা বা যুদ্ধের পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নিরাপত্তা।
রাশিয়া সরকার যেমন তার দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, তেমনি ইউক্রেন সরকারও চায় তার দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
নিরাপত্তার এই ইস্যু সামনে এলেই আসে ন্যাটোর কথা। এটি পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট। এর পুরো নাম নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন। এ জোটে ইউরোপের অনেক দেশ থাকলেও রাশিয়া ও তার মিত্রদেশগুলো নেই। এ জোটের সদস্য হতে পারেনি ইউক্রেন। কিন্তু তারা চায় এ জোটের সদস্য হতে। আর এখানেই সংকটের সূচনা বলা যায়।
এ সংকট কেন, সেটা বলার আগে ন্যাটো জোট ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে বলা দরকার। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন ঠেকাতে ১৯৪৯ সালে গঠিত হয় ন্যাটো জোট। সেই সময় এ জোটের সদস্যদেশ ছিল ১২টি। এগুলো হলো বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ১৯৫২ সালে ন্যাটোতে যোগ দেয় গ্রিস ও তুরস্ক। ১৯৫৫ সালে জার্মানি যোগ দেয় এ জোটে। স্পেন ১৯৮২ সালে এবং চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ১৯৯৯ সালে ন্যাটোয় যোগ দেয়। আর ২০০৪ সালে যোগ দেয় বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া। ২০০৯ সালে ন্যাটো জোটের সদস্য হয় স্লোভেনিয়া, আলবেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়া। আর ২০১৭ সালে মন্টেনিগ্রো ও ২০২০ সালে উত্তর মেসিডোনিয়া ন্যাটোভুক্ত হয়। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইউরোপের বাইরে এ জোটের সদস্য দুই দেশ—কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র।
১৯১৭ সালে গঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু ১৯৯১ সালে এ ইউনিয়ন ভেঙে আলাদা হয়েছে ১৫টি দেশ। এই দেশগুলো হলো রাশিয়া, ইউক্রেন, জর্জিয়া, বেলারুশ, উজবেকিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, মলদোভা, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়া। এর মধ্যে সোভিয়েতের একমাত্র দেশ এস্তোনিয়া ২০০৪ সালে ন্যাটোয় যোগ দেয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন একসময় ছিল পরাক্রমশালী। বিভিন্ন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন দুর্বল হয়েছে। আর শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ন্যাটো। এ জোট শক্তিশালী হয়ে ওঠায় ইউরোপে তাদের প্রভাব বেড়েছে। কিন্তু রাশিয়া কখনোই চায়নি পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো নাক গলাক। এদিকে রাশিয়ার এ বলয় থেকে বেরিয়ে এসে ন্যাটোতে যোগ দিতে চায় ইউক্রেন। কিন্তু ইউক্রেন যদি এ জোটে যোগ দেয়, তবে রাশিয়ার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
২০২১ সালে জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তাঁর সঙ্গে কথা বলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এ সময় তিনি ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন (জোটে যোগ দেওয়ার বিষয়টি সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে)। ইউক্রেনের রাজনীতিতে রুশপন্থীদের কোণঠাসা করার উদ্যোগও নেন তিনি। রুশপন্থী বিরোধীদলীয় নেতা ভিক্টর মেদভেদচুকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন জেলেনস্কি। এসব ইস্যু সামনে এনেই ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন শুরু করে রাশিয়া।
প্রশ্ন উঠতে পারে, রাশিয়া কি শুধু ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া ঠেকাতে চায়, নাকি আরও কিছু চাওয়া রয়েছে? এর উত্তরে বলা যেতে পারে, রাশিয়ার অন্যতম স্পষ্ট চাওয়া হলো সোভিয়েত ইউনিয়নে একসময় ছিল, এমন কোনো দেশ ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত এলাকায় ন্যাটোর বিস্তার বন্ধ করতে হবে স্থায়ীভাবে।
২০০৮ সালে ন্যাটো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, একসময় ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে ইউক্রেন। এ প্রতিশ্রুতিরই প্রত্যাহার চায় রাশিয়া। এ প্রসঙ্গে রুশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সের্গেই রিয়াকভের বক্তব্য হলো, ‘আমরা অপর পক্ষকে (ন্যাটো) বিশ্বাস করছি না।’ তাঁর বক্তব্য হলো, কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতি নয়, রাশিয়ার ‘গ্যারান্টি’ লাগবে।
কিন্তু ন্যাটোর বক্তব্য হলো, যেকোনো দেশের অধিকার রয়েছে তার মিত্র বেছে নেওয়ার। সদস্য নেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যাটোর দ্বার উন্মুক্ত।
রাশিয়া চায়, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর কোনো সেনা, অস্ত্র-গোলাবারুদ, অর্থাৎ কোনো সামরিক উপস্থিতি থাকবে না। ‘নিরাপত্তাসংক্রান্ত নিশ্চয়তা’ চেয়ে একটি প্রস্তাব গত ডিসেম্বরে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে পাঠিয়েছিল রাশিয়া। এতে বলা হয়েছে, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি রাখা যাবে না। কিন্তু এ অঞ্চলের দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মন্টেনিগ্রো, আলবেনিয়া, উত্তর মেডিসোনিয়া ও বুলগেরিয়া ন্যাটোর সদস্য। ফলে রাশিয়ার এ দাবি মেনে নিলে সদস্যদেশগুলোর নিরাপত্তা ইস্যুকে উপেক্ষা করা হবে। যেটা ন্যাটোর মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এখানেই জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বার্লিন প্রাচীর ভাঙার পর শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ব ইউরোপ থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করা হয়। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর প্রসার ঘটবে না। সেই প্রতিশ্রুতিতেই ঘরে ফিরেছিল সোভিয়েত সেনাবাহিনী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ১৯৯৭ সালের পর থেকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে ন্যাটোর সদস্য করে। এতে ক্ষুব্ধ হন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি একে দেখছেন অন্যভাবে। পুতিন মনে করেন, মিত্র বাড়ানোর ক্ষেত্রে রাশিয়ার যে দুর্বলতা, তারই সুযোগ নিচ্ছে পশ্চিমারা।
পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর কোনো সামরিক উপস্থিতি থাকবে না—রাশিয়ার এ চাওয়াকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছে ন্যাটো। সেখানে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর কারণ হিসেবে রাশিয়ার দিকেই আঙুল তুলছে জোটটি। যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স-বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের মতে, ইউরোপের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলে ন্যাটোর সেনা মোতায়েন করতে হবে, এ ভাবনা তাঁদের ছিল না। রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনে হামলা চালালে তাঁরা সেনা মোতায়েনের পদক্ষেপ নেন।
রাশিয়ার আরেকটি উদ্বেগের কারণ হলো ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র। ইউরোপে মধ্যপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞা চায় দেশটি। এ-সংক্রান্ত ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তিও হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। ওই চুক্তি অনুসারে, যেসব ক্ষেপণাস্ত্র ভূমি থেকে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম, সেসব ক্ষেপণাস্ত্র এই দুই দেশ আর ব্যবহার করবে না। পারমাণবিক ও প্রচলিত—সব ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রই এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় চলে আসে। ফলে দুই দেশ ২ হাজার ৬৯২টি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে এ চুক্তির পর।
কিন্তু ২০১৯ সালে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আইএনএফ চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ছিল, রাশিয়া এ চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু রাশিয়া এর সঙ্গে একমত নয়। এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় বেজায় চটেছিলেন পুতিন। গত ডিসেম্বরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা কি যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের কাছে রকেট মোতায়েন করেছি? না। আমরা এটা করিনি।’ এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রকেট রাশিয়ার দ্বারপ্রান্তে কড়া নাড়ছে।
রাশিয়ার আশঙ্কা হলো, ন্যাটোর সদস্য হয়ে এ জোটের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেতে পারেন ইউক্রেনের সেনারা। এ ছাড়া ইউক্রেনের মাটিতে ন্যাটোর অস্ত্রের মজুত গড়ে উঠতে পারে। আর এসব অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেন থেকে মস্কোয় আঘাত হানা সম্ভব।
২০১৫ সালের ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। এর নাম মিনস্ক চুক্তি। এ চুক্তি অনুসারে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও রাশিয়া-সমর্থিত বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাতের অবসান হবে। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের দনবাস এলাকায় বিদ্রোহীদের একধরনের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা। কিন্তু ইউক্রেন আর সে পথে হাঁটেনি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি চাইছিলেন, এ চুক্তি সংশোধন করা হোক।
কিন্তু রাশিয়া চায় ওই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। তাই ইউক্রেনে হামলার শুরুর আগে এই দনবাসের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন পুতিন। এরপর এ দুটি এলাকায় সেনা মোতায়েনও করেছেন।
একটি রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সাদাচোখে দেখলে তা-ই মনে হতে পারে। কিন্তু পুতিন কি আসলে এটুকুই চান? বিভিন্ন সময় পুতিন ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, তিনি আসলে পুরোনো সেই সোভিয়েত ফেরত পেতে চান।
এ তো গেল প্রকাশ্য হিসাব। এ যুদ্ধে হিসাবের পেছনেও হিসাব রয়েছে। সেটা হলো আধিপত্যবাদ। ইউক্রেন ন্যাটোয় যুক্ত হলে আসলে রাশিয়ার সীমান্তে চলে আসবে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, তখন মার্কিন সেনারা সেখানে থাকতে পারবে। রাশিয়ার মতো দেশ কি তার সীমান্তে এমন শত্রুকে থাকতে দেবে? পাহারায় সক্রিয় ঘাতককে রেখে কেউ ঘুমাতে পারে? এ প্রসঙ্গে আল-জাজিরার একটি কলামে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা লিখেছেন, রাশিয়া এখন যে সামরিক হামলা চালাচ্ছে, আক্ষরিক অর্থে তা ইউক্রেনে হলেও হামলাটি আসলে চালানো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
অর্থাৎ এ লড়াইয়ে যদি রাশিয়ার জয় আসে, তবে সেই জয় আসলে ইউক্রেনকে হারিয়ে জয় নয়। জয়টা অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই হবে।
যাহোক, এ জয়-পরাজয় আসলে জনগণের নয়, শাসকের। কথায় আছে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। শাসকেরা কেউ হারেন, কেউ জেতেন। কিন্তু মরে মানুষ। শাসকের ভুলে প্রাণ যায় তাদের।