সুকুমার রায়ের গল্পটার নাম ‘টাকার বিপদ’। গল্পটা আগেও বলেছি। সেই যে এক বুড়ো গরিব মুচি রাত-দিনই কাজ করত আর গুনগুন করে গান গাইত। তার বাড়ির কাছে থাকত এক ধনী ব্যবসায়ী। তার অনেক টাকা, মস্ত বাড়ি। কিন্তু মনে সুখ নেই, স্বাস্থ্যও ভালো নয়। ব্যবসায়ী খালি ভাবে গরিব মুচির এত আনন্দ কোথা থেকে আসে? তার তো সামান্য রোজগার। তারপর সে একদিন মুচির বাড়ি গিয়ে কথা বলে এল। তারপর একটা টাকার থলে নিয়ে মুচিকে বলল, ‘এটা রেখে দাও, বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখের সময় কাজে লাগবে।’
মুচি কখনো এত টাকা একসঙ্গে দেখেনি। তার ভারী আনন্দ হলো। তারপর টাকার থলেটা নিয়ে মাটির তলায় লুকিয়ে রেখে দিল। এরপর তার নানান ভাবনা আরম্ভ হলো। রাত হতেই মনে হতো, ‘এই বুঝি চোর আসছে!’ সামান্য শব্দেই সে ভয় পেতে শুরু করল। সারা রাত ঘুমাতে না পেরে টাকার থলেটা নিয়ে সেই ব্যবসায়ীর বাড়ি গিয়ে সে বলল, ‘এই রইল তোমার টাকা! এর চেয়ে আমার গান আর ঘুম ঢের ভালো!’
বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ। আমাদের আয় কম ব্যয় বেশি। প্রতিবছর অর্থমন্ত্রীর বাজেট করতে হিমশিম খেতে হয়। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি। লেনদেনের ভারসাম্য প্রায়ই ঠিক থাকে না। সেই বাংলাদেশের থলে টাকাও না, ডলারে ভর্তি। গরিবের হাতে বেশি টাকা এলে তা যে বিপদ ঘটায় তা তো সুকুমার রায় সেই কবেই বলে গেছেন। বাংলাদেশ এখন আসলেই টাকার বিপদে পড়ে গেছে।
বাংলাদেশের বিপদ রিজার্ভ নিয়ে। এখন সারা বিশ্বে আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরি নিয়ে। আমাদের আফসোস ছিল বাংলাদেশ এত ভালো করছে কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্ট-এর মতো পত্রিকায় আমাদের নিয়ে তেমন কিছু লেখা হয়নি বললেই চলে। আর এখন প্রতিদিন বিশ্বের সব বড় বড় পত্রিকায় বাংলাদেশ নিয়ে লেখা যাচ্ছে, বিশ্লেষণ হচ্ছে, বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। আমরা যত দেখছি, খুশি না হয়ে বরং লজ্জিত হচ্ছি। নেতিবাচক সংবাদ কেইবা পছন্দ করে।
রিজার্ভ বিষয়টি কী শুরুতে জেনে নিই। রিজার্ভ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। দেশের মধ্যে কোনো কিছু কেনাকাটা করতে হলে টাকা হলেই হবে। কিন্তু দেশের বাইরে তো আর টাকা চলবে না। আমাদের দেশে কোনো তেলের খনি নেই। কিন্তু জ্বালানি তেল ছাড়া তো এক দিনও চলবে না। কিনতে হয় ভোজ্যতেল থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু। একটা কলকারখানা দিলেও তার যন্ত্রপাতি কিনতে হয়।
বিদেশ থেকে এই সব কেনাকাটার নাম হচ্ছে আমদানি। এই আমদানি ব্যয় করতে প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা। কারণ, বিদেশের কেউ তো আমাদের টাকা নেবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বৈদেশিক মুদ্রা কোথা থেকে আসবে। তিনটি উৎস থেকে মূলত আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারি। যেমন, রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক ঋণ। আমাদের রপ্তানি বাড়লেও এখনো তা আমদানির তুলনা কম। সুতরাং রপ্তানি করে আমরা আমদানি ব্যয় নির্বাহ করতে পারি না।
বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্যের পরিমাণও এখন বেশি নয়। সুতরাং প্রধান ভরসা হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো আয়। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় করে। সেই আয় তারা দেশে পাঠায়। বাংলাদেশের ব্যাংক সেই বৈদেশিক মুদ্রা নিজের কাছে রেখে এর সমপরিমাণ টাকা তাদের দিয়ে দেয়। এভাবে জমতে থাকে রিজার্ভ। আর তা জমতে জমতে জমতে জমতে হয়ে গেছে ২৮ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এটাকে আমরা প্রতীকী অর্থে রাজকোষও বলতে পারি।
অর্থনীতিতে বলা হয়, তিন মাসের সমান রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট। তাতে আমদানিকারকেরা স্বস্তি পান যে দেশটি পণ্য কিনলেও তার দাম পরিশোধ করতে পারবে। কিন্তু ২৮ বিলিয়ন ডলার মানে হলো প্রায় আট মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান। সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশে রিজার্ভ আছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এই রিজার্ভ তো আর বাংলাদেশ ব্যাংক ভল্টে পুরে রাখে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলো বিভিন্ন ধরনের বন্ডে বিনিয়োগ করে। এর বাইরে দৈনন্দিন কাজের জন্য নগদ অর্থ রেখে দেয় বিশ্বের প্রধান কটি দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে।
এখানে তিনটি নতুন শব্দ আমরা শিখতে পারি। তা হচ্ছে নস্ট্রো, ভস্ট্রো ও লোরো। ভয় পেয়ো না। তিনটি শব্দই ইতালিয়ান ভাষা। নস্ট্রো শব্দের অর্থ হচ্ছে আমাদের, ভস্ট্রো হচ্ছে আপনাদের ও লোরো শব্দের অর্থ তাদের। এক দেশের ব্যাংক যখন অন্য দেশের ব্যাংকে তাদের মুদ্রায় অর্থ জমা রাখে তখন তাকে বলে নস্ট্রো হিসাব। আর নিজের কারেন্সি বা মুদ্রায় রাখলে তাকে বলে ভস্ট্রো হিসাব। আর তৃতীয় কোনো ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে সেটিকে বলা হয় লোরো হিসাব। বাংলাদেশের যে অর্থ চুরি গেছে সেটি নস্ট্রো হিসাবের টাকা। দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য এই অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
এখন বাংলাদেশ পদ্মা সেতু তৈরি করছে। এ জন্য বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ধরো সেই পরামর্শক জাপানে থাকে। বাংলাদেশ জাপানের ওই পরামর্শককে তার কাজের অর্থ পরিশোধ করবে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে। নিয়মটি হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নিউইয়র্ককে বলবে জাপানের ওই পরামর্শককে অর্থ পাঠিয়ে দিতে। পুরোটাই হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এই লেনদেনের কিছু নিয়ম আছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা ডিলিং রুম আছে। ডিলিং রুমে লেনদেনের জন্য তিনটি বিভাগ কাজ করে। যেমন, ফ্রন্ট অফিস বার্তা তৈরি করে, মিডল অফিস বার্তাটি পাঠায় এবং ব্যাক অফিস লেনদেন ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা তদারক করে। সুতরাং তিন কর্মকর্তার প্রয়োজন পড়ে লেনদেনের বার্তা পাঠাতে।
লেনদেনটি যাতে নিরাপদ হয়, এ জন্য একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়। এর নাম হচ্ছে সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন)। এটি হলো বেলজিয়ামভিত্তিক আন্তব্যাংক আর্থিক লেনদেনের নেটওয়ার্ক। এর মাধ্যমে আন্তব্যাংক লেনদেনের পরিচিতি শনাক্ত করা হয়, যা মূলত সংকেতলিপি তথা কোডের মাধ্যমে করা হয়। এ ক্ষেত্রে লেনদেনের তারবার্তা (ওয়ার) এই কোডের মাধ্যমে আদান-প্রদান করা হয়। খুব সহজ করে বললে, অনেকেই হয়তো সিন্দুক দেখেছ। এই সিন্দুক খোলার জন্য চাবি দরকার হয়। এখন আর সেই সিন্দুকের যুগ নেই। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সেটি সম্ভবও নয়। এখন চাবির বদলে আছে সংকেত সেটিকে আমরা পাসওয়ার্ড বলতে পারি। এই কোডটি সঠিক ও নিরাপদভাবে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে সুইফট।
কেউ একজন যেভাবেই হোক গোপন সেই বার্তা বা কোডটি পেয়ে গেছে। এই চোরদের আমরা বলি হ্যাকার। পুরো লেনদেনটিই হয় কম্পিউটারের মাধ্যমে, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। ফলে নিজের চেহারা আড়াল করেই চুরি করা সম্ভব। আড়ালে থাকা এ রকম এক বা একাধিক চোর চাবি পেয়ে গেলে যা হয়, চুরি করে নিয়ে গেছে অর্থ। আর এই চুরিকেই বলা হচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুরির ঘটনা। এখন আর সেই বন্দুক নিয়ে ব্যাংক ডাকাতির যুগ নেই। এখন ব্যাংক ডাকাতি করছে হ্যাকাররা। সন্দেহ নেই অনেক দিন ধরে আলোচনা চলবে এই অর্থ চুরি নিয়ে। আর দেখা যাক টাকার বিপদ থেকে আমরা বের হতে পারি কি না।