শুভ কাজ শুরু করতে হয় হাসিমুখে। প্রাচীন মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিল তা-ই। তবে কোনো কাজ শুরুর আগে সবার যদি হাসি না পায়? ফারাওয়ের কড়া নির্দেশ ছিল, হাসতেই হবে সবাইকে। এমনিতে না হাসলে হাসাতে হবে। সেই কাজটা করতেন সংয়েরা। ২৪০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকেই মিসরে চালু ছিল এ ব্যবস্থা।
ধরে নিলাম, বন্ধুমহলে সবাইকে হাসানোর কাজটা তোমারই। কেউ পরীক্ষায় ফেল মেরেছে, কেউ বড় বোনের সঙ্গে খুব একচোট ঝগড়া করে এখন মন খারাপ করে বসে আছে। কেউ আবার যাকে চাইছে ‘বিশেষ বন্ধু’ হিসেবে তার কাছে ঠিকঠাক পাত্তা পাচ্ছে না। এরা সবাই মাথাটা এগিয়ে দেবে তোমার কাঁধেই। তোমার কাজ শুধু সান্ত্বনা বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়া নয়, তাদের মুখের হাসিটাও ফিরিয়ে দেওয়া।
নিজেকে ভাঁড় ভাবতে ঠিক কেমন কেমন লাগছে তাই না? সংদের কাজ কী? এককথায় বলা যায়, হাসানো। তাদের পোশাক-আশাক দেখলেই তো হাসি পাবে। সং বা ক্লাউন কথাটা শুনলেই মনে পড়ে, সাদা রংমাখা মুখ, বিশাল লাল নাক, ঢিলেঢালা রংচঙে পোশাক, পায়ে বেঢপ জুতা। তুমি তো আর সেসব করছ না। তবে তা করলেই যে সফল হবে তারও নিশ্চয়তা নেই। লোক হাসানোর কাজ অত সহজও নয়।
সংদের রীতিমতো আইনকানুন মেনে চলতে হয় তাঁদের পেশায়। নির্দিষ্ট কিছু দক্ষতাও প্রয়োজন হয়। ক্লাউনস অব আমেরিকা, ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইট ঘেঁটে খুঁজে বের করা গেল নিয়মগুলো। পোশাক আর মেকআপ পরে থাকা অবস্থায় উন্নত রুচির পরিচয় দিতে হবে। কাউকে বিব্রত করা যাবে না, বরং নিজেকেই হাসির খোরাক করে তুলতে হবে। এ অবস্থায় নিজের পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। ধূমপান বা পানীয় গ্রহণ করা যাবে না। পারফরম্যান্স শেষে যত দ্রুত সম্ভব পোশাক বদলে ফেলতে হবে। এ রকম আরও নানা কিছু।
সং মানেই সাদা রংমাখা মুখ তা-ও নয়। বরং পোশাক আর মেকআপ অনুযায়ী আলাদা নামও আছে তাঁদের। যেমন হোয়াইটফেস ক্লাউনরা করেন সাদা মেকআপ। তাঁদের পোশাক-আশাকও থাকে বেশ মজার। এই ধারাকে জনপ্রিয় করেন জোসেফ গ্রিমালডি। ১৮০০ সাল থেকে ব্রিটেনে তুমুল জনপ্রিয়তা পান তিনি। তাঁর আত্মজীবনী সম্পাদনা করার জন্য ডাক পড়ে বিখ্যাত লেখক চার্লস ডিকেন্সের। মেমোয়ারস অব জোসেফ গ্রিমালডি নামে সেই বইটি প্রকাশিত হয়। গ্রিমালডির পোশাক, মেকআপ আর পারফরম্যান্সের ধরন আজও অনুসরণ করেন অনেক সং।
এরপর বলা যায় ‘অগাস্টে ক্লাউন’দের কথা। সাদা নয় বরং লাল, গোলাপি বা বাদামি রঙের মেকআপ নেন তাঁরা। লাল বা কালো রং দিয়ে অতিরঞ্জিত করে আঁকেন নাক, চোখ বা ভ্রু। হয় খুব ঢিলে, নয় বেশ আঁটসাঁট পোশাক পরেন তাঁরা। সার্কাস বা পারফরম্যান্সের সময় দেখা যায়, হোয়াইটফেসদের নির্দেশনা মেনে চলেন তাঁরা। আর সেটা করতে গিয়েই বাধে নানা বিপত্তি, ঘটে মজার সব দুর্ঘটনা। এভাবেই মানুষ হাসান তাঁরা। ‘হ্যাপি ক্লাউন’ও বলা হয় এঁদের।
আরেক ধারার সং আছেন, তাঁদের বলা হয় ‘ক্যারেক্টার ক্লাউন’। পুলিশ, রুটিওয়ালা, কসাই এমন কোনো পেশা ধরে মজার নানা কাণ্ড করেন এঁরা।
এ তো গেল সার্কাস বা পারফরম্যান্সের কথা। অভিনয়েও কম যান না সংয়েরা। সবাক বা নির্বাক দুই রকমই পারফরর্ম করেন তাঁরা। তবে সবাই এই ধারাগুলো মেনেই কাজ করেন তা-ও না। সর্বকালের সেরা এক সংয়ের পোশাক-আশাক কিন্তু অন্য রকম ছিল। কোনো বাহুল্য নয়, রঙের বাহারও নয়। স্রেফ মুখভঙ্গি দিয়েই তিনি জয় করেছিলেন সবাইকে। তাঁর নির্বাক অভিনয়ই তাক লাগিয়েছিল সে সময়ের মানুষদের। তিনি চার্লি চ্যাপলিন।
এ সময়ে সংদের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো হসপিটাল ক্লাউনিং। হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে অসুস্থ শিশুদের আনন্দ দেন তাঁরা। প্যাচ অ্যাডামস নামের একজন চিকিৎসক সত্তরের দশকে শুরু করেন এ ধারা। তাঁকে নিয়ে প্যাচ অ্যাডামস নামে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবিন উইলিয়ামস।
জানলে তো সংদের পোশাক আর কাজকারবার নিয়ে নানা কথা। এবার কি সহজ হয়েছে তোমার কাছে মানুষকে হাসানোর কাজটা? শুধু পোশাক বা মেকআপ নয়, ক্ষুরধার বুদ্ধিও কিন্তু রাখেন সংয়েরা। আমাদের গোপাল ভাঁড় বা বীরবলের কথাই ধরো না। নাসিরুদ্দীন হোজ্জাও কম যান না। এঁরা অবশ্য ঠিক সং নন। তবে রাজাকে হাসানোর দায়িত্বটা ছিল তাঁদের কাঁধেই।
তবে সংসমাজের নায়ক বলা যেতে পারে চীনা সং ইউ জিকে। ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনা রাজা কিন শি হুয়াংয়ের খায়েশ হলো চীনের প্রাচীরটা তিনি ধবধবে সাদা রং করাবেন। রাজসভার সবাই বুঝতে পারছিলেন রাজার শখ মেটাতে গিয়ে অহেতুক প্রাণ যাবে অনেক শ্রমিকের। কারণ সে সময়ে কাজটায় নিরাপত্তা ঝুঁকি ছিল অনেক। প্রাচীর নির্মাণ করতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন কত মানুষ। তবে সেটা রাজাকে বুঝিয়ে বলার মতো মাথা কারও ঘাড়েই ছিল না। তখন এগিয়ে এলেন এই ইউ জি। ভাঁড়েরা একটু ঠোঁটকাটা হবেই, সেটা মেনে নিয়েছিলেন রাজা। তাই মেনেও নেন ইউ জির কথা। এভাবেই বেঁচে যান হাজারো শ্রমিক।
তবে শখ করে রং মেখে সং সাজা আর সংয়ের মতো দেখানো কিন্তু এক কথা নয়। পোশাক-আশাক ঠিকঠাক না হলে আমরা অনেক সময় বলেই ফেলি, ঠিক সং যেন! তুমি নিশ্চয়ই চাও না এ পরিস্থিতিতে পড়তে। আর সে জন্য জেনে নাও পোশাক পরার কিছু কায়দাকানুন। প্রথম কথা, পোশাকটি তোমার সঠিক মাপের হতে হবে। খুব ঢিলে বা আঁটসাঁট কোনোটিই হওয়া চলবে না। সংরা যে জুতা পরে লোক হাসান, সেই বেঢপ জুতাটাও কিন্তু খুব সাবধানতার সঙ্গে তাঁর পায়ের মাপ অনুযায়ী বানানো হয়। দুই, ত্বকের স্বাভাবিক রংটাই যেন থাকে। রংচং মেখে বেশি ফরসা বা নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। তিন, হাল ফ্যাশনে যা চলছে তা তোমাকে পরতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। সেই বিশেষ ট্রেন্ডটি তোমাকে মানাচ্ছে কি না তা আগে দেখ। কখনোই এমন পোশাক পরবে না, যা পরে তুমি আরাম বোধ করো না।
তোমার স্কুল-কলেজে বা বন্ধুমহলে এমন কেউ থাকতেই পারে যার পোশাক-আশাক তোমার কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। তাই বলে তার মুখের ওপরই তুমি সেটা বলতে পারো না। খুব কাছের বন্ধু হলে বুঝিয়ে বলতে পারো, তাকে এভাবে মোটেও মানাচ্ছে না। তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলে কিন্তু তোমার ব্যক্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে।