শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। হরহামেশাই এমন খবর পাওয়া যায়। তবে রাষ্ট্রের ঋণখেলাপি হওয়ার কথা সচরাচর শোনা যায় না। সম্প্রতি এমনটাই ঘটল। ২০০৬ সালের পর দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ শ্রীলঙ্কা এখন খেলাপি।
প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে এর প্রভাব পড়ে মালিক ও কর্মীদের ওপর। কিন্তু রাষ্ট্র ঋণখেলাপি হলে জনগণের ওপর কতটা প্রভাব পড়তে পারে, তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
সব দেশ সব ওষুধ তৈরি করতে পারে না। অনেক ওষুধ আমদানি করতে হয়। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয়ায় দেশটি এখন অনেক ওষুধ আমদানি করতে পারছে না। ফলে অনেক জটিল রোগ যেমন ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ পাচ্ছেন না রোগীরা।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। এরপর মুঠোফোনের আলোয় চলে সেই অস্ত্রোপচার। এখানেই শেষ নয়। চেতনানাশকসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ ও বিদ্যুৎ না থাকায় শ্রীলঙ্কার হাসপাতালগুলোয় শুধু সাধারণ অস্ত্রোপচার চলছে এখন। জটিল সব অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখতে হয়েছে।
অর্থের অভাবে সরকার জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না। ফলে এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে ১৩ ঘণ্টা করে দৈনিক লোডশেডিং চলছে দেশটিতে। ডিজেলের মজুত ফুরিয়ে গেছে আগেই। ফলে ১ এপ্রিল দেশটির কোথাও ডিজেল বিক্রি হয়নি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে এলে গাড়ির তেল খরচ হবে। তাই হোম অফিস দেওয়া হয়েছে। আবার অর্থসংকটের কারণে খাবার আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে খাদ্যসংকটও দেখা দিয়েছে।
যেভাবে সংকটের শুরু
বলা হচ্ছে, ২০১২ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঠিকঠাক ছিল। ২০১২ সাল থেকে পূর্ববর্তী এক দশকে দেশটির মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এমনকি সেই সময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলার ছিল শ্রীলঙ্কার। কিন্তু বড় ধাক্কাটা আসে ২০১৯ সালে। ওই বছর কলম্বোয় তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দেশি–বিদেশিসহ মারা যায় ২৫০ মানুষ। ইস্টার সানডেতে ওই হামলার ঘটনা ঘটে। ফলে ধস নামে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাতে। আয় কমে যায় দেশটির।
পর্যটন খাত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস শ্রীলঙ্কার জন্য। কারণ, নানা দেশের পর্যটকেরা এই দেশে ভিড় করেন। তাই এই খাতে ধস নামায় বৈদেশিক আয় কমে যায়। আর বৈদেশিক আয় কমায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে যায়।
ওই বছরই আরেকটি ঘটনা ঘটে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ ধার্য করেন। এর প্রভাবও পড়ে সরকারের আয়ে। কারণ, সরকারের ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ কমে যায়। যদিও সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস হলো এই ভ্যাট।
শ্রীলঙ্কার সরকার অহেতুক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এমনটা নয়। গোতাবায়া সরকারের জনপ্রিয়তা কমছিল। কিন্তু ২০২০ সালে ছিল পার্লামেন্ট নির্বাচন। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং নির্বাচনে জিততে এই পথে হাঁটে সরকার। গোতাবায়া সফল হয়েছেন। তাঁর ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির অর্থনীতি।
এখানে থামলেও হয়তো শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি সামলে নিতে পারত। কিন্তু এরপরই আসে করোনার মহামারি। পর্যটনের যেটুকুও সচল ছিল, তা–ও বন্ধ হয়ে যায় এই মহামারির কারণে। এ ছাড়া প্রবাসী আয় কমে যায়।
অর্থাৎ ২০১৯ ও ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার আয়ের উৎস নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এরপর আবারও ভুল পথে হাঁটেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। তাঁর কারণে ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার কৃষি খাত বড় ধাক্কা খায়। ওই বছর রাসায়নিক সার আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। সরকার চেয়েছিল, তারা বিশ্বের প্রথম দেশ হবে যারা কিনা ‘শুধু অর্গানিক’ উপায়ে কৃষিপণ্য উৎপাদন করে। ওই সময় প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, রাসায়নিক সার থেকে বেরিয়ে এলে ২০ কোটি ডলার আমদানি খরচ কম হবে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে। কিন্তু এই তত্ত্ব কাজে আসেনি। সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে ২৫ শতাংশ কৃষিজ উৎপাদন কমে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃষিপণ্য উৎপাদন ৭০ শতাংশ পর্যন্তও কমেছে। অর্থাৎ যে জমিতে ফসল হতো ১০০ কেজি, সেই কৃষি ফসল কমে আসে ৭৫ কেজিতে। ক্ষেত্রবিশেষে এই ফসলের পরিমাণ ৩০ কেজিতেও নেমে আসে। ফলে এই খাতে আয় কমে যায়।
উৎপাদন কমলে মানুষ না খেয়ে থাকবে, এমনটা তো নয়। তাই যেসব ফসলের উৎপাদন কমেছিল, সেসব ফসল আবার দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়েছে। অর্থাৎ সরকার বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমানোর জন্য যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা হিতে বিপরীত হয়েছে। কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ায় এই খাতে আমদানি বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বেড়েছে।
বাজারের চিত্র
এই ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়া ও দেশে কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে সাধারণ জনগণের ওপর কী প্রভাব পড়েছে, তার চিত্রটি লক্ষ করা যেতে পারে নিত্যপণ্যের দাম থেকে। শ্রীলঙ্কায় ২০১৯ সালের মার্চে মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মকের ঘরে। অর্থাৎ ২০১৮ সালে নিত্যপণ্যের দাম যত ছিল, তার চেয়ে দাম কমেছিল ২০১৯ সালে।
কিন্তু চলতি বছরে এসে এই চিত্র বদলে যায়। ২০১৯ সালের তুলনায় এ বছর চালের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মুরগির দাম বেড়েছে দেড় গুণ, কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়েছে। গরুর মাংসের দাম দেড় গুণ হয়েছে। নারকেলের দাম বেড়েছে ৮১ শতাংশ। পেঁয়াজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। টমেটোর দাম বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। ২০১৯ সালের মার্চে যে টমেটোর দাম ছিল ১০৫ শ্রীলঙ্কান রুপি (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৭ টাকা), ২০২২ সালের মার্চে এসে সেই টমেটোর দাম হয়েছে ৩১০ রুপি (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮০ টাকা)। ২০১৯ সালে হলুদের দাম ছিল প্রতি কেজি ৬৫৯ রুপি (১৭০ টাকা), ২০২২ সালে এসে এই হলুদের দাম হয়েছে ৩ হাজার ৫৮৩ রুপি (৯২২ টাকা)।
২০২১ সালে শ্রীলঙ্কায় পেট্রলের দাম ছিল ১৩৭ শ্রীলঙ্কান রুপি (৩৫ টাকা), ২০২২ সালে এসে তার দাম হয়েছে ২৫৪ রুপি (৬৫ টাকা)। আর এক বছরের ব্যবধানে ডিজেলের দাম ১০৪ রুপি (২৭ টাকা) থেকে ১৭৬ রুপি (৪৫ টাকা) হয়েছে। ২০২১ সালে গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত সাড়ে ১২ কেজি এলপিজি গ্যাসের দাম ছিল ১ হাজার ৪৯৩ শ্রীলঙ্কান রুপি (৩৮৪ টাকা)। চলতি বছরে এসে তা হয়েছে ২ হাজার ৭৫০ রুপি (৭০৭ টাকা)।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে টাকা থাকলেই যে একজন পণ্য কিনতে পারবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সংকটের সমাধান কী
এই সংকট সমাধানে প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের প্রতি দেশে অর্থ পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে সরকার। এ ছাড়া বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ভ্যাট বাড়ানোর কথা বলছেন অনেকে। অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজগুলো যে সহজে করে ফেলা যাবে, এমন তো নয়। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, কারও হাতে এমন কোনো জাদুর কাঠি নেই, যেটা দিয়ে শ্রীলঙ্কা সংকটের সমাধান এক রাতের মধ্যেই হয়ে যাবে।
এই সংকটের সমাধান যদি রাতারাতি না হয়, তাহলে কী হবে? আবারও শ্রীলঙ্কার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বা চিকিৎসার জন্য অপেক্ষাধীন রোগীদের কথা বলা যেতে পারে। দেশটিতে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই ওষুধ কিনতে পারছেন না। অস্ত্রোপচার হচ্ছে না অনেকের। তবে কি মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মরবে?
শ্রীলঙ্কার মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এ কারণেই কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নেমেছেন সাধারণ মানুষ। পুলিশের গুলিতে মানুষও মরছে। কিন্তু এই সংকট সমাধানের রাস্তা জনগণের হাতে নেই। কারণ, জনগণ নীতিনির্ধারণ করে না। আর নীতিনির্ধারকেরা যে তাঁদের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন, এমনটা নয়। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার বিরুদ্ধে জনগণ মাঠে নেমেছে, কিন্তু তিনি এখনো পদ থেকে সরেননি। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার সবাই পদত্যাগ করলেও গোতাবায়ার ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী পদে রয়ে গেছেন।