আজ থেকে ১০০ বছরেরও আগের কথা। ঢাকা শহরের পিলখানা এলাকায় একটি বাগান ছিল। নাম নবাব রশিদ খানের বাগান। এখন অবশ্য ওই বাগান নেই, গাছপালাও নেই। বড় বড় দালানকোঠায় ভরে গেছে সেই জায়গা। একবার সেই বাগানে হঠাৎ করেই পাওয়া গেল কিছু প্রাচীন মুদ্রা। সেগুলোর বিবরণ ১৯১০ সালে ছাপাও হলো। পণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গেল। শেষমেশ পণ্ডিতেরা বললেন, ওগুলো ছিল খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের খড়গ রাজাদের আমলের।
এ কথা কে না জানে যে টাকাপয়সা মানুষ নিজেদের সঙ্গে রাখে। তাই খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক, মানে আজ থেকে ১ হাজার ৩০০ বছরেরও আগের সেই খড়গ যুগে এখানে মানুষের বসবাস ছিল বলেই মনে হয়। তবে যদি মুদ্রাগুলো অন্য কোনোভাবেও ওখানে এসে থাকে? তাহলেও কি ঢাকায় প্রাচীনকালের মানুষের বসবাস এবং উন্নত জনপদ গড়ে তোলার নিদর্শন মেলেনি? মিলেছে। যেমন: তেজগাঁওয়ে পাওয়া হরিশঙ্কর মূর্তি, মহাখালীতে প্রাপ্ত প্রাচীন মূর্তি, চুড়িহাট্টার বাসুদেব মূর্তি। এ ছাড়া ডালবাজারে একটা চণ্ডীমূর্তিও পাওয়া গেছে। এগুলোর প্রতিটিই পাথরের তৈরি। আর প্রায় হাজার বছরের মতো পুরোনো বলে ধারণা করা হয়। এরপর এল সুলতানি আমল। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই আমল ধরা হয়। এই সময়ের অন্তত পাঁচটি মসজিদের শিলালিপি পাওয়া গেছে ঢাকা শহরের নানান জায়গা থেকে। সেগুলো হলো: নসওয়ালগলি মসজিদ, বিনত বিবির মসজিদ, মিরপুরের মসজিদ, মাণ্ডার মসজিদ আর বাবুবাজার মসজিদে রাখা সুলতানি আমলের মসজিদের শিলালিপি। তার মানে সুলতানি আমলেই ঢাকা শহরের নানান জায়গা থেকে এতগুলো পাকা মসজিদ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, শিলালিপি বা শিলালেখ হলো পাথরে খোদাই করা বিবরণ। সেকালে কাগজ আবিষ্কৃত হয়নি। তাই বড় কোনো দালানকোঠা বানালে সেসবের বিবরণ, নির্মাতার নাম-পরিচয়, রাজা-বাদশাহর নাম, নির্মাণ সন এসব কথা পাথরে খোদাই করে লিখে রাখত মানুষ।
অর্থাৎ বোঝা গেল, ঢাকায় মোগল আমলে রাজধানী স্থাপনের অনেক আগে থেকেই এখানে দালানকোঠা তৈরি হয়েছিল। অন্যভাবে বলা যায়, ছোটখাটো হলেও এখানে একটি শহরের অস্তিত্ব ছিল। মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আমলে ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপিত হওয়ার সময়ও কিন্তু ঢাকায় একটি সেনাছাউনি, দুর্গ এসব ছিল। মোগল আমলের ঢাকার প্রথম সুবাদার ছিলেন ইসলাম খান চিশতি। তিনি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় এসেছিলেন। তখনকার ঘটনাবলির বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর এক সেনাপতি মির্জা নাথানের লেখায়। তিনি সে সময় সংঘটিত ঘটনাবলির বিবরণ দিয়ে বাহারিস্তান-ই-গায়বি নামের যে বিখ্যাত বইটা লিখেছিলেন, তাতেই এসব বর্ণনা আছে। সেই বর্ণনায় ‘ঢাকা’ নামটার বারবার উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য তখনকার মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের নামানুসারে শহরটার নামকরণ করা হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর। কিন্তু তা কাগজে-কলমেই। লোকমুখে চালু ছিল সেই পুরোনো ঢাকা নামটাই। এই বই থেকেই জানা গেছে, ইসলাম খান ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই যে সেখানকার সেনাছাউনিতে একজন কর্তাব্যক্তি বা থানাদার ছিলেন।
কাজেই ঢাকা নামের শহরটি আগে থেকেই ছিল। কোনো বিরানভূমিতে না বানিয়ে সেই পুরোনো শহরেই মোগলেরা রাজধানী বানিয়েছিল। এর অবশ্য কারণও ছিল। আসলে বহুদিন ধরে চেষ্টা করেও পুরো বাংলায় কিছুতেই মোগল রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছিল না। তাই খাল-নদীতে ভরা বাংলাদেশের একেবারে প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন তাঁরা। বাংলার স্বাধীনচেতা বারো ভূঁইয়াদের দমন করা সহজ হবে বিবেচনা করেই ঢাকাকে মোগলেরা বেছে নিয়েছিল।
ঢাকা থেকে চারদিকে অভিযান চালিয়ে পুরো বাংলাকে মোগল রাজত্বের মধ্যে আনা সত্যি সত্যিই সম্ভব হয়েছিল। তা ছাড়া ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে জোয়ার-ভাটা খুব ভালোভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। আবার ঢাকা থেকে বাংলার যেকোনো প্রান্তেই নদীপথে যাওয়া সম্ভব ছিল। আর ঢাকা ছিল উঁচু। ফলে বন্যার পানি তেমন উঠত না। শহরের মধ্যেও ছিল ছোট ছোট খাল। এটি যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য খুব সহায়ক ছিল।
ইসলাম খান ঢাকায় বেশ আটঘাট বেঁধেই এসেছিলেন। সৈন্যসামন্ত শুধু নয়, রাজধানীর অফিস-আদালত চালানোর জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারী তিনি সঙ্গে এনেছিলেন। এমনকি গানবাজনার জন্য লোকজনও সঙ্গে এনেছিলেন তিনি। বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আমলেই ঢাকায় স্থাপিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর টাঁকশাল। এর আগে বা পরে ঢাকা শহরে আর কোনো দিনও কোনো টাঁকশাল স্থাপিত হয়নি। ওই টাঁকশাল থেকে মোগল যুগে অনেক মুদ্রা তৈরি হয়েছিল। সেই টাঁকশাল, সুবাদারদের প্রাসাদ, নগরকেন্দ্র চকবাজার-উর্দু রোড সবই আজকের দিনের পুরান ঢাকায় অবস্থিত ছিল। অন্য কথায়, যেখানে মোগল রাজধানী ঢাকা অবস্থিত ছিল, সেই জায়গাটাই আজকে পুরান ঢাকা নামে পরিচিতি পেয়েছে।