যে মেয়েটি স্বপ্ন দেখতে জানত!

মা কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে লারা

নিঃসীম ওই নীলাকাশ আমাদের অনেকেরই ভীষণ প্রিয়। অনেকেই দেখি আকাশজয়ের স্বপ্ন। দূরের আকাশ দেখতে দেখতে সেখানে মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই মেয়েটিও। কিন্তু শুধু স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত হননি। শৈশব থেকেই স্বাধীনচেতা স্বভাবের সেই আকাশপ্রেমী কন্যা রানওয়ে থেকে ঠিক উড়াল দিয়েছিলেন মেঘের ঠিকানায়। অদম্য ইচ্ছা আর আত্মবিশ্বাসের ডানায় ভর করে তিনি জয় করেছিলেন আকাশরাজ্য!

আকাশপ্রেমী যে প্রত্যয়ী তরুণীর কথা বলছি তাঁর নাম ‘ফারিয়া লারা’। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসের ১৬ তারিখ তার জন্ম। লারার অনেক পরিচয়। বাবা আনোয়ার হোসেন ও কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মেয়ে তিনি। অথচ লারা কখনোই চাননি মা-বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতে। তাই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার সময়েই ফ্লাইং একাডেমি এয়ার পারাবতের অধীনে ফ্লাইং শেখা শুরু করেন তিনি। বিমানচালকের পেশা এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ, তার ওপর একটি মেয়ে যখন সে পেশায় আগ্রহী হন, তখন চারপাশ থেকে অনেক বাধা আসে। অথচ এ সবকিছুই লারাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। লারা বলতেন, আমি জানি আমাকে কতটুকু এগোতে হবে, কোথায় থামতে হবে। এই পরিমিতিবোধ, স্বপ্নপূরণের প্রবল আকাঙ্ক্ষা আর নিষ্ঠার জোরেই তিনি ৫০ ঘণ্টা ফ্লাইং আওয়ার সম্পন্ন করেন। ঠিকই নাম লিখিয়েছিলেন বিমানচালকের খাতায়। এরপর কাজপাগল সেই তরুণী দেশের প্রথম নারী ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হওয়ার লক্ষ্যে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন।

সব ছাপিয়ে লারা সময়ের আগে এগিয়ে চলা একজন। ১০ বছর বয়সেই বিটিভির খুদে সংবাদ পাঠিকার তালিকায় নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। হলিক্রস কলেজে পড়ার সময় ছিলেন তুখোড় এক তার্কিক। খণ্ডকালীন সাংবাদিকতা, বিভিন্ন এনজিওর অধীনে দেশের নানা সমস্যা নিয়ে জরিপ, গবেষণা—এসব কাজও তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে করতেন। সহজেই মানুষকে আপন করে নেওয়ার এক অসাধারণ ক্ষমতাও ছিল লারার। দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে নীলফামারীর প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে যেমন তিনি গড়ে তুলেছিলেন সহজ সম্পর্ক, তেমনি কোনো আন্তর্জাতিক সেমিনারের ভিনদেশিদের সঙ্গেও সহজেই হয়ে উঠত তাঁর দারুণ সখ্য।

লারা ছিল আকাশে ডানা মেলা পাখি

১৯৯৮-এর ২৭ সেপ্টেম্বর। রোজকার মতো প্রশিক্ষণ বিমান প্রিয় লিটল ওয়ান্ডার নিয়ে লারা উড়াল দিলেন আকাশে। সঙ্গে ছিলেন কো-পাইলট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। পোস্তগোলার শ্মশানঘাটের কাছে আসতেই হঠাৎ আগুন ধরে গেল বিমানটির ইঞ্জিনে। আকাশে ডিগবাজি খেয়ে দ্রুত বেগে মাটিতে এসে পড়ল লিটল ওয়ান্ডার! শেষবারের মতো লারার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো মে ডে কল (বিপদগ্রস্ত বিমানের প্রেরিত বার্তা)—‘উই আর...।’ তারপরই লারা হয়ে গেল অতীতের এক নাম।

প্রশিক্ষণ বিমানটির যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এভাবেই অকালে ঝরে গেল লারার মতো এক প্রতিভাময়ী। তবু লারা বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ মেয়েটির আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে, বিমানবাহিনীর প্রতিটি নারী পাইলটের সাফল্যের গল্পে। বহুদূর থেকে লারা আজও আমাদের শেখান জয়ের মন্ত্র।

তথ্যসূত্র: লারা—সেলিনা হোসেন ও ফারিয়া লারা স্মারক গ্রন্থ