হাসি, কান্না, রাগ, অবাক, ভয়—এই অভিব্যক্তিগুলোই মূলত মানুষকে আলাদা করেছে সব প্রাণী থেকে। কারণ, অন্য কোনো প্রজাতি এসব অনুভূতির প্রকাশ নিজের চেহারা দিয়ে করতে পারে না।
যারা ওপরের কথাটা পড়ে মাথা নাড়লে, তারা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখো ছবিগুলো। বিশেষত ওপরের ছবিটা, কুকুরটা নিজেই আমার তত্ত্বে অভিব্যক্তি জানাল। বুড়ো আঙুল দেখাল বিজ্ঞানকে। ছবিতে যাকে দেখতে পাচ্ছ, তার নাম জেন। কর্গি জাতের কুকুর সে। বাড়ি জাপানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন মিমে তাকে দেখতে পাওয়া যায়। নানান অভিব্যক্তি বোঝাতে ব্যবহার করা হয় তার ছবি। সেই সঙ্গে সেগুলো চমৎকারভাবে প্রকাশ করে অনুভূতি। অদ্ভুত চেহারার কারণে দ্রুতই সে পেয়ে গেছে তুমুল জনপ্রিয়তা। এই লেখা যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত ইনস্টাগ্রামে তার অনুসারী দুই লাখ ছাড়িয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, আদুরে ছটফটে কুকুরটার ভক্তের সংখ্যা মোটেও কম নয়। তবে এই ভক্তরা আর দেখতে পাবেন না জেনের নতুন কোনো ছবি। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে।
মানুষের আশপাশে থাকতে ভালোবাসত জেন, আপন করে নিয়েছিল সবাইকে। সদা হাসিখুশি জেন ছিল আর দশটা কুকুরের চেয়ে একটু আলাদা। শুধু চেহারার জন্য নয়, জন্ম থেকেই ও একটা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত; যার নাম হেরেডিটারি ক্রনিক রেনাল ফেইলিউর। সোজা ভাষায় অসুখটা কিডনির। ফলে একটু পরপর তৃষ্ণা পাওয়া ছাড়াও নানান অসুবিধা নিয়ে তাকে চলতে হতো। শুধু তা–ই নয়, খিঁচুনিসহ নানা জটিল উপসর্গ দেখা দিয়েছিল জেনের শরীরে। জন্মের প্রথম দিন থেকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যেতে হতো ওকে। সপ্তাহে তিনবার কিডনি ডায়ালাইসিস, চারটা ইনজেকশন, ছয় ধরনের ওষুধ—বুঝতেই পারছ, কী ব্যয়বহুল চিকিৎসা! তবু জেনকে সুস্থ রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন তার মালিক। তিনি জানতেন, রোগে ভোগা জেনের কাছে সময় খুব কম। তবু হাল ছাড়েনি জেন। আর সবাইকে ভরসা দিয়েছে সে। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে গেছে হাসিমুখে। হার মানার বিষয়টা কুকুরটার ধাতেই নেই। কঠিন অসুখ বাধিয়ে দিব্যি হেসেখেলে বেড়িয়েছে। ছোট্ট জীবনে অনেক আনন্দ করে ক্ষতি পোষানোর চিন্তা। অজস্র মানুষের ভালোবাসা নিয়ে জেন হাসত, অবাক হতো, দেখাত কপট চিন্তা। আর ক্যামেরায় ধরা পড়ত অমূল্য রত্নের মতো অভিব্যক্তিগুলো।
ফেব্রুয়ারির শুরুতেই হঠাৎ কুকুরটার অসুখ শেষ পর্যায়ে পৌঁছায়। ছোট্ট শরীরটা ধকল সইতে না পেরে চিকিৎসায় সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এমন সময় জেনের মালিক শেষবার তাকে নিয়ে ঘুরতে যান। অর্ধচেতনাতেও জেন উপভোগ করছিল সেই যাত্রা, হাসছিল তৃপ্তির হাসি। আমাদের সবার ভালোবাসা সঙ্গে নিয়ে ভালোবাসা দিবসেই জেন পাড়ি দিয়েছে না ফেরার দেশে। মাত্র পাঁচ বছরের জীবনে অসুখ থাকলেও কুকুরটা অসুখী ছিল না। জানত, কীভাবে পেতে হয় মানুষের ভালোবাসা। জেনে নিয়েছিল ক্ষুদ্র জীবনকে অর্থবহ করার রহস্য। মৃত্যুর পর জেনের ইনস্টাগ্রামে তার মালিক লিখেছেন, ‘এভাবেই আমরা ওকে মনে রাখব, ভয়হীন, স্বাধীন, প্রাণবন্ত। খারাপ দিনগুলোতেও আমাদের হাসাতে পারত সে। যাঁরা জেনকে ভালোবাসতেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। আমাদের স্মৃতিতে জেন বেঁচে থাকবে চিরকাল।’
জেনের জন্য কাঁদছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। হাসতে জানা কুকুরটা আর নেই, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের ফলোয়ার। পার্থিব জগতে আর হাসবে না জেন। কিন্তু ভার্চ্যুয়াল জগতে সে ছবি হয়ে বেঁচে থাকবে আজীবন। আজ থেকে বহুদিন পরও কোনো মিমে কাউকে না কাউকে হাসাবে জেন। সে হয়তো জানবেও না, জেন নামের যে কুকুর হাসত, সে আর পৃথিবীতে নেই।
ভালো থেকো জেন।