যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলে কেন বারবার সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে?
সম্প্রতি জর্জিয়ার অ্যাপালাচি স্কুলে হামলা করেছেন একজন বন্দুকধারী। সম্ভাব্য হামলাকারী হিসেবে এই স্কুলের ১৪ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী ও তার বাবা বিচারাধীন আছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের খবর থেকে জানা গেছে, উপহার হিসেবে সন্তানকে একটি রাইফেল দিয়েছিলেন ওই শিক্ষার্থীর বাবা। পরবর্তীকালে অ্যাপালাচি স্কুলে হামলার ঘটনা ঘটে। জর্জিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এই হামলায় দুইজন শিক্ষার্থী ও দুইজন শিক্ষক মারা যান।
স্কুলে হামলার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। শিশু থেকে বয়স্ক, সবার মনে স্কুলে হামলা নিয়ে একই প্রশ্ন, স্কুলে কেন বারবার এমন হামলার ঘটনা ঘটে? এর থেকে কি কোনো মুক্তি নেই? হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম ভি পেলফ্রে জুনিয়র এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ভিসিইউ নিউজকে বলেছেন, ‘পেশাদার দৃষ্টিকোণ থেকে আমি মনে করে, বন্দুকধারী লোকের সংখ্যা অনেক। ভুল মানুষের হাতে প্রচুর বন্দুক আছে এবং এর কিছুরই পরিবর্তন হবে না। যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে গোলাগুলির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেশি। বিশ্বের অন্য কোথাও এ ধরনের ঘটনা খুব কম ঘটে। বিশ্বে স্কুলে যত বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে, তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে।’
১৯৬৬ সালে চার্লস হুইটম্যান টেক্সাস ইউনিভার্সিটির একটি বেল বাজানোর টাওয়ারে উঠে মানুষকে গুলি করা শুরু করেন। তাঁর মস্তিষ্কে টিউমার ছিল। কোনো ধরনের প্যাটার্ন তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রগুলোর মতে, বন্দুক এখন যুক্তরাষ্ট্রে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ। ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের মতে, অন্য কোনো উন্নত অর্থনীতির দেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত আগ্নেয়াস্ত্র–সহিংসতায় মৃত্যু নেই। তাই সবার মনে একই প্রশ্ন, যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এই অবস্থায় পৌঁছেছে এবং এর সমাধান কী? এই লেখায় এ প্রশ্ন নিয়েই জানব।
কেন এমন ঘটনা ঘটছে?
প্রশ্নটি খুব সহজ হলেও এর সাধারণ কোনো উত্তর নেই। এর পেছনে কিছু রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক আইন খুব শিথিল। তাই বন্দুক সবখানে ছড়িয়ে আছে। এ দেশে মানুষের চেয়ে বন্দুকের সংখ্যা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ দশমিক ৪ কোটি। জেনেভাভিত্তিক একটি সংস্থার ছোট অস্ত্র জরিপের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, এ দেশে বন্দুকের সংখ্যা ৩৯ কোটির বেশি। বিশ্বের সর্বোচ্চ বেসামরিক বন্দুকের মালিকানা আমেরিকানদের। অন্যান্য দেশের তুলনায় এটি অস্বাভাবিক একটি সংখ্যা। এরপরে যেসব দেশের কাছে এত বেশি বন্দুক রয়েছে, তারা হলো সার্বিয়া বা ইয়েমেনের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ।
আরেকটি বিষয় হলো, স্কুলের নিরাপত্তা যতটা হওয়া উচিত, ততটা নিরাপত্তা স্কুলে নেই। স্কুলের সাধারণ সুরক্ষা বজায় রাখা সহজ হলেও এটি ভালোভাবে কাজ করে না।
এ ছাড়া স্কুলে বন্দুক হামলার আরেকটি কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সহিংসতায় উসকানি দেওয়া লোকজন অনেকের বন্ধুতালিকায় আছেন। সরকারের একটি ডানপন্থী অংশ সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয় বা উৎসাহিত করে। তারা মনে করে, ‘আমাদের দেশ হুমকির মধ্যে রয়েছে। আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে এবং দেশকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের দেশ, আমাদের জীবনধারাকে রক্ষা করার জন্য আমাদের অস্ত্র হাতে নিতে হবে।’ মার্কিন সীমান্তে এমন প্রচুর নাগরিক বাস করেন, যাঁরা সীমান্ত সুরক্ষার পক্ষের লোক হিসেবে নিজেদের দাবি করেন এবং বন্দুক নিয়ে সীমান্তে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকারীদের মোকাবিলার জন্য। নিজেরা আইন প্রয়োগকারী না হয়েও অতিক্রমকারীদের হেফাজতে নেন।
স্কুলে কারা হামলা করেন?
স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হওয়া ব্যক্তি, যাঁরা মনে করেন যে বুলিংয়ের জবাব তাঁরা দেবেন মারাত্মক সহিংসতার মাধ্যমে। আরেক ধরনের লোক স্কুলে হামলা করেন, যাঁরা সন্ত্রাসবাদী। তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উগ্রপন্থী হয়ে উঠেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে তাঁদের কর্মকাণ্ড একটি উচ্চতর কল্যাণ বয়ে আনবে। তাঁরা যা করছেন, তা নিজের জন্য নয়, বরং মহান একটি উদ্দেশ্যে। তাঁরা প্রায়ই আত্মঘাতী সন্ত্রাসীর মতো মৃত্যুবরণ করতে ইচ্ছুক থাকেন।
অনেকে আবার এই দুই ধরনের মধ্যে পড়েন না। ১৯৬৬ সালে চার্লস হুইটম্যান টেক্সাস ইউনিভার্সিটির একটি বেল বাজানোর টাওয়ারে উঠে মানুষকে গুলি করা শুরু করেন। তাঁর মস্তিষ্কে টিউমার ছিল। কোনো ধরনের প্যাটার্ন তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক কেনা কত সহজ?
যুক্তরাষ্ট্রে যে কেউ একটি বন্দুকের দোকানে গিয়ে টাকা থাকলেই বন্দুক কিনতে পারেন। ১৮ বছরের বেশি বয়সী হওয়া এবং কয়েকটি হালকা মানদণ্ড পূরণ করলেই যত খুশি তত অ্যাসল্ট রাইফেল কিনতে পারেন। বন্দুক খুব সহজে পাওয়া যায় বলে সহিংস অপরাধ করা এখানে সহজ।
বেশির ভাগ দেশে বন্দুক কিনতে পরীক্ষা দিতে হয়। প্রমাণ করতে হয় যে একটি নির্দিষ্ট কারণে ওই ব্যক্তির বন্দুক প্রয়োজন। নিরাপদে বন্দুক ব্যবহার করতে পারে কি না, বন্দুকের মালিকানা পেতে সে পরীক্ষায় পাস করতে হবে। বন্দুক পেতে হলে প্রমাণ করতে হবে কেন বন্দুকের লাইসেন্স তাঁর নিয়মিত প্রয়োজন। আমেরিকায় এসবের কিছুই হয় না। বরং টেক্সাসে দুই বছর আগে বন্দুক কেনা আইন করে আরও সহজ করে তোলা হয়েছিল।
কোন ধরনের বন্দুকের মালিকানা বিপজ্জনক?
অ্যাসল্ট অস্ত্রের মালিকানা বিপজ্জনক। অ্যাসল্ট রাইফেল ও অ্যাসল্ট পিস্তল যুক্তরাষ্ট্রে কারা কিনছেন, তার হিসাব রাখা হয় না। কেউ বন্দুকের দোকানে গিয়ে বন্দুক কিনলে তাঁর অপরাধমূলক কাজের হিসাব নেওয়ার জন্য ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করা হয় না। কী কিনছেন, কত টাকায় কিনছেন, দোকানের বাইরে গিয়ে এটি দিয়ে তিনি কী করবেন, কেউ এর হিসাব রাখেন না। যে কেউ ২০টি অ্যাসল্ট রাইফেল কিনতে পারেন, এমনকি ওয়াশিংটন ডিসিতে গাড়িতে চড়ে এগুলো নিয়ে ঘুরতে পারেন এবং বিক্রিও করতে পারেন। কেউ এর খবর রাখেন না। কারণ, বন্দুক বিক্রির তথ্য শনাক্ত করার জন্য কোনো রিপোর্টিং ব্যবস্থা নেই।
দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, এমন অপরাধীর কাছে বন্দুক বিক্রি করা বা বিক্রি করার জন্য রাজ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়া আইনত অপরাধ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এই আইন ভাঙার জন্য জরিমানাব্যবস্থা খুব শিথিল। তাই এটি কোনো বাধা নয়। অপরাধীদের হাতে সহজেই বন্দুক যেতে পারে।
আবার স্কুলে বুলিং প্রতিরোধের জন্য ভালো উদ্যোগ নেই। খুব বাজে অবস্থায় না গেলে বুলিংয়ের জন্য স্কুল কোনো ব্যবস্থা নেয় না। কেউ কেউ শিক্ষক বা স্কুল প্রশাসকদের অস্ত্র দেওয়ার কথা বলেন। বেশির ভাগ হাইস্কুলে একজন সশস্ত্র রিসোর্স অফিসার থাকেন। তবে বেশির ভাগ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে এই অফিসার নেই। শিক্ষক বা স্কুলকর্মীদের সশস্ত্র করা একটি বিপজ্জনক উদ্যোগ। কারণ, তিনি অন্যের মৃত্যুর কারণ হতে পারেন। শিক্ষক দুর্ঘটনাক্রমে অন্য কোনো কর্মী, পুলিশ অফিসার এমনকি শিক্ষার্থীকেও গুলি করতে পারেন। তাই এটি কোনো সমাধান নয়।
আইনে কী আছে?
গত ৫০ বছরে বন্দুক কেনা সীমিত করার জন্য কেবল একটি অর্থবহ আইন পাস হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের অধীনে ১৯৯৪ সালে ফেডারেল অ্যাসল্ট অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বিল পাস হয়েছিল। ১০ বছর পর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে এলে এই বিলের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। মেয়াদ শেষ হলে মানুষ আগের চেয়ে বেশি দামে বন্দুক কিনতে শুরু করে। মানুষের মধ্যে ধারণা ছড়িয়ে পড়ে যে অন্য কোনো ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বা কংগ্রেসের অধীনে আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি আবার সীমিত হয়ে যাবে। সুতরাং অ্যাসল্ট রাইফেল, যা নিষেধাজ্ঞার আগে খুব কমই বিক্রি হতো, নিষেধাজ্ঞা সরে গেলে এই রাইফেলের বিক্রি অনেক বেড়ে যায়।
অনুমান করা হয় যে যুক্তরাষ্ট্রে এখন বিক্রি হওয়া সব বন্দুকের এক–চতুর্থাংশ থেকে এক–তৃতীয়াংশ অ্যাসল্ট রাইফেল। পুলিশ বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম ভি পেলফ্রে জুনিয়র জানিয়েছেন, সামরিক বা আইন প্রয়োগকারী নয়, এমন কারও কাছে কখনো অ্যাসল্ট রাইফেল থাকার কোনো কারণ নেই। পারিবারিকভাবে তাঁর পরিবার শিকারের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা প্রতিবছর শিকারে যেতেন। রাইফেল ও শটগানের ব্যবহার জানেন। একটি অ্যাসল্ট রাইফেল মানুষকে গুলি করা ছাড়া অন্য কোনো কিছুর জন্য খুব নিকৃষ্ট ধরনের অস্ত্র। এটি শিকার বা আত্মরক্ষার জন্য ভালো কাজ করে না। শটগান বা পিস্তল এর চেয়ে বেশি কার্যকর। তাই তিনি মনে করেন, কোনো সাধারণ নাগরিকের কাছে অ্যাসল্ট রাইফেল থাকার কোনো কারণ নেই। তবে বাস্তবতা হলো, প্রচুর মানুষের কাছে এই অস্ত্র আছে।
তাই স্কুলে সশস্ত্র হামলা কমানোর জন্য বন্দুক আইনে কিছু পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে বিষয়টির সমাধান করতে হবে। মানুষ নিজেরা নিরাপদ বোধ করলে বন্দুকের বিক্রি কমবে। যদি মানুষ মনে করে, তাদের নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করতে হবে, কারণ সরকার তা করছে না, সে ক্ষেত্রে বন্দুকের বিক্রি আরও বাড়বে। সমস্যার সমাধান হবে না।
সূত্র: ভিসিইউ নিউজ