আমাদের দেশে এমন কোনো সাহিত্যিকই নেই, যাঁর লেখায় মুক্তিযুদ্ধ আসেনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা এত বড় একটি বিষয় যে একে বাদ দিয়ে এই দেশটাকে যেমন ভাবা যায় না, তেমনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও জড়িয়ে থাকে মহান এই মুক্তিযুদ্ধের নানান স্মৃতি-ভালোবাসা, গৌরব, বিজয়। লেখকেরা লেখেন জীবন থেকেই। জীবনের বাইরে তো কোনো লেখাই নয়। তাই আমাদের সাহিত্যিকদের লেখায় মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে নানাভাবে, নানান আঙ্গিকে। বড়দের জন্য যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য বই, তেমনি শিশু-কিশোরদের জন্যও যত্ন নিয়ে লিখেছেন আমাদের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক।
শিশু-কিশোরদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিহাস, ছড়া, কবিতা, গল্প যেমন লেখা হয়েছে—তেমনি লেখা হয়েছে অনেক উপন্যাসও। শুধু বাংলাদেশই নয়, বাংলা সাহিত্যেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক শওকত ওসমান। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস মুজিবনগরের সাবু কিশোর পাঠকদের জন্য দামি এক উপন্যাস। গ্রামের ছেলে সাবুর নাম বদলে হয়েছিল ‘এলেমজি’ অস্ত্রের নামে নাম! এসব নিয়ে লেখা মুজিবনগরের সাবু। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। সেই তরুণ বয়স থেকেই তিনি অবিশ্বাস্য রকম জনপ্রিয়; জীবদ্দশাতেই পরিণত হয়েছিলেন কিংবদন্তিতে। বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, তেমনি গভীর যত্নে তিনি লিখেছেন শিশু-কিশোরদের জন্য। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সূর্যের দিন। এই উপন্যাসের শেষ ভাগে একটা ছোট্ট ‘পরিশিষ্ট’ আছে—গভীর বিষাদময় ওই লেখাটুকু পড়লে ভিজে ওঠে চোখের কোণ।
শিশু-কিশোরদের জন্য ভারি দরদ দিয়ে লেখেন পুরোদস্তুর শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা আছে কাইজার চৌধুরীর। তাঁর উপন্যাস শোভনের একাত্তর। কিশোর চরিত্র শোভনের গল্প এটি, শিশুভোলানো গল্প নয়—কিশোরদের জন্য রীতিমতো সিরিয়াস উপন্যাস। শিশুদের জন্য খুব বেশি একটা লেখেননি সরদার জয়েনউদ্দীন। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস আমরা তোমাদের ভুলব না—পড়লে মনে হয় কেন তিনি ছোটদের জন্য আরও আরও লিখলেন না! তাঁর এই উপন্যাসের শেষটুকু ভুলতে পারি না, ‘চাঁদ তখন লক্ষ তারার মালা গলে তার সমস্ত সুষমা ঢেলে পৃথিবীকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে...তারই ভেতর দিয়ে সামনে দ্রুত এগিয়ে চলছিল ওরা কয়জন মুক্তিযোদ্ধা...ওদের যে আরও অনেক দূর যেতে হবে, সেই স্বাধীনতা পর্যন্ত চলতে হবে যে!’
ইশতিয়াক আলমের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর উপন্যাস মায়ের কাছে ফেরা খুব গুরুত্বপূর্ণ এক সংযোজন আমাদের সাহিত্য জগৎ। ছোট্ট উপন্যাস কিন্তু ভীষণ যত্ন নিয়ে লেখা এক অন্য রকম উপন্যাস এটি। পান্না কায়সার খুব বেশি লেখেন না, কিন্তু যেটুকু লেখেন, তাতেই জড়িয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ। সহজ আর হৃদয়গ্রাহী ভাষায় লেখা। পান্না কায়সারের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর উপন্যাস হৃদয়ে একাত্তর-ও এর ব্যতিক্রম নয়।
আখতার হুসেন শিশু সাহিত্য-নিবেদিতপ্রাণ। নাগরিক জীবনে মুক্তিযুদ্ধ এবং সংলগ্ন নানান বিষয় এক আদর্শবাদীর জায়গা থেকে দেখেছেন তিনি, এবং তারই ফলে লেখা হয়েছে কিশোর উপন্যাস ফ্রিডম ফাইটার। আমাদের খুব প্রিয় ধ্রুব এষের পরিচিতি প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেই। আক্ষরিক অর্থেই তিনি বাংলাদেশের গ্রন্থসজ্জার জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি। এই শিল্পী কিন্তু দারুণ লেখেনও। তাঁর লেখা কিশোর উপযোগী মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রেডিও কার্তিকপুর—তেমনই এক অনন্য কীর্তি।
স্বদেশ রায়ের লেখা খুব অল্প। কিন্তু যেটুকু লেখেন, তাতেই থাকে গভীর চিন্তা। সমাজসচেতনতা যেন তাঁর লেখার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ছোট্ট দুরন্ত ছেলে সাজুর গল্প নিয়ে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস মাইনের খোঁজে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। বড়দের জন্যও লেখেন যেমন, তেমনি লেখেন ছোটদের জন্য। সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস সাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। দাউদ হায়দারকে আমরা চিনি কবি হিসেবে। তাঁর কিশোর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রাজপুত্র একটি অন্য রকম লেখা। আমাদের দেশের ভীষণ জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন। দুহাতে লিখেছেন এই লেখক। ছোটদের জন্য লেখার পরিমাণও কম নয় তাঁর। খুব সরল ভঙ্গিতে বলা তাঁর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস একাত্তরের মোসলেম ডাকাত—এক ভিন্ন পাঠ অভিজ্ঞতা দেয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারি গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ করেছেন লেখক আনিসুল হক। তাঁর অনেক বইয়ের মাঝে মনে পড়ছে একাত্তরের একদল দুষ্টু ছেলে বইটির কথা।
রবিউল হুসাইন পেশায় স্থপতি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সব রচনাও রয়েছে তাঁর। কম লেখেন, কিন্তু যেটুকু লেখেন সেটুকুই আমাদের ভাবায়। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখক রবিউল হুসাইনের তেমনি একটি রচনা কুয়াশায় ঘরে ফেরা।
আমজাদ হোসেনের পরিচিতি চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে হলেও নিবিষ্টচিত্তে সাহিত্যচর্চা করেছেন তিনি। ছোটদের জন্য কম লিখলেও সাহিত্য মহলে সেগুলোর কথা উল্লেখ করতেই হয়। অদ্বিত নামের বালককে ঘিরে গড়ে ওঠা লেখক আমজাদ হোসেনের এক অনন্য মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস জন্মদিনের ক্যামেরা।
দীর্ঘদিন ধরে নিবিড় ভালোবাসায় শিশু-কিশোরদের জন্য লিখছেন ফরিদুর রেজা সাগর। তাঁর অনেক বই। সেই বইগুলোর মধ্যে কিশোর উপযোগী মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক একটি আলোচিত বই একাত্তরে ওরা। বর্তমানে আমাদের কিশোর সাহিত্যে সবচেয়ে জ্বলজ্বলে নামটি মুহম্মদ জাফর ইকবালের। পরম মমতায় তিনি একের পর এক উপহার দিয়েছেন অনবদ্য সব বই—ছোটদের মহলে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস আমার বন্ধু রাশেদ-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসটির প্রথম লাইনটি হচ্ছে, ‘রাশেদ যেদিন প্রথম স্কুলে এসেছিল সেটা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে।’ ওই লাইনের মতোই আমার বন্ধু রাশেদ-এর পাঠস্মৃতি ভুলে যাওয়া, রীতিমতো অসম্ভব।
আজকে থামি এখানেই। তাহলে কি একটাই মাত্র বাংলা ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য কিশোর উপন্যাস? মোটেও নয়! বাদ থেকে গেল অনেক অনেক শ্রদ্ধেয় লেখকের, অবিস্মরণীয় সব রচনা। এক রচনায় সব নাম কি আর আঁটে কখনো! তা ছাড়া আমিও সব নাম খুঁজে বের করে দিতে চাই না তোমাদের। বরঞ্চ বাকিগুলো খুঁজে খুঁজে পড়ে ফেলবার চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দিতে চাই তোমাদের দিকেই। বিস্তর বইয়ের খোঁজখবর রাখি বলে যে গোপন অহংকারটা আছে আমার—আমি সত্যিই চাই, তোমরা সবাই আমার চেয়ে বেশি জেনে বেশি পড়ে, আমার সেই অহংকারটা ভেঙে দাও! অপেক্ষায় রইলাম!