মিষ্টি মধুর পাখির ভাষা

বুলবুলিটা দেখতে কী সুন্দর দেখো!

গ্রামীণ বাগানের ভেতর ছোট একটি ডোবা, ঝোপঝাড়ে ঘেরা ডোবাটির ওপরে ঝুঁকে দাঁড়ানো একটি নারকেলগাছ। নারকেলগাছের কোটরে নীলগলা বসন্তবাউরির বাসা। সে বাসায় উড়ু উড়ু তিনটি ছানা। ছানা তিনটি বাসা থেকে মুখ বের করে খিদের কান্না ছড়াচ্ছে চারপাশে। মা-বাবা খাবার-মুখে বাসায় এলে কার আগে কে খাবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠবে।

দুপুরবেলায় ডোবাটার জলে নির্ভয়ে চরে বেড়াচ্ছে পাঁচটি ডাহুকছানা। কুচকুচে কালো রং ওদের। শরীরের সুতোপালকগুলো কদম ফুলের পাপড়ির মতো লাগছে। মা-বাবার পেছনে পেছনে চরছে ওরা। মা পাখিটি ঘন ঘন লেজের পুচ্ছ নাড়াচ্ছে, আর তাকাচ্ছে এদিকে-ওদিকে। খুবই সতর্ক সে। ছানাদের বিপদের তো অভাব নেই! গুইসাপ, বনবিড়াল, বেজি, বাজপাখিসহ আরও কত শত্রু!

ডোবার পাড়ের মস্তবড় রাজশিরীষগাছটার মগডালের কোটরে বাসা টিয়া পাখির। দুটো উড়ু উড়ু ছানা মুখ বের করে বারবার যেন বলছে, খাব খাব খাব। তাড়াতাড়ি আসো।

নীল রাজা

ওদিকের বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে হঠাৎ উড়ল একটি বাঁশঘুঘু পাখি, ডোবাটার ওপর দিয়ে তিরবেগে উড়ে গেল একটু এলোমেলোভাবে। মুহূর্তেই ডাহুক মা-বাবা ডানা ঝাপটে অল্প উড়ে ডাঙার ঝোপঝাড়ের তলায় ঢুকে পড়ল। ছানাগুলো পলকের ভেতর ভোজবাজির মতো কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। বসন্তবাউরি ও টিয়াদের ছানারা মুখ টেনে নিয়ে গর্তের তলায় হারিয়ে গেল। বিশাল বাগানটির ভেতরে ভয়ার্ত কণ্ঠে শিস বাজিয়ে দিল একটি শ্যামা পাখি। এতক্ষণ যে বাগানটিতে বিভিন্ন জাতের পাখিরা খাওয়ায় ব্যস্ত ছিল, করছিল ডাকাডাকি, লাফাচ্ছিল ডাল থেকে ডালে, সবাই থেমে গেল। নিঝুম বাগানটাজুড়ে এখন কেবলই সুনসান নীরবতা। যেন বা অলিখিত কারফিউ জারি হয়ে গেছে চারপাশজুড়ে।

গ্রেটার র‌্যাকেট টেইলড ড্রংগো

সেই সুনসান নীরবতা ছত্রখান করে দিয়ে বাগান কাঁপিয়ে ডেকে উঠল একটি বহুরূপী ইগল পাখি—এই মাত্র এসে বসেছিল সে ওদিকের আমগাছটার ডালে। বাসা তার অনেক দূরের একটা বয়সী তেঁতুলগাছের মগডালে। সে বাসায় ক্ষুধার্ত ছানা। ছানার জন্য ডাহুকছানা শিকার করতেই সে চুপিসারে এসে বসেছিল আমের ডালে। কিন্তু সব সর্বনাশের মূলে ওই বাঁশঘুঘুটা। ওর বিপদসূচক ওড়ার ভাষা দেখেই ডাহুক মা-বাবা বুঝে ফেলেছে ব্যাপারটা, ঝট করে উড়াল যে দিয়েছে, তাতেই ছিল ছানাদের জন্য বিপদসংকেত। ছানারা লুকিয়ে পড়েছে মুহূর্তেই। ব্যাপার বুঝে টিয়া ও বসন্তবাউরির ছানারাও বাসার তলায় চুপটি করে বসে পড়েছে। সবকিছু বুঝে শ্যামাটা বাজিয়ে দিয়েছে বিপদসংকেত তথা সাইরেন। ওই সাইরেনের শব্দ যত দূরে গেছে, তত দূরের নিরীহ পাখিরা আত্মগোপনে গেছে—যেন বা বোমারু বিমানের বোমা ফেলার আতঙ্কে বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছে।

সরালির ছানা

ডাকাত বাজটা ব্যর্থতার ডাক ছেড়ে—যেন বা নিজেকে গালাগাল ঝাড়তে ঝাড়তে সুপারিগাছগুলোর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল অন্য কোথাও। বিপদ কেটে গেছে বুঝে সেই শ্যামাটা তো বটেই—একটি হলদে বউ পাখি ও একটি ভ্যাদাটুনি বিপদমুক্তির সাইরেন বাজিয়ে দিল। মুহূর্তেই পলাতক পাখিরা বেরিয়ে এল, সরব হলো আবার বাগান।

এখানে বাঁশঘুঘুটি ব্যবহার করেছিল ইশারাভাষা তথা শারীরিক ভাষা। ওই ভাষা পড়তে পারে আশপাশের সব পাখি। একমাত্র বিপদসংকেত বাজিয়েছিল যে শ্যামা পাখিটা, সে কিন্তু দারুণ সুন্দর গান জানে। শ্যামার ডাক বা শিস শুনলে ভালো লাগায় মানুষের বুক হিম হয়ে যায়। ‘বিপদ কেটে গেছে’ সংকেত বাজাল যে হলদে বউ ও ভ্যাদাটুনি, ওরাও কিন্তু খুব সুন্দর ডাকে। ভ্যাদাটুনি তো চার রকমের সুরে গান গাইতে ও শিস বাজাতে পারে। কিন্তু ‘বিপদ কেটে গেছে’ সংকেতটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের।

বহুরূপী ইগল

প্রতিটি নিরীহ পাখি পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারে—প্রকৃতিই এটা শিখিয়েছে তাদের। নিরীহ পাখিরা আত্মরক্ষা তথা শত্রুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিশ্বব্যাপী এমন একটা সর্বজনীন ভাষা রপ্ত করেছে যে, সেই ভাষাটা প্রতিটি প্রজাতির পাখি বুঝতে পারে। নিরীহ পাখিদের ভাষা বুঝতে পারে শিকারি পাখিরা ও পাখিখেকো বন্য প্রাণীরা।

এমনিতে প্রতিটি প্রজাতির পাখির জন্য আছে আলাদা ভাষা ও কণ্ঠস্বর। পাখিদের ডাক-গানকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: ১. স্বাভাবিক ডাক/ গান ২. আনন্দের ডাক ৩. বাসা বাঁধার গান ৪. বাসায় ডিম হওয়ার গান ৫. বাসায় ছানা হওয়ার গান ৬. ছানাদের খাওয়ানোর গান ৭. ছানাদের উড়তে বলার নির্দেশনা ৮. বিপদসূচক ডাক ৯. ছানাদের সতর্কসংকেত দেওয়ার ডাক ১০. ধমকের ভাষা ১১. ছানা হারানোর কান্না ১২. কষ্টের ভাষা ১৩. ভয়ের ভাষা ১৪. দৃশ্য ভাষা।

এ ছাড়া আরও অনেক ধরনের ডাক ও গান তথা ভাষা আছে পাখিদের। একটির সঙ্গে অন্যটির পার্থক্য থাকবেই। অভিজ্ঞ পাখি পর্যবেক্ষকেরা পাখিদের অনেক ভাষাই বুঝতে পারে, পড়তে পারে ডানা ও চোখের ভাষা।

ভেরালকোটের ছানা

তবে এই ভাষা শেখার জন্য পাখিদের পড়াশোনা করতে হয় না, স্কুল-কলেজে যেতে হয় না, বড় বড় ডিগ্রিও নিতে হয় না। প্রতিটি প্রজাতির পাখি যার যার ভাষায় সমান দক্ষ, ভাষাপণ্ডিত। ‘ভাষা প্রতিযোগ’ হলে প্রতিটি পাখিই প্রথম হবে, কেউ মার্কস কম-বেশি পাবে না। কেননা, পাখিদের কোনো আঞ্চলিক ভাষা নেই, সবাই কথা বলে শুদ্ধ ভাষায়। ভাষাটা তারা শেখে জন্মগত প্রবৃত্তিতে, প্রকৃতির গোপন পাঠশালা থেকে। আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল আছে ঢাকা শহরেও। ঢাকার দোয়েল যে ভাষায় গান গায়, শিস বাজায় ও ডাকে, ঠিক একই ভাষায় গান গায়, শিস বাজায় ও ডাকে নোয়াখালী-সিলেট ও চট্টগ্রামের দোয়েলেরাও। বাগেরহাটের শ্যামা যে ভাষায় কথা বলে, টাঙ্গাইলের মধুপুর বনের শ্যামার ভাষাও হুবহু তা-ই। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের যেসব দেশে আমাদের দোয়েল-শ্যামা-টিয়া-বাঁশঘুঘু ইত্যাদি পাখি আছে, সবার ইশারা ভাষা ও মুখের ভাষা একই। পাখিরা কথা বলে অভিন্ন ও নির্ভুল ব্যাকরণ মেনে। পাখিরা গান গায় নির্ভুল স্বরলিপিতে—কোনো ভুল থাকে না। এমন কোনো রাগ তথা উচ্চাঙ্গসংগীত পৃথিবীতে নেই, যা পাখিদের কণ্ঠে নেই। ওদের নৃত্যে থাকে সঠিক তাল-লয়-ছন্দ—এ ক্ষেত্রে পাখিরা ব্যবহার করে দৃশ্যভাষা। সূর ও নৃত্যের জন্য তো বটেই, নানাভাবে আমরা পাখিদের কাছে ঋণী, পাখিরা আমাদের কাছে ঋণী নয়। পাখিরা প্রকৃতির প্রতিটি ভাষা পড়তে পারে, বোঝে প্রকৃতির ইশারা ও পরিবর্তন। মানুষ গানের সুর-ছন্দ ও নাচের তাল-লয়-মুদ্রা পাখিদের কাছ থেকেই শিখেছিল একদিন। পৃথিবীতে এমন কোনো সুর বা নৃত্যমুদ্রা নেই, যা পাখিদের কাছ থেকে ধার করা নয়।

হালতির ছানা

রাঙা হালতি, ডাহুক, ডুবুরি, বনমুরগি, শেখ ফরিদ, মথুরা, নাগরবাটই, হালতিসহ বহু পাখির ছানা তাদের মা-বাবার চোখের ভাষাটা পড়ে, পায়ের ভাষাটা পড়ে এবং বুঝতে পারে, কী করতে হবে তাদের। রাঙা হালতি, ঢেউর, ডাহুকসহ লেজের পুচ্ছ নাচানো পাখিদের ছানারা মা-বাবার লেজের পুচ্ছ নাড়ানোর ভাষাটা ঠিক ঠিক পড়তে পারে। ভীমরাজ বা সিংহরাজসহ আরও কয়েক প্রজাতির পাখি কৌতুক বা মজা করতে খুব ভালোবাসে। স্রেফ মজা করার জন্য ময়না পাখিরাও গাছের উঁচু ডালে বসে নিচ দিয়ে যাওয়া বেজি, বনবিড়াল বা অন্য কোনো শিকারি পাখির ডাক হুবহু নকল করে ভড়কে দেয় ওদের। বাজ-ইগলের ডাক নকল করে নিরীহ পাখিদের ভড়কে দিয়েও মজা পায় ওরা। অবশ্যই এরও একটা ‘জঙ্গলমূল্য’ আছে। নকল ডাক শুনেও অসতর্ক নিরীহ পাখি ও প্রাণীরা সতর্ক হয়। প্রাণে বেঁচে যায়। ময়না আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পোষা পাখি। কিন্তু ময়না-টিয়া-শালিক-মুনিয়াসহ যেকোনো পাখিই ধরা-মারা ও পোষা দেশের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। কোনো পাখিই তাই পোষা উচিত নয়। ছোট পাখি মুনিয়ারা বাসার ভেতরের ছানাদের সঙ্গে কথা বলে অনেকটা সেলফোন ব্যবহারের মতো। ভেড়ারকোট বা বালিহাঁস তাদের গাছের খোঁড়লের ছানাদের বাসা থেকে লাফ দিয়ে বেরোতে বলে ‘লাফ দে, দে লাফ, ভয় নেই—ভয় নেই’ ভাষায়। একসময় ছানারা অনেক উঁচু থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে। এ এক আশ্চর্য বিস্ময় পাখিদের জগতে। পাখির গানে আজও ভোর নামে আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে। নীড়ে ফেরা পাখির ডানায় বসে সন্ধ্যা নামে আজও আমাদের দেশে।