ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড

গোল্ড প্লেটেড কপারে বানানো এ রেকর্ডে আছে বাংলাসহ ৫৫টি ভাষার মৌখিক সম্ভাষণ। নিচে নভোযান ভয়েজার

মনে বড়ই আফসোস! এখনো ভিনগ্রহবাসী দেখা হলো না। তাদের নিয়ে কত কত বই পড়লাম, সিনেমা দেখলাম, স্বপ্নেও কতজনের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল, তবু বাস্তবে ভিনগ্রহের কোনো প্রাণীই দেখলাম না। ভাগ্যিস, এই আফসোস শুধু আমার একার নয়, নাসার বিজ্ঞানীদেরও আছে। তাই কিছুটা সান্ত্বনা।

নাসার বিজ্ঞানীরা কেবল হা-হুতাশ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেননি। তাঁরা মহাশূন্যে ভয়েজার নামে একটা মহাকাশযানও পাঠিয়েছে। সেই ১৯৭৭ সালে। এই মহাকাশযানে রয়েছে একধরনের গ্রামোফোন রেকর্ড। একে বলা হয় গোল্ডেন রেকর্ড। এই রেকর্ডটা গোল্ড প্লেটেড কপার দিয়ে বানানো। আর এর কভার বানানো হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও ইউরেনিয়াম-২৩৮ আইসোটোপ দিয়ে।

মানুষ কত রকম ভঙ্গিতে খাওয়াদাওয়া করে, সেটার ছবিও আছে ভয়েজারে

বলা যেতে পারে, এটা ভিনগ্রহবাসীদের জন্য পৃথিবীর পক্ষ থেকে পাঠানো একটা উপহার। এটাতে পৃথিবীর জীবন, প্রকৃতি, সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য, ছবি ও শব্দের মাধ্যমে রেকর্ড করা আছে। যদি কোনোভাবে ভিনগ্রহের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী এটা পেয়ে যায়, তবে তারাও বুঝতে পারবে—পৃথিবী বলে একটা নীল গ্রহ আছে এবং সেখানে অনেক জ্ঞানী-গুণী প্রাণীও আছে।

গোল্ডেন রেকর্ডে কী কী তথ্য দেওয়া হবে সেটা বাছাই করার জন্য একটা কমিটি গঠন করেছিল নাসা। সেই কমিটির প্রধান ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিখ্যাত মহাকাশবিজ্ঞানী কার্ল সাগান। প্রায় এক বছর ধরে ভাবনাচিন্তা করে এই কমিটি ১১৬টা ছবি এবং বেশ কিছু প্রাকৃতিক শব্দ বাছাই করেছে। এসব শব্দের মধ্যে ছিল বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ, সমুদ্রের গর্জন, বৃষ্টি, বজ্রপাত, ঝড়ের শব্দ, এমনকি পাখি, তিমি মাছসহ নানা ধরনের প্রাণীর আওয়াজ। এই গোল্ডেন রেকর্ড থেকে বাদ পড়েনি বিভিন্ন সংস্কৃতির গানবাজনাও। গোল্ডেন রেকর্ডে যে ছবিগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলোর কিছু সাদাকালো, কিছু রঙিন। যেমন সুপারমার্কেটে বাজার করতে যাওয়া একটা মহিলার ছবি, মানুষ কত রকম ভঙ্গিতে খাওয়াদাওয়া করে সেটার ছবি—আরও কত কী। মানুষের ছবি তো আছেই, আরও আছে বিভিন্ন প্রাণী, কীটপতঙ্গ, গাছপালা, প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। আবার কিছু বৈজ্ঞানিক ধাঁচের ছবিও সঙ্গে দেওয়া হয়েছে—যদি ভিনগ্রহের কোনো বিজ্ঞানী এই রেকর্ডটা পায় তবে যেন বোঝে আমাদের পৃথিবীও গবেষণায় পিছিয়ে নেই।

গোল্ডেন রেকর্ডে ভিনগ্রহবাসীদের জন্য আর কী কী পাঠানো যায়, এই নিয়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তার শেষ ছিল না। এমনকি, অ্যান ড্রুয়ান নামের একজন লেখকের মস্তিষ্ক তরঙ্গ এক ঘণ্টা ধরে রেকর্ড করে, সেটাও এই গোল্ডেন রেকর্ডে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মস্তিষ্ক তরঙ্গ রেকর্ড করার সময় অ্যান বিভিন্ন বিষয়ে ভাবতে থাকেন, যেমন পৃথিবীর ইতিহাস ও সভ্যতা, বর্তমান পৃথিবীতে কী কী সমস্যা আছে, ভালোবাসার অনুভূতি কেমন—আরও অনেক কিছু। আর সেই চিন্তার সবই এখন আটকে আছে গোল্ডেন রেকর্ডে। এই রেকর্ডে তখনকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও জাতিসংঘের মহাসচিব কার্ট ওয়াল্ডহেমের লিখিত বাণী আছে। আরও আছে পৃথিবীর ৫৫টি ভাষায় মৌখিক সম্ভাষণ। এসব ভাষার মধ্যে রয়েছে—বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, প্রাচীন গ্রিক, ফার্সি, হিব্রু, আরবি, কোরিয়ান, চায়নিজ, জাপানিজসহ আরও অনেক ভাষা। হয়তো মহাশূন্যে চলতে গিয়ে কোনো ভিনগ্রহের প্রাণীর কানে এল চীন দেশের মিন উপভাষায় কেউ যেন বলছে, মহাশূন্যের বন্ধুরা, কেমন আছো? খাওয়াদাওয়া হয়েছে? সময় থাকলে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসো। আর যদি সেই ভিনগ্রহের প্রাণীটা বাংলা বোঝে, তাহলে রেকর্ডে সম্ভাষণ শুরুর এক মিনিট আট সেকেন্ডের মাথায় বাংলাতে শুনতে পাবে, নমস্কার, বিশ্বের শান্তি হোক। যে বাঙালির গলায় এই অংশটা রেকর্ড করা হয়েছে, তিনি হলেন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদ সুব্রত মুখার্জী।

ভিনগ্রহবাসীদের জন্য সাংকেতিক বার্তা

গোল্ডেন রেকর্ডে যেসব ছবি ও তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, সেসব নিয়ে ১৯৭৮ সালে মার্মার্স অব আর্থ: দ্য ভয়েজার ইন্টারস্টেলার রেকর্ড নামে একটা বই প্রকাশিত হয়েছে। ওদিকে নাসা, ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এই রেকর্ডের অডিও অংশটা সাউন্ডক্লাউডে দিয়েছে। এই গোল্ডেন রেকর্ড নিয়ে সিনেমাও হয়েছে ১৯৮৪ সালে স্টারম্যান, ২০০০ সালে ব্যাটলফিল্ড আর্থ। এসব সিনেমায় দেখানো হয়েছে ভিনগ্রহবাসী গোল্ডেন রেকর্ডটা পেয়েছে। তারপর তাদের মনে পৃথিবী সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, পৃথিবী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছে।

একদিন হয়তো এসব কেবল সিনেমা আর কল্পকাহিনি থাকবে না, ঠিক ঠিক ভিনগ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হবে, বন্ধুত্ব হবে। তখন কোনো এক বিকেলে হয়তো আমার কোনো এক ভিনগ্রহবাসী বন্ধু আমাকে মোবাইলে ফোন করে বলবে, অ্যাই, তোর অঙ্ক স্যার আজকে কী পড়াল, আমাদের এখানে তো ষান্মাষিক পরীক্ষা শেষ।

নাসা ডটকম অবলম্বনে

(কিশোর আলোর মার্চ ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)