প্রথমে মনে হয়, মাথা ঘুরে উঠেছে। কিন্তু তার পরই বোঝা যায়, না এটা ঠিক মাথা দুলুনি নয়! এ তো পুরো পৃথিবীর দুলুনি!
হ্যাঁ, আমি ভূমিকম্পের কথা বলছি। সেই আদিমকাল থেকেই মানুষ ভূমিকম্প টের পেয়েছে। আর ভেবেছে, আচ্ছা এমন কেন হয়? কিসের জন্য ‘সম্পূর্ণ’ পৃথিবীটাই দুলে ওঠে? নড়ে ওঠে?
এমনি আমরা কোনো কিছুকে শূন্যে ভেসে থাকতে দেখি না। কোনো না কোনো অবলম্বন লাগে। এই চিন্তাকে প্রসারিত করে পুরোনো দিনের মানুষ ভাবল, পৃথিবীও নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কিছুর ওপর বসে আছে। যেমন ভারতীয় পুরাণের লেখকেরা বললেন, পৃথিবী বসে আছে বাসুকি দেবের সহস্র ফণার ওপর। সহস্র ফণার একটার ওপর আছে পৃথিবী। যদি কোনো কারণে বাসুকি দেব ফণা পরিবর্তন করে এক ফণা থেকে আর এক ফণায় নিয়ে যায় পৃথিবীকে, তখনই সেটা সামলাতে ধরণি কেঁপে ওঠে! ইউরোপে অবশ্য সাপের ব্যাপারটা ছিল না। তাঁরা ভাবতেন, পৃথিবী আছে একটা কাছিমের পিঠের ওপর। সেই কাছিমটা আছে আর একটা কাছিমের ওপর। সেটি আর একটার ওপর...এভাবে অনাদি-অনন্ত। আর কোনো কাছিম যদি কোনো কারণে নড়াচড়া করে? ব্যস, তাহলেই কেল্লাফতে।
এই সাপ-কাছিমের তত্ত্ব দীর্ঘদিন মানুষকে আবৃত করে রাখে। নিউটনই প্রথম বললেন, মহাশূন্য ঝুলে থাকার জন্য কোনো অবলম্বন লাগে না। কারণ, দুনিয়ার সবাই সবাইকে আকর্ষণ করে। সূর্য টেনে রেখেছে পৃথিবীকে। সেই টানের সঙ্গে সমন্বয় করতে পৃথিবীকে দৌড়াতে হচ্ছে সূর্যের চারদিকে। সে জন্য সে পড়ে যাচ্ছে না। ব্যাপারটা সহজে বোঝা যায়, যখন তুমি একটা সুতার এক প্রান্তে একটা ঢিল বেঁধে অপর প্রান্ত আঙুলে জড়িয়ে ঘোরাতে থাকো, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি ঘোরাতে থাক, ততক্ষণ পর্যন্ত ঢিল কিন্তু তোমার আঙুলের চারপাশে আবর্তিত হয়। এ হলো কেন্দ্রের দিকে আর কেন্দ্র থেকে দূরে চলে যাওয়ার চেষ্টার একটা সমন্বয়। পৃথিবী ও সূর্যের বেলায়ও তাই।
এভাবে কাছিম আর সাপের বিতাড়নের পর বিজ্ঞানীরা আবার নড়েচড়ে বসলেন। আরে, তাহলে কেন পৃথিবী দুলে উঠছে? কারণটা কী?
এর মধ্যে কয়েকটা ভূমিকম্পের ফলে বিরাট ক্ষয়ক্ষতি দেখে তাঁদের একটা চিন্তা সহজ হলো। ভূমিকম্পের সময় তার মানে বিরাট আকারের শক্তির প্রকাশ হয়তো, এই শক্তি আসে কোথা থেকে?
কেন, পৃথিবীর ভেতর থেকে। কারণ দুলুনিটা তো মাটিতেই হয়, আকাশে নয়।
এভাবে বিজ্ঞানীরা ধাপে ধাপে বের করে ফেললেন ভূমিকম্পের কারণ। কারণ আর কিছু নয়, আকস্মিকভাবে ভূগর্ভের শক্তি বের হয়ে আসা।
ভূগর্ভে শক্তি বের হয়ে আসার সময় তৈরি করে সিসমিক তরঙ্গ। আর এই তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে উৎস থেকে চারদিকে। একটি পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেভাবে তরঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, সে রকম।
এ রকম শক্তি বের হওয়ার বেশ কয়েকটা কারণ হতে পারে। একটা সহজ কারণ হলো আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। এ সময় আগ্নেয়গিরির আশপাশে ভূমিকম্প হয়।
তবে, সাধারণভাবে আমরা যে ভূমিকম্পের কথা বলি, তার উৎস বোঝার জন্য আমাদের অনেক অনেক কাল আগের পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেতে হবে। একসময় পৃথিবীর সব স্থলভাগ একত্রে ছিল। কালক্রমে এরা পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। ১৯১২ সালে জার্মানির বিজ্ঞানী আলফ্রেড ভাগনার এটির নাম দিয়েছেন মহাদেশীয় চলাচল। এই চলাচলের কারণ হলো, পৃথিবীর উপরিভাগ কতগুলো অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলোকেই বিজ্ঞানীরা বলেন টেকটোনিক প্লেট। টেকটোনিক প্লেট পৃথিবীর ভেতরের গলিত পদার্থের বাইরের আবরণ। মানে একটা শিলাস্তর। ভূস্তরের সবকিছু এই প্লেটগুলোর ওপরে অবস্থিত।
টেকটোনিক প্লেটগুলো একে অপরের সঙ্গে পাশাপাশি লেগে আছে। কোনো কারণে এগুলোর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হলেই তৈরি হয় শক্তি। এই সংঘর্ষ হয় কখনো মৃদু, কখনো সজোরে। ঘর্ষণের মাত্রা বেশি হলে শক্তি নির্গত হয় বেশি। শক্তি তখন বের হতে চায় এবং সিসমিক তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যদি তরঙ্গ শক্তিশালী হয়, তাহলে সেটি পৃথিবীর উপরিতলে এসে পৌঁছায়। আর তখনো যদি যথেষ্ট শক্তি থাকে, তাহলে সেটা ভূত্বককে কাঁপিয়ে দেয়। আমরা বলি ভূমিকম্প!
বোঝা যাচ্ছে যে প্লেটগুলোর মিলনস্থলই হলো ভূমিকম্পের মূল উৎস এবং সেখান থেকে যত দূরে যাবে, ততই তার শক্তি কমে যাবে।
আর ভূমিকম্পের শক্তি বা মাত্রা মাপা হয় রিখটার স্কেলে, যা কি না একটা লগারিদমভিত্তিক স্কেল। এর মানে, ৩ মাত্রার ভূমিকম্প ২ মাত্রার ভূমিকম্পের চেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালী।
১৫৫৬ সালের ২৩ জানুয়ারি চীনের সানসি প্রদেশে একটি ভূমিকম্পে ৮ লাখ ৩০ হাজার লোক মারা যায়। লিখিত ইতিহাসে এর চেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পের আর কোনো ইতিবৃত্ত লেখা নেই। ১৯৭৬ সালে ওই চীনেরই তাংসাং জেলায় একটা ভূমিকম্পে আড়াই থেকে ছয় লাখ লোক মারা গেছে বলে মনে করা হয়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ৮.৭ মাত্রার ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ ভারতবর্ষে আঘাত করে। এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প। আর ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল নেপালে ৭.৮ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটাও এ অঞ্চলের জন্য ভয়াবহ। এই ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় নয় হাজার মানুষ।