ভবিষ্যতের পাঠাগার
মার্গারেট অ্যাটউড চিন্তিতবোধ করছেন। আনন্দ, রোমাঞ্চ, কৌতূহল—সবকিছু মিলিয়ে একরকম মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে তাঁর মধ্যে। ‘স্ক্রিবলার মুন’ নামক পাণ্ডুলিপিটি তিনি কিছুক্ষণ আগে তুলে দিয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডের কাছে। বুকার প্রাইজ পাওয়া বিখ্যাত এই লেখিকার জনপ্রিয় বইয়ের তালিকাটি বেশ বড়—দ্য হ্যান্ডমেইড টেইলস, ওরিক্স অ্যান্ড ক্রেইক, ম্যাডঅ্যাডাম...আরও অনেক বই। লেখা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কথা নয় তাঁর। তাঁর চিন্তার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই পাণ্ডুলিপি এখন প্রকাশিত হবে না। পুরোপুরি গোপন থাকবে। এটি প্রকাশিত হবে ঠিক এক শ বছর পর! অর্থাত্ এর পাঠক ভবিষ্যতের মানুষেরা!
গল্পের মতো শুনতে মনে হলেও ঘটনা একদম সত্যি। দ্য ফিউচার লাইব্রেরি প্রজেক্টের কথা বলছি। ২০১৪ সালে স্কটিশ শিল্পী ও পরিবেশবিদ কেটি প্যাটারসন এক অদ্ভুত প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন নরওয়েবাসীর জন্য। নর্ডমার্কা অঞ্চলে এক হাজার পাইনগাছ লাগানো হবে। গাছগুলো কেটে ছাপা হবে এক শ বই। নর্ডমার্কা অঞ্চলটি অসলো শহরের অনেক উত্তরে অবস্থিত। নগরায়ণ স্পর্শ করেনি বনাঞ্চলটিকে। আর তাই একে বেছে নেওয়া হয় ফিউচার লাইব্রেরি প্রজেক্টের জন্য। বইগুলো পড়ার জন্য বেশি না, মাত্র এক শ বছর অপেক্ষা করতে হবে! পরিকল্পনা এমনই।
যেমন কথা তেমন কাজ। আরবান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সি এ অঞ্চলের তত্ত্বাবধান করছে অনেক আগে থেকেই। তাদের সহায়তায় এক হাজার পাইনগাছ লাগানোও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু কাদের বই প্রকাশিত হবে এক শ বছর পর? আট সদস্যবিশিষ্ট একটি বোর্ড কাজ করছে এ জন্য। কেটি প্যাটারসন ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও গ্রন্থ প্রকাশকেরা রয়েছেন এই বোর্ডে। তাঁরা লেখক নির্বাচন করার পাশাপাশি লেখা দিতে আহ্বান করেন দেশ-বিদেশের ভিন্ন ভাষাভাষী লেখকদের। লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুখ্য বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পায় ‘চিন্তাশক্তি’ এবং ‘সময়’। ভবিষ্যত্ প্রজন্মের পাঠকদের মুগ্ধ করতে পারবে এমন শক্তিশালী লেখকদের প্রাধান্য দিচ্ছে বোর্ডটি। মার্গারেট অ্যাটউড প্রথম লেখক হিসেবে এই প্রজেক্টে অন্তর্ভুক্ত হন। ডেভিড মিচেল দ্বিতীয় লেখক হিসেবে যোগ দেন তাঁর পাণ্ডুলিপি ‘ফ্রম মি ফ্লোজ হোয়াট ইউ কল টাইম’ দিয়ে। সর্বশেষ তৃতীয় লেখক হিসেবে ২০১৬ সালে নির্বাচিত হন আইল্যান্ডের শন। এ বছর তাঁর পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার কথা। প্রতিবছর একজন লেখকের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে তা ছাপা হবে ২১১৪ সালে!
যদি ১৯১৪ সালে এমন একটা উদ্যোগ নেওয়া হতো? তবে ২০১৪ সালে আমরা সেই লাইব্রেরির পাঠক হতে পারতাম! এমনটা মনে করেন লেখক ডেভিড মিচেল। কাজেই ২১১৪ সালের ফিউচার লাইব্রেরির একটা অংশ হতে পেরে বেশ আনন্দিত তিনি।
আবার বিষয়টিকে একদম রূপকথার মতোও ভাবা যায়। যেন ঘুমন্ত রাজকন্যা ঘুমিয়ে আছে। এক শ বছর পর সে জেগে উঠবে। মার্গারেট অ্যাটউড ভাবছেন এমনভাবে। তখন কি লাইব্রেরি বলে কিছু থাকবে? নরওয়ে বলে কোনো দেশ? কিংবা পাঠকদের ভাষাই বা কেমন হবে? তারা কি এক শ বছর আগে লেখা গল্পের পাঠোদ্ধার করতে পারবে?
পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য ২০১৯ সালের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ‘নিউ ডায়েচমাস্কে লাইব্রেরি’, যা উদ্বোধন করা হবে অসলোর বুয়েরভিকে শহরে। সাইলেন্ট রুমে সংরক্ষণ করা এসব পাণ্ডুলিপি পড়া যাবে না। এর পাঠক একমাত্র ভবিষ্যত্ প্রজন্মই। তবে লেখক ও তাঁর পাণ্ডুলিপির নাম প্রদর্শিত হবে। তবে বিভিন্ন লেখকের নানা বিষয় নিয়ে লেখা রচনা, সাক্ষাত্কার পাঠকদের পড়ার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কক্ষগুলো প্রস্তুত হবে কাঠ দিয়ে। কক্ষের পরিবেশ পাঠককে যেন আকৃষ্ট করতে পারে, প্রশান্তি দিতে পারে, তার জন্য রহস্যময় নকশা তৈরি করেছেন স্থপতি ল্যান্ড হ্যাজেইম ও অ্যাটেলিয়ার অসলো।
বছরের নির্দিষ্ট একটি সময় নর্ডমার্কা বনে পাণ্ডুলিপি গ্রহণের অনুষ্ঠান হয়। যা সবার জন্য উন্মুক্ত। অনুষ্ঠানের দুটি পর্ব। প্রথমে বনের মধ্যে পাণ্ডুলিপি দেওয়া হয়। এরপর পুরোনো ডায়েচমাস্কে লাইব্রেরিতে লেখককে নিয়ে আলোচনা সভা বসে। ভবিষ্যতের পাঠকদের নিয়ে সবার মধ্যেই কৌতূহল এবং রহস্য কাজ করে এ সময়।
কেটি প্যাটারসন নিজেও জানেন না ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্য তৈরি করা এই লাইব্রেরির ভবিষ্যত্ কী। তবে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য এ রকম রহস্যময় উদ্যোগ হাতে নিতে পেরে তিনি বেশ আনন্দিত। এক শ বছর পর কাগজের বই বিলুপ্ত হতে পারে। তখন হয়তো বইয়ের পাতার গন্ধ নিতে নিতে কিংবা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কেউ কাগজের বই পড়বে না। কিন্তু কথায় আছে, লেখকেরা নাকি ভবিষ্যত্ দেখতে পান। অনেকেই বলেন, জুল ভার্নের সেই পানির নিচে চলতে পারা যান থেকেই নাকি পরবর্তী সময়ে সাবমেরিন তৈরির ধারণা পান বিজ্ঞানীরা। যেসব লেখক এই প্রজেক্টে অংশ নিচ্ছেন, তাঁরা ভবিষ্যেক কেন্দ্র করেই লিখছেন। কে জানে, তাঁদের লেখা কতটুকু মিলবে। সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে এক শ বছর পর!
তথ্যসূত্র: ফিউচার লাইব্রেরি ডটএনও, দ্য গার্ডিয়ান