প্রাচীনকালে আর্গোস নামে এক রাজ্য ছিল। সেখানে ছিলেন এক প্রতাপশালী রাজা । নাম ছিল তার অ্যাক্রিসিয়াস। সেকালে ওরাকলরা মানুষের ভবিষ্যৎ বলে দিত পারত। তো, এই রাজা নিজের ভবিষ্যৎ জানার আশায় শরণাপন্ন হলেন ওরাকলদের কাছে। কিন্তু ওরাকলরা তাকে তো কোনো সুসংবাদ দিলই না, বরং এমন এক দুঃসংবাদ দিল, যা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন রাজা। কারণ সন্তান বলতে রাজার ছিল একটিমাত্র মেয়ে ডেনাই। দুঃসংবাদটি ছিল, কন্যা ডেনাইয়ের ছেলের হাতেই মৃত্যু হবে রাজার। কী ভয়ংকর কথা! ভয় পেয়ে রাজা নিজেকে রক্ষার অনেক চেষ্টাই করলেন, অনেক সাবধানতাই অবলম্বন করলেন।
একসময় কন্যা ডেনাইয়ের একটি ছেলের জন্ম হলো। সে ছিল অর্ধদেবতা–অর্ধমানুষ। এই ছেলের বাবা ছিলেন দেবরাজ জিউস। ছেলেটির নাম পার্সিয়াস। বড় হয়ে সে হলো মস্ত এক বীর।
প্রাচীন গ্রিসে তিন ভয়ংকর নারী বা গর্গনের একজন ছিল মেডুসা। অন্য দুই নারী অমর হলেও মেডুসা ছিল মরণশীল। তবে তাকে হত্যা করা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। কারণ তার দিকে যে তাকাত, সে–ই পাথর হয়ে যেত। তার মাথার প্রতিটি চুলই ছিল একেকটা সাপ। আর শরীরের নিচের অংশটাও ছিল সাপের মতো। তবে একসময় সে খুব সুন্দরী ছিল। কিন্তু অহংকার করায় তার এই দশা হয়েছিল। তো, মেডুসা হয়ে উঠেছিল ত্রাস। তার ভয়ে সবাই ছিল কম্পমান। সেই মেডুসাকে হত্যার জন্য তার গুহার দিকে গেল পার্সিয়াস। দেবতা হার্মিস এই দুঃসাহসী অভিযানে তার সহায় হলেন। তিনি তাকে দিলেন আশ্চর্য ক্ষমতাসম্পন্ন জাদুর তলোয়ার। দেবী অ্যাথেনা তাকে দিলেন ব্রোঞ্জের তৈরি এমন একটা চকচকে ঢাল, যাকে ব্যবহার করা যায় আয়না হিসেবেও। সে ওই আয়না ঢালের সাহায্য নিয়ে মেডুসার দিকে এগিয়ে গেল। তাকে আর তাকাতে হলো না মেডুসার দিকে। আয়নায় দেখেই সে মারতে সক্ষম হলো ভয়ংকরী মেডুসাকে। তারপর জাদুর থলের মধ্যে সেই মাথা ঢুকিয়ে নিয়ে রওনা দিল। কিন্তু শেষ হয়েও হলো না শেষ। মেডুসার গলা বেয়ে পড়া রক্ত থেকে জন্ম নিল ধবধবে সাদা ডানাওয়ালা ঘোড়া পেগাসাস। ওদিকে এক রাজ্যের রানি ক্যাসিওপিয়া তাঁর নিজের ও মেয়ে অ্যান্ড্রোমিডার রূপের কারণে ভীষণ অহংকার করতে শুরু করে দিয়েছিলেন, এমনকি জলদেবী নেরেইডের সঙ্গে নিজেদের রূপের তুলনা শুরু করে দিলেন। তার এই অহংকার ক্ষুব্ধ করে তুলল সমুদ্রদেবতা পসাইডনকে। ক্যাসিওপিয়াকে হত্যার জন্য সমুদ্রড্রাগন সিটাসকে তিনি পাঠালেন। ক্যাসিওপিয়া-অ্যান্ড্রোমিডাদের হলো মহাবিপদ। সেই বিপদের সময় সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল পার্সিয়াস।
মেডুসাকে হত্যার গৌরব তার ছিল। এবার মেডুসার কাটা মাথা নিয়ে ডানাওয়ালা ঘোড়া পেগাসাসের পিঠে চড়ে সমুদ্রড্রাগন সিটাসের সামনে হাজির হলো সে। ওদিকে যেই না সিটাস তাকাল মেডুসার মুখের দিকে, অমনি সে হয়ে গেল পাথর। রক্ষা পেল অ্যান্ড্রোমিডা। এই অ্যান্ড্রোমিডার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পার্সিয়াসের। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিল, পার্সিয়াস ছিল দেবরাজ জিউসের পুত্র, আর অ্যান্ড্রোমিডা ছিল রাজকুমারী। এই বিয়ের পরই আকাশে সৃষ্টি হলো পেগাসাস কন্সটেলেশন। আজও সেটা রয়ে গেছে আকাশের বুকে। মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকালে এখনো তা দেখা যায়। এটা হলো তারকাদের এক বিশেষ সমাবেশ, যেখানে সবার ওপরে আছে পেগাসাস। তার পায়ের কাছে আছে একদিকে অ্যান্ড্রোমিডা, তার নিচের দিকে আছে পার্সিয়াস, আর কাছেই রয়েছে ক্যাসিওপিয়া। ওদিকে জ্ঞানদেবী অ্যাথেনা একদিন পেগাসাসকে নিয়ে গেলেন হেলিকন পর্বতে তার মন্দিরে। তখন গ্রিসদেশে বেলারোফোন নামের মস্ত এক সাহসী ও শক্তিমান ব্যক্তি বাস করত। হারকিউলিসের আগে এই বেলারোফোন আর পার্সিয়াসের চেয়ে বড় বীর গ্রিসদেশে অন্য কেউ ছিল না। এই বেলারোফোনের খুব ইচ্ছে হলো পেগাসাসের মালিক হওয়ার। ইচ্ছেপূরণের জন্য সে শরণাপন্ন হলো এক সন্ন্যাসীর। সবকিছু শুনে সন্ন্যাসী তাকে অ্যাথেনার মন্দিরে যেতে বললেন। এবার বেলারোফোন গেল সেই মন্দিরে। তবে সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। আর ঘুমিয়ে পড়তেই সে দেখল এক আশ্চর্য স্বপ্ন। দেবী অ্যাথেনা তাকে স্বপ্নে দিলেন দেখা, যেখানে দেবী একটা সোনার লাগাম হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন । ঘুম ভাঙতেই সে দেখল, সামনেই পড়ে রয়েছে সোনার লাগামটা। সেটি সে তুলে নিল হাতে। তারপর পেগাসাসকে তা পরিয়ে দিতেই ঘোড়াটি পোষ মেনে গেল।
ওদিকে রানির উসকানিতে রাজা প্রোটিয়াস ব্যবস্থা নিলেন বেলারোফোনকে হত্যার। তবে দেবরাজ জিউসের ভয়ে সরাসরি হত্যা না করে আশ্রয় নিলেন কৌশলের। তিনি একটা চিঠিসহ লাইসিয়ার রাজার কাছে পাঠালেন বেলারোফোনকে। চিঠিতে রাজাকে যা বলার তিনি বলেছিলেন। চিঠি পেয়ে সেই রাজা বেলারোফোনকে আদেশ দিলেন কাইমেরা নামের এক ভয়ংকর জীবকে হত্যার। কাইমেরার দেহটা ছিল ছাগলের, মাথাটা ছিল সিংহের, আর লেজটা ছিল সাপের। আর তার মুখ দিয়ে বের হতো আগুন। যেহেতু কাইমেরাকে হত্যা করা অসম্ভব বলে মনে করা হতো, তাই কেউ এটা ভাবতেই পারত না যে কাইমেরার সঙ্গে যুদ্ধ করে কারও পক্ষে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা সম্ভব। আর কাউকে কাইমেরার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পাঠানো আর তাকে মেরে ফেলার মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঘটল উল্টো। বেলারোফোনই কাইমেরাকে কোণঠাসা করে ফেলল। এর পেছনের বড় কারণ ছিল কাইমেরা মাটিতে থেকে যুদ্ধ করছিল, আর বেলারোফোন যুদ্ধ করছিল উড়ন্ত ঘোড়া পেগাসাসের পিঠে চড়ে। কাইমেরা হাঁ করে মুখ থেকে আগুন বের করতেই বেলারোফোন তার মুখের ভেতরে ছুড়ে দিল সিসার ফলাযুক্ত বর্শা। আগুনে বর্শার ফলাটা গলে গিয়ে বিষাক্ত সিসা চলে গেল দানব-জন্তুটার পেটে। আর তাতেই মৃত্যু হলো তার।
যে কাজ কেউ করতে পারেনি, তা করে অর্থাৎ কাইমেরাকে হত্যা করে বেলারোফোনের মনে অহংকারের সৃষ্টি হলো। ধরাকে সে সরা জ্ঞান করল। একসময় অলিম্পাস পর্বতের চূড়ায় উঠে দেবতাদের সঙ্গে বসবাসের শখ হলো তার। দেবতাদের এটা ভালো লাগল না। তাই তার পরিণতি হলো মর্মান্তিক। তবে সেই করুণ পরিণতি কীভাবে ঘটেছিল, তা নিয়ে কয়েকটা আলাদা মত পাওয়া যায়। কারও মতে, পেগাসাসের পিঠে চড়ে অলিম্পাস পর্বতচূড়ায় ওঠার সময় ঘোড়াটি নিজেই তাকে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আবার কারও মতে, দেবরাজ জিউসের পাঠানো পতঙ্গের কামড়ে বেসামাল হয়ে উড়তে থাকা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যায় সে। কেউ কেউ মনে করেন, আকাশ থেকে পড়েই তার মৃত্যু হয়। আবার অনেকের মতে পড়ার পরে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। অন্ধ অবস্থায় বেশ কিছুকাল বাঁচার পর মৃত্যু হয়েছিল তার। তবে পড়ে যাওয়ার কারণেই যে তার মৃত্যু হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই কারোরই। এভাবেই মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছিল মহাবীর বেলারোফোনের।
বেলারোফোনের কাহিনির শিক্ষা: অহংকার পতনের মূল।