বৃষ্টি পড়ে এখানে বারো মাস

ছবি: আনিস মাহমুদ

ছয়-সাত বছরের এক বালক। ডাকনাম কাজল। পরবর্তীকালে ওই বালক বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক হিসেবে পরিচিতি পান। কাজলের মূল নাম হুমায়ূন আহমেদ। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁর শৈশব কেটেছে সিলেট শহরে। সে গল্পই তিনি লিখেছেন কিছু শৈশব বইয়ে, ২০০৭ সালে।

কিছু শৈশব বইয়ের শুরুর লাইনগুলো এমন, ‘ছয়-সাত বছরের একটি বালক জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে বৃষ্টি দেখছে। সিলেটের বিখ্যাত বৃষ্টি। ফিনফিনে ইলশে গুঁড়ি না, ঝুমবৃষ্টি। এই বৃষ্টি একনাগাড়ে সাত দিন পর্যন্ত চলতে পারে।’ এ বালক হুমায়ূন নিজেই। তাঁর শৈশবযাপনের কথাই তিনি লিখেছেন বইটিতে।

পরবর্তী সময়ে হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের বৃষ্টিপ্রেমের ঘটনা পাওয়া যায় অসংখ্যবার। বৃষ্টির প্রতি দুর্বলতার বীজ শৈশবেই তাঁর মাথায় ঢুকে পড়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করে নিতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কেবল হুমায়ূন আহমেদই নন, সিলেটের তুমুল বৃষ্টির প্রেমে অনেকেই মজেছিলেন। এখনো অনেকে বৃষ্টিমুখর দিনরাত উপভোগ করতে ছুটে যান সিলেটের টিলা, চা-বাগান আর হাওর-বাঁওড়ে।

ছবি: আনিস মাহমুদ

অনেকেরই নিশ্চয়ই এটা জানা, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় সিলেট অঞ্চলে। এর মধ্যে জৈন্তাপুরের লালাখাল নামে একটা স্থান আছে, এটিই হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। সেটা কাগজে-কলমের তথ্য। এর বাইরে সিলেটের বৃষ্টি নিয়ে নানা কথাই বলা যায়। আগাম বোঝার কোনো সুযোগ নেই, হুটহাট বৃষ্টি ঝরে এখানে। কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি, কখনো ঝুমবৃষ্টি। দেখা গেল, কয়েক মিনিটেই ঝুমবৃষ্টির দাপট শেষ। আবার কখনো দিনের পর দিন নির্দয়ভাবে ঝরছে বৃষ্টি, থামার যেন লক্ষণই নেই!

স্থানীয় প্রবীণদের মতে, অনেক আগে বছরের বারো মাসই কমবেশি বৃষ্টিপাত হতো এখানে। অনেকটা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই কবিতার মতোই, ‘বৃষ্টি পড়ে এখানে বারো মাস/ এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে’। অবশ্য এখন এমনটা না হলেও বছরের বেশির ভাগ সময়জুড়ে সিলেটে বৃষ্টি ঝরে। তুলনামূলকভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এখানে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই বৃষ্টি হয়। সেসব বৃষ্টিও আবার নানা ধরনের। যেমন ইলশে গুঁড়ি, ঝুমবৃষ্টি, ঝোড়ো বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি, মুষলধারে বৃষ্টি…কী বিচিত্র বৃষ্টির রূপ!

সিলেটে এখনো দেখা যায়, আধা কিলোমিটারের ব্যবধানে কোথাও ঝুমবৃষ্টি, আবার কোথাও ঝকমকে রোদ। বৃষ্টিরা এখানে খেলা করে আপনমনে। আকাশে তুলো তুলো মেঘেরা ভাসে নিজেদের মতো। কখনো আকাশ সাদা, কখনো ঘন কালো। কখনো ভরদুপুরে কালো চুলের মতো অন্ধকারে চারপাশ ছেয়ে গিয়ে আকাশ থেকে শিলাবৃষ্টি পড়ে। আবার কখনো সিলেটের পাহাড়-টিলার চূড়ায় কুয়াশার মতো মেঘেরা ভেসে বেড়ায়। বর্ষাকালে টানা বৃষ্টিতে জলকাদায় একাকার হয়ে পড়ে গ্রামাঞ্চলের পথঘাট। তখন সবুজ-শ্যামল চা-বাগান বৃষ্টিস্নাত হয়ে অপূর্ব রূপ নেয়। নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-বাঁওড়ে বৃষ্টির পানিরা ফোঁটায় ফোঁটায় অবিরাম ঝরতে থাকে, বৃষ্টির নেই যেন কোনো বিরাম-বিশ্রাম।

সিলেটে অবিরাম বৃষ্টি মানেই ঘরবন্দী জীবন। অবশ্য এর ব্যত্যয় ঘটিয়েও জরুরি প্রয়োজনে অনেকে বাসার বাইরে বেরোন। দল বেঁধে তরুণেরা মাঠে ফুটবল খেলায় মেতে ওঠেন। বৃষ্টিতে ভিজে চোখ লাল করে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফেরে দুরন্ত কিশোরের দল। তাদের জ্বর তো দূরের কথা, এক রত্তি সর্দি পর্যন্তও কাছে ঘেঁষে না! সেই বৃষ্টিতেই আবার কিশোরী-তরুণীরা ঘরে বসে পেঁয়াজ-ঘি-নাগা মরিচ দিয়ে মুড়ি মেখে চিবোতে চিবোতে লুডু, ষোলোঘুঁটিসহ নানা ধরনের ঘরোয়া খেলা কিংবা গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠে। কাঁঠাল ও শিমের বিচি ভেজে খাওয়ার চলও আছে এমন সময়ে। অনেক ঘরে তখন খাবারের তালিকায় থাকে পাতলা খিচুড়ি, আলু ও বেগুনভাজা এবং সেদ্ধ ডিম। কেউ কেউ আবার পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বইও পড়তে থাকে কিংবা জানালা দিয়ে ছুঁতে চেষ্টা করে বৃষ্টির ফোঁটা। ছোটদের মতো কখনো-সখনো বড়রাও মত্ত হন বৃষ্টিবিলাসে।

ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেটে প্রায়ই হুটহাট বৃষ্টি এসে খানিক পর থেমেও যায়। তবে এখানে দিনের পর দিন বৃষ্টি মানেই একখণ্ড অবসর। বর্ষাকালে প্রায়ই কালো মেঘে ঢেকে যায় সিলেটের আকাশ। দূরের টিলার ভাঁজে ভাঁজে মেঘেরা যেন কুণ্ডলী পাকায়। অবশ্য যখন তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়, তখন অস্পষ্ট হয়ে পড়ে টিলাগুলো। আকাশজুড়ে তখন কেবল শোনা যায় বৃষ্টির পতনের শব্দ।

লেখা শুরু হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের শৈশবস্মৃতি দিয়ে। শেষ করা যেতে পারে সুরমা ঘটকের কথা বলে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী হচ্ছেন এই সুরমা ঘটক। তাঁর মূল বাড়ি সিলেটে। সুরমা নদীর দেশে নামে তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ২০০১ সালে। সেখানে তিনি স্মৃতিচারণা করেছেন এভাবে, ‘ঝড়ের দিনে আমরা বোনেরা আম কুড়োতে চলে যেতাম, বাঁশঝাড়ে অঝোরে পড়ত বৃষ্টি, মাঠঘাটে বৃষ্টির জল, পুকুরের জলে বৃত্ত রচনা করত বৃষ্টির জলধারা। পূর্ববঙ্গের ঝড়ের দাপট ভয়াবহ, কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডবের পরেই শান্ত হতো প্রকৃতি।’ এখনো যদি কোনো লেখক সিলেটের ঝড়বৃষ্টির স্মৃতিচারণা করেন, তাহলে সুরমা ঘটকের কথাটুকু লিখে দিলে বাস্তবতার সঙ্গে একটুও হেরফের হবে না। এখনো সিলেটে বৃষ্টি হয় ঠিক একইভাবে, যেমনটা বলেছেন সুরমা ঘটক।