কোনো কিছু কিনতে গেলে আমাদের টাকা দিতে হয়। মানে, টাকার বিনিময়ে আমরা কোনো কিছু কিনি। আর যারা বিক্রি করে, তারা টাকার বিনিময়ে করে। আর তাই টাকা হলো বিনিময়ের মাধ্যম।
দুনিয়াজুড়ে যে কেনাবেচা হয়, তা-ও হয় এই টাকার মাধ্যমে। না, এটি বাংলাদেশি টাকা নয়। যদি অর্থনীতির পরিভাষায় বলি তাহলে বলতে হবে, বিহিত মুদ্রার মাধ্যমে, যাকে ইংরেজিতে বলে কারেন্সি। আর এটা শুধু কোনো কাগুজে নোট বা ধাতব মুদ্রা নয়। কাগুজে নোট বা ধাতব মুদ্রার মাধ্যমে কোনো একটি বিহিত মুদ্রার (যেমন আমাদের টাকার) নির্দিষ্ট মূল্যমান প্রকাশ করা হয়। আর তা ব্যবহার করে ওই মূল্যমানের কোনো কিছু কেনাবেচা করা যায়। যদি কোনো নোট দিয়ে কোনো কিছু কেনাবেচা করা না যায় বা বিনিময় করা না যায়, তাহলে ওই নোট হলো অচল নোট। আর যে মুদ্রার জন্য ওই নোট ব্যবহৃত হয়, ওই মুদ্রাই যদি অচল হয়, তাহলে তা আর মুদ্রা হিসেবে গণ্য হয় না।
এখন সব মুদ্রা সব দেশে চলে না। বাংলাদেশের টাকা ব্যবহার করে আমরা মালয়েশিয়ায় গিয়ে কোনো কিছু কেনাকাটা করতে পারব না। একইভাবে মালয়েশিয়া থেকে এ দেশে কেউ এলে সে মালয়েশিয়ার রিঙ্গিত দোকানে বা হোটেলে দিতে পারবে না। তাহলে উপায় কী? উপায় হলো এমন একটা মুদ্রা ব্যবহার করা, যা দুই দেশেই চলবে। সে রকম একটি মুদ্রা হলো মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশে গেলে আমরা দেশ থেকে টাকার বিনিময়ে ডলার কিনে নিয়ে যাই। আবার এ ডলার দিয়ে যে দেশে যাই, সে দেশের মুদ্রা কিনে নিই কাজ চালানোর জন্য। সুতরাং, এই মার্কিন ডলার হলো একটি বৈশ্বিক মুদ্রা।
সারা পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে বেশি যে বৈশ্বিক মুদ্রা চলছে, তা হলো মার্কিন ডলার। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব মুদ্রা। পৃথিবীর সব দেশ যাতে মার্কিন ডলারকে নিজেদের মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় করতে পারে, তাই এটি নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্য সব দেশের জন্য মার্কিন ডলার একটি বিদেশি মুদ্রা। এভাবে একটি দেশের নিজস্ব মুদ্রা বাদে অন্য সব মুদ্রাই তাদের জন্য বিদেশি মুদ্রা।
আবার বিদেশি মুদ্রা বিভিন্ন সময়ে দরকার। বিদেশ থেকে চাল ও জ্বালানি তেল কিনলে তার দাম তো আর নিজের টাকায় দেওয়া যাবে না, দিতে হবে মার্কিন ডলারে অথবা বিলেতের মুদ্রা পাউন্ডে। একইভাবে বিদেশে পোশাক বা পাট বিক্রি করলেও আমরা সেই দেশের মুদ্রা নেব না। দাম বুঝে নেব ডলারে কিংবা ইউরোতে। ডলারের মতো পাউন্ড বা ইউরোও বৈশ্বিক মুদ্রা। এভাবে যেসব মুদ্রা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের জন্য গ্রহণ ও ব্যবহার করে থাকে, সেগুলোকেই বলা হয় বৈশ্বিক মুদ্রা। আর এসব মুদ্রার মধ্যে যার লেনদেন যত বেশি, সেই মুদ্রা তত বেশি সচল।
এখন বিশ্বের সবচেয়ে সচল মুদ্রা হিসেবে এক নম্বরে আছে মার্কিন ডলার। এই মার্কিন ডলার এতটাই লেনদেন হয়ে থাকে যে এর ধারেকাছে কেউ নেই। যদি প্রতিদিন সারা দুনিয়ায় মোট ১০০ টাকা লেনদেন হয়, এর মধ্যে ৮৫ টাকাই লেনদেন হয় মার্কিন ডলারে। মজার বিষয় হলো ১৯১৩ সালে ফেডারেল রিজার্ভ পদ্ধতি চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত খোদ আমেরিকাতেই কয়েকটি মুদ্রার চল ছিল লেনদেন ও বিনিময়ের জন্য।
ডলারের পরই আসে ইউরোর নাম। বর্তমানে ইউরোপের ১৭টি দেশ ইউরোকে তাদের অভিন্ন মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করছে। সে জন্য এ দেশগুলোকে একত্রে বলা হয় ইউরো অঞ্চল। ১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ইউরো। বর্তমানে দৈনিক ১০০ টাকা লেনদেনের ৩৯ টাকা হয় ইউরোতে।
এরপর চলে আসে জাপানের মুদ্রা ইয়েনের নাম। ১৮৭১ সালে জাপানের মেইজি সরকার ইয়েনকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করে। প্রতিদিন বৈশ্বিক মুদ্রাবাজারে ১৯ শতাংশ লেনদেন করা হয় ইয়েনের মাধ্যমে।
বিলেতের মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিং এখন বিশ্বের চতুর্থ সচল মুদ্রা। ১৬৯৪ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠার পর সে বছরই পাউন্ড বাজারে আসে কাগুজে নোট হিসেবে। আজ বিশ্ব মুদ্রাবাজারের ১৩ শতাংশ লেনদেন নিষ্পত্তি হয় পাউন্ডে।
এখানে একটু বোঝার বিষয় আছে। এ মুদ্রাগুলো সব বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের মাধ্যমে লেনদেন হয়। আর এ বাজারে সব সময় দুটি মুদ্রা একে অন্যের বিপরীতে লেনদেন হয়। যখন ডলার লেনদেন হচ্ছে, তখন তার বিপরীতে অবশ্যই ইউরো বা ইয়েন বা পাউন্ড লেনদেন হয়। সে কারণেই কোনো একটি মুদ্রা বারবার লেনদেন হয়ে থাকে। কোনোটি বেশি, কোনোটি কম। সহজ করে দেখলে বিষয়টি এমন যে ১০০ ডলারের বিপরীতে ৫০ ইউরো, ৩০ ইয়েন ও ২০ পাউন্ড। একইভাবে আবার ১০০ ইউরোর বিপরীতে ৫০ ডলার ও ৫০ ইয়েন। আর ১০০ ইয়েনের বিপরীতে ৫০ ইউরো, ৩০ ডলার ও ২০ পাউন্ড। এভাবে পাল্টাপাল্টি লেনদেনের মধ্য দিয়ে প্রতিদিনের লেনদেন সম্পন্ন হয়। আর তাই দিন শেষে যখন হিসাব করা হয়, তখন শতকরা হিসাবে বিভিন্ন মুদ্রার মোট লেনদেন ১০০-এর ওপরে চলে যায়। বিষয়টি গোলমেলেই বটে!
সচল মুদ্রার তালিকায় পঞ্চম স্থানে নাম আছে অস্ট্রেলিয়ান ডলারের। দৈনিক ১০০ টাকা লেনদেনের সাড়ে সাত টাকা হয় এ মুদ্রায়। আর ষষ্ঠ স্থানে আছে সুইস ফ্রাঁ। প্রতিদিন মোট লেনদেনের সাড়ে ৬ শতাংশ হয় সুইজারল্যান্ডের এ মুদ্রায়। সপ্তম স্থানে আছে কানাডীয় ডলার। মোট লেনদেনের ৫ শতাংশের সামান্য বেশি হয় কানাডার মুদ্রায়।
এ পর্যন্ত ঠিক থাকলেও এর পরও একটু গন্ডগোল আছে। অষ্টম স্থানে কিছুদিন আগেও হংকং ডলারের নাম ছিল। তারপরই অর্থাৎ নবম স্থানে সুইডিশ ক্রোনারের। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট জানিয়েছে, চীনের মুদ্রা ইউয়ান এখন উঠে এসেছে ৯ নম্বরে। আর তার আগে মেক্সিকোর মুদ্রা পেসো। এরা পেছনে ফেলে দিয়েছে হংকং ডলার, সুইডিশ ক্রোনার আর নিউজিল্যান্ডের ডলারকে।
আসলে চীন, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর অর্থনীতি যত শক্তিশালী হচ্ছে, তত তাদের মুদ্রার ব্যবহার বাড়ছে, বাড়ছে এসব মুদ্রায় লেনদেন ও বাণিজ্য। সে কারণেই এত দিন শীর্ষ ১০ তালিকার নিচের দিকে থাকা মুদ্রাগুলো পিছিয়ে পড়ছে। বদলে যাচ্ছে তালিকা। ভবিষ্যতে আরও বদলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।