বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যবহারিক ক্লাস

১১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে গিয়েছিলাম একটা ক্লাস দেখতে। ক্লাসটা হচ্ছিল প্যান্ডেলের নিচে। দেখে মনে হলো এত্ত বড়! এক পাশে দাঁড়িয়ে অন্য পাশ দেখা যায় না, এত বড়। ক্লাস করতে এসেছে ৩ হাজার ২০০ জন। একটু চিন্তা করে দেখো, তোমাদের ক্লাসে কতজন শিক্ষার্থী? কিংবা পুরো স্কুলে? এখানে একটা ক্লাসেই ৩ হাজার ২০০!

ক্লাস নেবেন সবার প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সবাই চলে এসেছে ক্লাসে। ২৮টা স্কুল থেকে এসেছে ওরা। সঙ্গে এসেছেন ৮০ জন শিক্ষক। চিন্তা করে দেখো, ক্লাস নেবেন একজন স্যার, সহযোগিতা করবেন ৮০ জন শিক্ষকও। সঙ্গে আরও ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক, যাঁরা সবাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সামনে আছেন অনেক অতিথি, যাঁরা দেখবেন সবাই কেমন ক্লাস করে।

ক্লাস করবে যারা, তারা সবাই পড়ে ক্লাস ফাইভ থেকে সেভেনের মধ্যে। এতগুলো বাচ্চা যদি এক জায়গায় হয়, তাহলে কেমন ‘বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর’ ব্যাপার ঘটবে, বুঝতেই পারছ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটুও চেঁচামেচি করেনি কেউ। শান্তশিষ্ট হয়ে ক্লাস করেছে সবাই।

এতজন মিলে ক্লাস করবে, কয়েকজন তো অনুপস্থিত থাকতেই পারে। কিন্তু অবাক ব্যাপার, অনুপস্থিতি একেবারে শূন্য! কারণ, ওরা এসেছে বিশ্ব রেকর্ড করতে। সবাই মিলে হারিয়ে দেবে অস্ট্রেলিয়ার আরেক দল শিক্ষার্থীকে। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে সেই শিক্ষার্থীরা করেছিল ২ হাজার ৯০০ জনের ক্লাস। লড়াই যখন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে, তখন তো ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই সবাই হাজির সকাল আটটা বাজতেই। বেলা দুইটা পর্যন্ত ক্লাস করেও ক্লান্তি নেই কারও।

ক্লাসটা বিজ্ঞানের ব্যবহারিকের, দুজন করে গ্রুপ করে ক্লাস করবে সবাই। তাই প্রতি দুজনের জন্য বানানো হয়েছে একটা করে কিটবক্স। ১ হাজার ৬০০ কিটবক্স বানিয়ে এনেছেন জাফর ইকবাল স্যারই, সহযোগিতা করেছে তাঁর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। এই কিটবক্সে ছিল এক টুকরা আলু। কিটবক্সগুলো বানানোর সময় একটা করে আলুর টুকরা দিয়ে সবাই বাড়ি গিয়েছে। পরদিন সকালে এসে সে রুমে তো আর কেউ ঢুকতে পারে না, পচা আলুর দুর্গন্ধে। এক রাতেই পচে গেছে। তাই ক্লাসে সবাইকে নতুন করে আলু দেওয়া হলো।

ক্লাস ছিল দুভাগে। প্রথম ক্লাসে সবাইকে চুম্বকের নানা ধর্মের কথা পড়ালেন স্যার। ক্লাসটা করতে পারলে তুমিও অনেক মজা পেতে। জাফর স্যার তো পারলে একটা-দুটি ম্যাজিকও দেখিয়ে ফেলেন। হাতের ওপর চুম্বক রেখে দেখালেন চুম্বক ডিগবাজি। স্যারের কাছে দুটি চুম্বক ছিল। শিক্ষার্থীদের কিন্তু কোনো চুম্বক দেওয়া হয়নি। কিটবক্সে ছিল একটা তিন ইঞ্চি লোহার পেরেক, এক হাত বৈদ্যুতিক তার, একটা ব্যাটারি, কয়েকটা সুই, ছোট ক্লিপ, এক টুকরা প্লাস্টিক, অর্ধেক আলু। মাত্র এই কয়টা জিনিস দিয়ে এতগুলো এক্সপেরিমেন্ট করা যায় দেখে সবাই অবাক।

চুম্বক নেই, কিন্তু ব্যবহারিক ক্লাসটা চুম্বকের ধর্ম পরীক্ষার। তাই সবাই প্রথমে নিজ নিজ চুম্বক বানিয়ে নিল। তারপর চুম্বক দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল কোন বস্তু চুম্বককে আকর্ষণ করে, কোনটা করে না। এরপর দুটি সুইকে আবার আবেশিত করে বানাল চুম্বক। সে দুটি চুম্বক দিয়ে বানাল একটা কম্পাস। কম্পাস যে উত্তর-দক্ষিণ হয়ে থাকে, তা তো সবাই জানে। কিন্তু প্রয়োজনে নিজেই যে কম্পাস বানিয়ে নেওয়া যায়, তা শিখতে পেরে সবার সে কী আনন্দ।

ব্যবহারিক ক্লাসের শর্ত হলো ক্লাস শেষে একটা রিপোর্ট লিখতে হয়। সবাই একটা করে রিপোর্ট লিখলও। এখন রিপোর্টটা তো স্যারের কাছে জমা দিতে হবে। সবাই রিপোর্ট জমা দিল ই-মেইল করে। তোমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না? সত্যিই কিন্তু ওরা ই-মেইল করে পাঠিয়েছিল রিপোর্টটা। এ জন্য কয়টা কম্পিউটার লেগেছে জানো? ৩ হাজার ২০০টা!

ব্যবহারিক ক্লাস শেষে ছিল আইসিটি ক্লাস। জাফর ইকবাল স্যার পকেটের ওপর হাত রেখে সবাইকে বললেন, ‘তোমরা কি জানো আমার পকেটে খুব শক্তিশালী একটা কম্পিউটার আছে। কত শক্তিশালী? চাঁদে মানুষ পাঠাতে যে কম্পিউটার ব্যবহার করেছিল, তার চেয়ে অনেক গুণ শক্তিশালী।’ এ কথা কি আর কারও বিশ্বাস হয়? চাঁদে পাঠানো অ্যাপোলো ১১-এর সাইজ ছিল ২৫ তলা বিল্ডিংয়ের সমান। এত বড় একটা মহাকাশযান চালানোর মতো শক্তিশালী কম্পিউটার কি আর জাফর স্যার পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন? সবাই যখন নাটকীয় কিছু দেখার আশায় তাকিয়ে আছে, স্যার বের করলেন একটা সাধারণ মুঠোফোন। এতই সাধারণ যে তাতে একটা ক্যামেরা পর্যন্ত নেই। এভাবেই শুরু হলো আইসিটি ক্লাস।

আইসিটি ক্লাসে জাফর স্যার সবাইকে বানিয়ে দিলেন একটা কম্পিউটার। এভাবেই হয়ে গেল ৩ হাজার ২০০ কম্পিউটার। কম্পিউটার প্রথমে করত শুধু গণনার কাজ। এরপর দিন গেল, কম্পিউটারের ক্ষমতা বাড়ল। ব্যবহূত হতে লাগল নানা কাজে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা হলো যোগাযোগ। একে বলে কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং। দুটি বা তিনটি কম্পিউটার যোগাযোগ করলে ব্যাপারটা সহজ। কিন্তু কম্পিউটার যদি হয় কোটি কোটি, তবে নেটওয়ার্কিং যে খুবই ঝামেলার, সে তো বোঝাই যায়। এ জন্য আবিষ্কৃত হলো সুইচ। একটি সুইচ যুক্ত হয় অনেকগুলো কম্পিউটারের সঙ্গে। যারা বসেছিল প্রথম সারিতে, তাদের সবাইকে স্যার বানিয়ে দিলেন সুইচ, পেছনের সবাই কম্পিউটার। সুইচ হয়ে একে একে সব রিপোর্ট ই-মেইল আকারে চলে এল। রিপোর্টগুলো কিন্তু জাফর স্যারের কাছে আসেনি, এসেছে উপস্থিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলক, সাংসদ নাজমুল হাসান আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উর্মি বিনতে সালামের কাছে।

আরেকটা চমৎকার উপহার ছিল সবার জন্য। অংশ নেওয়া সবাইকে জাফর স্যার নিজের হাতে স্বাক্ষর করে দিলেন একটা করে সার্টিফিকেট। ক্লাস শেষে জাফর স্যারের সঙ্গে গল্প হচ্ছিল, জাফর ইকবাল স্যার বললেন, এটাও সম্ভবত একটা বিশ্ব রেকর্ড। এর আগে ৩ হাজার ২০০ সার্টিফিকেটে একসঙ্গে স্বাক্ষর করা হয়েছে বলে মনে হয় না।

বিশ্ব রেকর্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে আছে আরও কিছু হ্যাপা। পুরো ক্লাস তাই ভিডিও করা হলো অনেকগুলো ক্যামেরায়। শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমে ঢুকেছিল লাইন দিয়ে। লাইন দিয়ে ঢোকার ভিডিও করে রাখা হলো। ক্লাস শেষে আবার বের হলো একই গেট দিয়ে। পুরো আয়োজনটি করেছিল কুলিয়ারচর উপজেলা প্রশাসন। তারা ভিডিওগুলো পাঠিয়েছে গিনেস বুক কর্তৃপক্ষের কাছে। যাচাই-বাছাই করে তারাই জানাবে আসলেই বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে কি না। বিশ্ব রেকর্ডটা বড় নয়, সেখানে উপস্থিত প্রত্যেকেই যে অসাধারণ অভিজ্ঞতা পেল, সেটাই বড়।

(কিশোর আলোর ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত)