ফিদেল কাস্ত্রোকে চেনে না, এমন মানুষ কি আছে? বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্যের স্বপ্ন দেখা এই মানুষটি মারা যান ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর। চে গুয়েভারা, রাউল কাস্ত্রোকে নিয়ে ১৯৫৯ সালে কিউবা দ্বীপে বিপ্লব করেছিলেন ফিদেল। ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারকে। এরপর নানা ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে বসবাস করেছেন, কিন্তু হাল ছাড়েননি একদম।
‘বিপ্লব’ শব্দটি একসময় সারা পৃথিবীর মানুষকে উদ্বেলিত করত। মানুষে মানুষে সাম্য—এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না। প্রতিটি মানুষের থাকবে সমান অধিকার, প্রতিটি মানুষের থাকবে শিক্ষার নিশ্চয়তা, স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা—এমন স্বপ্ন বুকে নিয়েই পুরো জীবন পার করে দিলেন ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার বিরান শহরে জন্ম নেওয়া এই বিপ্লবী।
১৯৫০ সালে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পাস করেন ফিদেল। আইনজীবী হিসেবে কিছুদিন কাজও করেন। সে সময় দেশের গরিব মানুষদের আইনগত পরামর্শ দেন তিনি। বিনা পয়সায় দেশের সাধারণ মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়ায় তাঁর নাম ও যশ ছড়িয়ে পড়ে দেশে।
তাঁর রাজনীতি সব সময়ই ছিল বিপ্লবী রাজনীতি। তখন ক্ষমতায় বাতিস্তা সরকার। ভীষণ রকম স্বৈরশাসক ছিলেন এই বাতিস্তা। ১৯৫৩ সালে বাতিস্তাবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অন্য অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন ফিদেল। এ সময় বিপ্লব-অনুসারীদের অনেকেই নিহত হন। ফিদেলকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে এত দিন কারাভোগ করতে হয়নি তাঁকে। সাধারণ ক্ষমার সুবাদে ২২ মাস পরই জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এ সময় তিনি দেশ ছেড়ে ঠাঁই নেন মেক্সিকোয়। সেখানে ‘২৬ জুলাই আন্দোলন’ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন দাঁড় করান। পাশে ছিলেন আর্নেস্তো চে গুয়েভারা আর রাউল কাস্ত্রো।
১৯৫৯ সালে কিউবায় বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় আসে। সরিয়ে দেয় বাতিস্তাকে। বিপ্লবীরা এগিয়ে যায় স্বপ্নপূরণের পথে।
১৯৬২ সাল কিউবার জন্য এক দারুণ সংকটময় কাল। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবা দ্বীপে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করছিল। তাতে দ্বীপরাষ্ট্রটি যুক্তরাষ্ট্রের হামলা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু এতে দারুণ চটে যায় মার্কিন সরকার। রেষারেষি শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে। কাস্ত্রোর অনেক বন্ধুই দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। খুব কঠিন সময় পার করে আবার স্বাভাবিক হয় কিউবা। তৃতীয় বিশ্বের বেশ কিছু দেশের বিপ্লবীদের সরাসরি সাহায্য করেন কাস্ত্রো। বেশ কিছু দেশে বিপ্লবীদের সংগঠিত করতে ছুটে যান চে গুয়েভারা। কিউবার সমর্থন পায় অ্যাঙ্গোলা, আফগানিস্তান, দক্ষিণ ইয়েমেন, ইথিওপিয়া, সিরিয়া, আলজেরিয়া, নিকারাগুয়া, লিবিয়ার বিপ্লবীরা।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই কিউবাকে শত্রু বলে মনে করেছে। কাস্ত্রোর দাবি, মার্কিনিরা তাঁকে ৬৩৪ বার হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। কখনো খুনিকে পাঠিয়েছে কিউবায়, কখনো খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়োগ করেছে কাউকে। কিন্তু প্রতিবারই তিনি বেঁচে যান। যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ অবশ্য স্বীকার করেছে দু-একবার তারা সত্যিই কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা করেছে।
২০০৬ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন ফিদেল। বিপ্লবী সহযোগী রাউল কাস্ত্রোর হাতে ছেড়ে দেন রাষ্ট্র পরিচালনার ভার। ২০০৮ সালে রাউল ক্ষমতা নেন।
ফিদেলকে মানুষ মনে রাখবে স্বপ্নবান মানুষ হিসেবে। কিউবায় যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছেন তিনি, তাতে দেশের সব মানুষের খুব উপকার হয়। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না—এই মন্ত্রেই বিশ্বাসী ছিলেন কাস্ত্রো। সেই স্বপ্ন এখনো অনেক মানুষের হৃদয়ে জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিপ্লবের সেই দৃঢ় ভিত্তি নড়ে গেছে।
কাস্ত্রোর মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছে অগণিত মানুষ। পুঁজিবাদী জগতের কেউ কেউ খুশি হয়েছে, এবং তা ফলাও করে প্রচার করেছে, ঢেকে রাখেনি।
কিন্তু একটা বিষয় এড়ানো যাবে না। একদা এই পৃথিবীর অগণিত মানুষ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল, বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্যের কথা ভেবেছিল। ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন সেই স্বপ্নবানদের অগ্রদূতদের একজন।