শরতের মাঝামাঝি থেকেই আমাদের চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য একটু একটু করে বদলাতে থাকে। হালকা শীতের মিষ্টি আমেজ অনুভূত হতে থাকে। মাথার ওপরে থাকে ঝকঝকে নীলাকাশ। ঝলমলে রোদ আলো করে রাখে চারপাশ। ঠিক এমন সময় থেকেই মাঠে মাঠে শীতের শস্য বোনার প্রস্ত্ততি শুরু হয়। আর যারা বাগান করতে ভালোবাসে, তারাও শীতের ফুলগুলো লাগানোর কথা ভাবে। আজকাল তো টবেই সব ফুলের চাষ করা যায়। বিশেষ করে শীতের ফুলগুলো মাত্র কয়েকটা মাসের জন্য থাকে। তাহলে আর সমস্যা কী? গাঁদা, ডালিয়া, কসমস, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, পপি, হলিহক, ডায়ানথাস, জিনিয়া ইত্যাদি ফুলের চারাগুলো ঢাকা কলেজের গেট অথবা আসাদগেটের সরকারি নার্সারিতেও পাওয়া যায়।
তবে শীতের এসব ফুল নিয়ে বাগান তৈরির সঙ্গে আরেকটি বিষয় যোগ করা যেতে পারে। ইচ্ছে করলে তুমি কিছু কিছু শস্যের বীজ বা চারাও বুনতে পারো। শীতের মাঠে এমন কিছু শাকসবজি বা শস্য থাকে, যা দেখতে খুবই সুদর্শন, আবার তাদের ফুলও ভারি সুন্দর। এ ধরনের কিছু শস্য হলো তিল, তিসি, মৌরি, পেঁয়াজ, মটর, খেসারি, সরিষা, কালোজিরা, জিরা ইত্যাদি। তা ছাড়া শিম, অড়হর, ভুট্টা, কাউন, মুলা— এসবের ফুলও বেশ আকর্ষণীয়। এর মধ্যে তিল, তিসি, সরিষা ও সূর্যমুখী থেকে তেল পাওয়া যায়। মটর আর খেসারি হলো একধরনের ডাল, কিন্তু কচি শাক রান্না করেও খাওয়া যায়। এসব শাক বা শস্য অল্প পরিমাণে টবেও চাষ করা যায়। তাহলে শীতের ফুলের সঙ্গে শস্যের এসব ফুল মিলেমিশে দারুণ এক রঙের খেলা তৈরি করবে।
এবার তাহলে গাছগুলো সম্পর্কে একটু জানা যাক। কালোজিরা দেশের অনেক জেলায় চাষ হয়। বর্ষজীবী বিরুৎ গাছ, ৫০ সেন্টিমিটার উঁচু, খাড়া ও শাখাযুক্ত। পাতা সরু, ঝালরের মতো। ফুলের রঙ নীলচে-বেগুনি বা সাদা হতে পারে। বীজ কালো, হজমশক্তি বাড়ায়। এ ছাড়া কালোজিরার তেল বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবেও কাজে লাগে। খেসারি মাটিতে গড়ানো লতানো ধরনের বিরুৎ গাছ। ডাল হিসেবে দেশের প্রায় সর্বত্র চাষ হয়। পাতার কোণে নীল বা গোলাপি রঙের ফুল হয়। ফল চ্যাপটা। গাছ গবাদিপশুর খাদ্য। আবার সবজি হিসেবেও খাওয়া যায়। বীজ ডাল হিসেবে খাওয়া হয়। শীতের মাঠের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হলুদ-সোনালি রঙের সর্ষে ফুল। মাঠজুড়ে শুধু ফুল আর ফুল। ফুলগুলো থাকে অনেক দিন। তারপর ফল আসে। বীজ থেকে তৈরি হয় তেল। শাক খাওয়া যায়। ফুল থেকে পাওয়া যায় মধু। জিরা শাখাযুক্ত কাণ্ডের ঝোপাল গাছ। গোড়ার দিকের পাতার কিনার খণ্ডিত। মঞ্জরির আকার ছাতার মতো। ফুল খুবই ছোট, সাদা থেকে গোলাপি রঙের। ফল চিকন ও লম্বা। হালকা বাদামি রঙের। ফল স্যুপ, তরকারি, কেক, রুটি, পনির, আচার ও চকলেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জিরার তেল পানীয় এবং সুগন্ধি দ্রব্যে ব্যবহার্য।
টকপালং টক হিসেবে রান্না করা হলেও ফুল দেখতে বেশ সুন্দর। এরা ছোট, খাড়া ও বিরুৎ গাছ। ১ মিটার লম্বা হতে পারে। কাণ্ড রসাল, শাখাহীন। পাতা সরল। মঞ্জরি লম্বা। ফুলের রং সবুজাভ খয়েরি। ফল ছোট। পাতা সবজি হিসেবেও খাওয়া হয়। আবার চাটনি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। তিল ছোট ধরনের খাড়া বিরুৎ গাছ। ১ মিটারের মতো লম্বা হতে পারে। পাতা প্রায় ১০ সেন্টিমিটার লম্বা। ফুল সরল, পত্রকোণ থেকে বেরোয়, সাদা বা ঘিয়ে রঙের। ফল লম্বাকৃতির, কালো বা বাদামি রঙের অনেক বীজ থাকে। বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়, খৈল গরুর খাবার, কেক বানাতেও কাজে লাগে। তিসি ৬০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার লম্বা গাছ। সারা দেশে চাষ হয়। শাখা প্রচুর, ঊর্ধ্বমুখী। পাতা সরু। ফুল নীল বা পার্পল রঙের। ফল অর্ধগোলাকার। জানুয়ারি থেকে মে মাসে ফুল ও ফল হয়। বীজ-তেল ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে। পেঁয়াজ বর্ষজীবী বিরুৎ গাছ। কাণ্ড মাটির নিচে থাকে, পরিবর্তিত হয়ে বাল্ব তৈরি হয়। এটিই মূলত পেঁয়াজ। গোড়া থেকে পাতা গজায়, গড়নের দিক থেকে গোলাকার ও ফাঁপা। আগায় লম্বা দণ্ডের ওপর ফুল হয়। বীজ চ্যাপটা, কালো। পাতা সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। মটরশুঁটি লতানো ধরনের বীরুৎ গাছ। পাতার আগায় শাখাযুক্ত আকর্ষী আছে। পাতার কোণে মঞ্জরি হয়। ফুল সাদা, গোলাপি ও পার্পল রঙের। ফল সামান্য বাঁকানো। বড় কোনো মাঠে অসংখ্য মটরশুঁটির ফুল খুবই মনোমুগ্ধকর।
আরেকটি কথা বলে শেষ করছি। তোমরা যদি এই সুর্দশন ফুলগুলো মন ভরে দেখতে চাও, তাহলে শীতের ছুটিতে অবশ্যই গ্রামে যেতে হবে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এসব রবিশস্যের মাঠ আমাদের চোখে মুগ্ধতা এনে দেয়। বিচিত্র রঙের এসব বর্ণিল ফুল সবার মন ভালো করে দেবে নিশ্চয়।