বিশ শতকের শেষ দিকেও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে পেশাদারির ছোঁয়া ছিল না বললেই চলে। ভালো লাগা বা শরীরচর্চার অংশ হিসেবে খেলাতে নাম লেখাতেন সবাই। এ ছাড়া কোনো মা-বাবা শখের বশেই সন্তানদের হাতে তুলে দিতেন ব্যাট অথবা ফুটবল। আবার যে ছেলেটার পড়ার টেবিলে মন বসে না, তার বাঁধভাঙা আগ্রহের কাছেও হার মানতেন অভিভাবকেরা। সময়ের পালাবদলে ক্রীড়া এখন অন্যতম সেরা সম্মানজনক পেশা। ভালো খেলতে পারলেই অর্থকড়ির সঙ্গে যশ-খ্যাতি! ফলে বর্তমানে অনেকেই চায় খেলোয়াড় হতে। আর এ জন্য চাই সঠিক গাইডলাইন।
এ ক্ষেত্রে সবার প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। যেখান থেকে উঠে এসে বিশ্ব ক্রিকেট মাতাচ্ছেন সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, নাসির হোসেন, আবদুর রাজ্জাকদের মতো ক্রিকেটার। তাই অনেক অভিভাবকই চান সন্তানকে একবার বিকেএসপিতে দিতে পারলেই সে–ও বুঝি হয়ে যাবে মস্ত বড় ক্রিকেটার। বিকেএসপিতে ভর্তি হতে পারলে ভালো একটা গাইডলাইন পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ব্যক্তিগত মেধা ও পরিশ্রম ছাড়া খেলায় সাফল্য পাওয়া যায় না বললেই চলে। আবার সঠিক উপায়ে পরিশ্রমের পথটাও জানা উচিত। সে পথটা দেখিয়ে দিতে পারে বিকেএসপি।
শুধু ক্রিকেট নয়, খেলোয়াড় তৈরির এ কারখানার ছাত্রছাত্রীদের প্রাধান্য আছে সব খেলাতেই। ফুটবলে উঠে এসেছেন মাসুদ রানা, হাসান আল মামুন, ফিরোজ মাহমুদ টিটু, জাহিদ হাসান এমিলির মতো তারকারা, যাঁরা দীর্ঘ সময় দেশের ফুটবলে পতাকা বহন করেছেন। হকিতে আছেন রাসেল মাহমুদ জিমিরা। এ ছাড়া একক খেলাগুলোতে তৈরি হয়েছেন শুটার আসিফ হোসেন, আবদুল্লাহ হেল বাকি, সাঁতারু মাহফুজা আক্তার শিলার মতো তারকারা।
বিকেএসপি কী?
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল ১১৫ একর জায়গা নিয়ে ঢাকার সাভারের জিরাবোতে আনুষ্ঠানিকভাবে পথচলা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য, দেশের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়াবিদ তৈরি করা। খেলার সঙ্গে পড়াশোনাটাও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি পড়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সম্পূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থায় চলে পড়াশোনা ও খেলাধুলার নিবিড় পরিচর্যা। বর্তমানে খুলনা, দিনাজপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেটে একটি করে আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে।
ভর্তির সময়
সাধারণত ডিসেম্বর মাসে জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত হয়ে থাকে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি। সে অনুযায়ী বিভিন্ন পরীক্ষার পর চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয় শিক্ষার্থীদেরকে।
ক্রীড়া বিভাগগুলো
সূচনালগ্নে দুটি ক্রীড়া বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৭টি। খেলাগুলো হচ্ছে আর্চারি, অ্যাথলেটিকস, বাস্কেটবল, বক্সিং, ক্রিকেট, ফুটবল, জিমনেসটিকস, হকি, জুডো, শুটিং, সাঁতার, টেনিস, টেবিল টেনিস, তায়কোয়ােন্দা, কারাতে, উশু ও ভলিবল।
ভর্তির নিয়মকানুন
সাধারণত চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে আসন খালি থাকা সাপেক্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পাবে। প্রতিবছর একেকটি খেলায় যে কয়টি আসন খালি হয়, তার বিপরীতে শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হয়। ভর্তির জন্য প্রকাশিত বিজ্ঞাপন অনুযায়ী জীবনবৃত্তান্ত, বর্তমান ঠিকানা ও চার কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ লিখিত আবেদন করতে হবে। বিকেএসপির প্রশিক্ষণকেন্দ্রে নির্দিষ্ট দিনে প্রশিক্ষণার্থীদের চূড়ান্ত ভর্তির জন্য বাছাই করা হয়। প্রাথমিক বাছাইয়ে সাধারণত স্বাস্থ্য ও বয়স দেখা হয়। প্রাথমিক বাছাইয়ের দ্বিতীয় পর্বে দেখা হয় শারীরিক সক্ষমতা। তৃতীয় পর্বে শিক্ষার্থীকে মাঠে পাঠানো হয়। সেখানে আবেদন অনুযায়ী নেওয়া হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা। প্রাথমিক বাছাইয়ে যারা টেকে, পরবর্তী সময় তাদের সাত দিনের অনুশীলন ক্যাম্প হয়। সপ্তাহব্যাপী সকাল-বিকেল অনুশীলনের পর নেওয়া হয় লিখিত পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষা হয় ১০০ নম্বরে। বিষয় বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান।
প্রথম ধাপ | স্বাস্থ্যপরীক্ষা
প্রথমেই স্বাস্থ্যপরীক্ষা। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসকেরা নির্ধারণ করে থাকেন আবেদনকারীর বয়স, উচ্চতা, ওজন ও শারীরিক কোনো ত্রুটি আছে কি না। স্বাস্থ্যপরীক্ষায় ‘ইয়েস’ কার্ড পেলেই আবেদনকারী নিজ নিজ খেলার মাঠে গিয়ে শারীরিক সক্ষমতা ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ যে ক্রিকেটে আবেদন করেছে, সে যাবে ক্রিকেট মাঠে। যে ফুটবলে, সে যাবে ফুটবল মাঠে।
দ্বিতীয় ধাপ | শারীরিক সক্ষমতা
আবেদন অনুযায়ী নিজ নিজ মাঠেই হয়ে থাকে শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা। সাধারণত দেখা হয় স্পিড (গতি), স্ট্রেন্থ (শক্তি), এন্ডুরেন্স (দম), এজিলিটি (িক্ষপ্রতা), ব্যালান্স (ভারসাম্য), ফ্লেক্সিবিলিটি (নমনীয়তা)।
তৃতীয় ধাপ | ব্যবহারিক পরীক্ষা
সাত দিনব্যাপী দ্বিতীয় দফায় চূড়ান্ত লড়াইয়ে জায়গা করে নেওয়ার জন্য ব্যবহারিক পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবেদনকারীদের খেলা অনুযায়ী নেওয়া হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা। যেমন ক্রিকেটে ভর্তি-ইচ্ছুকদের জন্য ব্যাটিং-বোলিং ড্রিল ও ফুটবলারদের জন্য স্কিল-গেম।
প্রাথমিক বাছাইয়ের জন্য এই তিনটি ধাপই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এক দিনে। এখান থেকে বাছাই করে নেওয়া হয় সাত দিনব্যাপী বাছাই পরীক্ষায়।
সাত দিনব্যাপী বাছাইপর্ব
সপ্তাহব্যাপী বাছাইপর্বের ধাপটি পুরোপুরি আবাসিকভাবে পরিচালনা করা হয়। ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বিকেএসপির নিজস্ব হোস্টেলে রেখে আয়োজন করা হয় চূড়ান্ত নির্বাচনী পরীক্ষা। সপ্তাহব্যাপী সকাল-বিকেল অনুশীলনে তাদের মেধা ও দক্ষতা যাচাই করা হয়। সঙ্গে লক্ষ করা হয় আবেদনকারীর আচার-আচরণ।
শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় লিখিত পরীক্ষা। ১০০ নম্বরের পরীক্ষার বিষয় বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান। সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হতে চাইলে তার জন্য ষষ্ঠ শ্রেণির সিলেবাসে পরীক্ষা হবে। আবার যে প্রতিযোগী ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক, তার জন্য পঞ্চম শ্রেণির সিলেবাস।
এখান থেকেই চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়।
ভর্তি ব্যয়
অনেকেই মনে করে বিকেএসপিতে ভর্তি হতে কিংবা পড়াশোনা চালাতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। আসলে তা নয়। নিচে ভর্তি ফি দেওয়া হলো। অভিভাবকদের মাসিক মোট আয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয় শিক্ষার্থীর বেতন।
ভর্তি ফি ২০০ টাকা (ভর্তিকালীন), জামানত ৫০০০ টাকা, মেডিকেল ফি ৩০০ (বার্ষিক), পরীক্ষার ফি ১৫০ (বার্ষিক)।
নিয়মকানুন তো সব জানাই হলো। তাহলে এবার তৈরি হয়ে যাও পরীক্ষার লাইনে দাঁড়ানোর জন্য—যদি ইচ্ছে থাকে সাকিব, মুশফিক, আসিফ, এমিলি বা শিলার মতো তারকা হয়ে বিশ্বজয় করার।
আরও খবর জানতে www.bksp.gov.bd।