বাবা বলতো, বড় হয়ে নে খোকা
তোকে নিয়ে যাবো একদিন
ওই পাহাড়ের চূড়ায়
দুজনে মিলে বনমোরগের চড়ুইভাতি
রাত্রি হলে আমরা দুজন ওই তারাদের সাথি…
বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড ডিফারেন্ট টাচের এই গানটার মতো অনেক বাবাই সন্তানদের বলে, বড় হলে ঘুরতে নিয়ে যাবো। কিন্তু বড় হওয়ার পর সে সুযোগটা হয় না সবার। কখনো সময় থাকে না, কখনও থাকে না বাবা-ই। তখন শুধুই আক্ষেপ ছাড়া আর কী-ইবা করার থাকে?
এমন আক্ষেপের কোনো সুযোগই রাখেননি দক্ষিণ চীনের তোউ হাউবেই। নিজের ৪ বছরের মেয়ে দৌদৌকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। সাইকেল চালিয়ে গিয়েছেন দক্ষিণ চীন থেকে সুদূর তিব্বতে। বাবা-মেয়ের জুটি ৭১ দিনের এই অ্যাডভেঞ্চারে পাড়ি দিয়েছে ২৫০০ মাইল!
তোউ হাউবেইয়ের ভাবনটা একেবারে সহজ-সরল। শুধু বই, ইন্টারনেট আর স্কুল-বাড়ির চার দেয়ালে যেন আটকে না থাকে তাঁর মেয়ের পৃথিবী। বাইরের দুনিয়াটা কেমন সেটা দৌদৌকে দেখাতেই এই অ্যাডভেঞ্চার। ২০১৯ সালে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দৌদৌকে নিয়েই হাউবেইয়ের সংসার। এপ্রিলে ছিল দৌদৌয়ের ৪র্থ জন্মদিন। জন্মদিন উদযাপন করতেই মেয়ের সঙ্গে ‘রোডট্রিপ’-এর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সাইকেলের পেছনে দুই চাকার একটা ছোট্ট্র ক্যারিয়ার জুড়ে তাতে মেয়েকে বসিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হাউবেই। এ ধরনের লম্বা রোডট্রিপে যা যা দরকার, তার সবই ছিল সঙ্গে।
যাত্রা শুরু হয় দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং প্রদেশ থেকে। গন্তব্য তিব্বতের লাসা। এত ছোট মেয়েকে নিয়ে এমন লম্বা ভ্রমণে যাওয়া রীতিমতো দুঃসাহসী। কিন্তু বুকে সাহস ছিল হাউবেইয়ের। ২০১৩ সালে তিনি একাই সাইকেলে চেপে গিয়েছিলেন তিব্বতে। ফলে রাস্তাটা পরিচিতই ছিল তাঁর। নিজের হাতে ম্যাপ এঁকে চিহ্নিত করেছেন কী কী দেখবেন তাঁরা। দৌদৌ যেহেতু খুবই ছোট, তার কথাই ভাবতে হয়েছে বেশি। মেয়ের সব ধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়েছে বাবাকে।
প্রতিদিন ৮/৯ ঘন্টা করে সাইকেল চালাতেন হাউবেই। মাঝে মাঝে জিরিয়ে নিতেন বরফ ঢাকা কোনো পাহাড় কিংবা টলটলে কোনো লেকের ধারে। কখনো ছুটতেন আনন্দে আত্মহারা মেয়ের পেছনে। নদী-ফুল-পাতার অপরূপ শোভায় বিস্মিত মেয়েকে দেখে পেতেন এতদূর আসার তৃপ্তি।
দিনের পর দিন সাইকেল চালিয়ে যাওয়াটা কষ্টকর অবশ্যই। কিন্তু মেয়ের খুশিতে কষ্ট-বিরক্তি টেরই পাননি হাউবেই। ‘আমার একবারও মনে হয়নি ফিরে যাওয়ার কথা। এটা খুব একটা চ্যালেঞ্জিংও ছিল না। আমার মেয়ে একটুও ক্লান্ত হয়নি, কারণ ও শুধু ক্যারিয়ারে বসে ছিল। আমাদের একসঙ্গে সময় কাটানোটা ওকে আরও বেশি আনন্দ দিয়েছে।’
মাঝে মাঝে পেছনের ক্যারিয়ার থেকে মেয়েকে তুলে সামনে বসিয়েও সাইকেল চালিয়েছেন হাউবেই। নিজের পরিচিত শহর ছেড়ে বন-পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাওয়ার আনন্দ তাঁর মেয়ের চোখে-মুখে। হাসি আনন্দে এভাবেই একের পর এক পথ পেড়োতে থাকে বাবা-মেয়ে।
গুয়াংজি অঞ্চল পেরিয়ে ইউনান প্রদেশে চলে আসে তাঁরা। এখানেই বিখ্যাত এরহাই লেক অর্থাৎ কান আকৃতির লেক। দূর থেকে দেখলে অনেকটা কানের মতো লাগে বলে স্থানীয়রা দিয়েছেন এই নাম। এই লেকে কাটানো সময়টা ভুলতে পারবে না হাউবেই-দৌদৌ। ‘আমরা যখন এরহাই লেকে ছিলাম, আকাশে তখন অসংখ্য তারা। দৌদৌ খুব কমই তারা দেখার সুযোগ পায়। আমি সাইকেল চালাচ্ছিলাম আর ও তারা দেখে টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার – এই গানটাই বারবার গাইছিল। খুব আনন্দে ছিলাম আমরা। এটা এই ভ্রমণের একটা স্বরণীয় মুহুর্ত।’
এই অঞ্চলটা পাহাড়ি হওয়া বেশ উঁচুকে সাইকেল চালাতে হয়েছে হাউবেইকে। মাঝে মাঝে হেঁটে ঠেলে নিতে হয়েছে সাইকেল। দৌদৌও তাঁর পাশেই হেঁটেছে ছোট ছোট পায়ে। সাইকেল চালাতে খুব ভালোবাসেন হাউবেই। তাই রোদ-বৃষ্টি কিংবা তুষারপাত, দীর্ঘ পথ কোনোকিছুই দমাতে পারেনি তাঁদের অ্যাডভেঞ্চারকে। ‘আমি সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি। এটা আমার কাছে বেশি অর্থপূর্ণ মনে হয়। জীবনেরই একটা প্রতিচ্ছবি এটা। তুমি হয়তো এমন কিছু পাবে যেটা জয় করা কঠিন। কিন্তু যদি ধাপে ধাপে এগোও, প্যাডেল করতেই থাকো, আর কখনো হাল না ছাড়ো, তাহলে ঠিকই তোমার লক্ষে পৌঁছতে পারবে।’
ঠিকই দীর্ঘ পথ পেড়িয়ে তাঁরা পৌঁছায় তিব্বতের লাসায়। এখানে এসে ঘোড়ায় চড়েছে দৌদৌ। বিখ্যাত পোতালা প্যালেসের সামনে ছুটে বেরিয়েছে, তুলেছে ছবি। বিশাল আকাশের নিচে নিজেকে আবিষ্কার করেছে নতুনরূপে। এটাই তো চান তাঁর বাবা। মেয়ে যেন শুধু বই না পড়ে বাস্তব দুনিয়াটাকে জানে আরও ভালোভাবে।
‘আশা করি ওর শৈশবটা শুধু পাঠ্যবইয়ে কিংবা ছবিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আজকাল শহরের বাচ্চারা তারা দেখেই না বলতে গেলে। আমি যদি ওকে গ্রামের দিকে নিয়ে যাই, তাহলে ও বুঝবে, তারা শুধু বইয়েই থাকে না। বরফ ঢাকা পাহাড়, নীল আকাশ, সাদা মেঘ এগুলো সব ও নিজের চোখে দেখতে পারবে।’
তা অবশ্য ভালোই দেখেছে দৌদৌ। সামনে এমন অ্যাডভেঞ্চার আরও করবেন বাবা। হাউবেই তো বলেই দিয়েছেন, ‘আমি ওকে তুষার দেখাতে উত্তরে নিয়ে যেতে চাই।’
একদিন হয়তো সেই গল্পটাও জানব আমরা।