বানরের খাঁচার সামনে ছেলেটির সঙ্গে দেখা। মরচে পড়া শিকের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়েছে সে। আর খাঁচার একটি বানর নিবিষ্ট মনে উকুন বাছছে তার মাথা থেকে। এ দৃশ্য দেখতে রীতিমতো ভিড় জমে গেছে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই তার। বানরের সঙ্গে একমনে খেলায় ব্যস্ত।
‘এই ছেলে, অসুখ করবে না?’ চিৎকার করে ডাক দিতেই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘সে ভয় নাই। গত দুই বছরে কত আঁচড় খাইছি, কিচ্ছু হয় নাই।’ দুরন্ত ছেলেটির সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে।
নাম তার মো. ফারুক। চট্টগ্রামের ফয়’স লেক চিড়িয়াখানার পাশে লেক ভিউ আবাসিক এলাকায় বাসা। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর ২০ টাকা দামের টিকিট কেটে সোজা ঢুকে পড়ে চিড়িয়াখানায়। ঘণ্টা দুয়েক বানরের সঙ্গে কাটিয়ে বাসায় ফেরে। এরপর আবার যায় বিকেলে।
দিন কয়েক আগের এক বিকেলে চিড়িয়াখানায় দেখা তার সঙ্গে। স্পাইক করা চুল। টি-শার্ট, জিনস আর চপ্পল। হ্যাংলা-পাতলা গড়নের ছেলেটি বেশ চটপটে। বানরপ্রীতির জন্য এলাকার লোকজন তাকে আদর করে ডাকে বানর ফারুক।
বানরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো কী করে?
ফারুক বলে, ‘বছর কয়েক আগের কথা। একদিন চিড়িয়াখানায় এসে দেখি বানরগুলো খুব “বোর” হয়ে বসে আছে। ভাবলাম ওদের একটু আনন্দ দিই। সেদিন তাদের সঙ্গে খেললাম। পরে আরেক দিন গেছি, বানরগুলো দেখে লাফালাফি শুরু করে দিল। সেই থেকে ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব।’
ওয়্যারলেস কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ফারুকের বাবা বাংলাদেশ টেলিভিশনের কর্মকর্তা। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট সে। বানরদের নিয়ে তার বাড়াবাড়ি পরিবারের লোকজন প্রশ্রয়ের চোখেই দেখে। তবে তার মা মাঝে মাঝে বকাও দেন। বলেন, ‘যা যা বানরদের সঙ্গে গিয়ে বাঁদরামি কর।’
চিড়িয়াখানার লোকজনও চেনে ফারুককে। মাঝে মাঝে বানরদের খাবার দেওয়ার সময় কেয়ারটেকারদের সাহায্য করে সে।
চিড়িয়াখানার দুটো খাঁচায় ২১টি বানর ও একটি খাঁচায় দুটো হনুমানের বাস। এদের সবাই চেনে ফারুককে। কলা, বাদামসহ নানান খাবারও সে নিয়ে যায় তাদের জন্য। কেবল তা-ই নয়, বাসায় নাশতার সময় চারটা রুটি দিলে দুটি বাঁচিয়ে রাখে সে তার অবোধ বন্ধুদের জন্য।
একটি বানরকে দেখিয়ে ফারুক বলল, ‘আমার শত্রুও আছে। এই বানরীটি আমাকে মোটেও দেখতে পারে না। আমি কেন অন্য সব বানরের প্রিয়, এটা সহ্য হয় না তার। এই দেখেন কত আঁচড় দিছে!’
ফারুকের দুই হাতে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ। তবু কোনো বিরক্তি নেই তার। বানর ফারুক নাম নিয়েও কোনো আক্ষেপ নেই। তার কথা, সে ছাড়া বানরের তো আর কোনো বন্ধু নেই। এই যে ওরা খাঁচার ভেতর আছে, সেটাই সহ্য হয় না ফারুকের। সে চায় ওদের বন্দিত্বের কথা ভুলিয়ে দিতে।
চিড়িয়াখানার এই বানরগুলো মানুষের চেয়ে কম বুদ্ধিমান বলে মনে করে না ফারুক। খাঁচার একটি স্বাস্থ্যবান বানরের তো মুঠোফোনেও আসক্তি আছে। কয়েক দিন আগে নাকি এক দর্শকের একটি স্মার্ট ফোন কেড়ে নিয়েছিল।
বড় হয়ে কী হতে চাও? ফারুকের স্পষ্ট জবাব, পশুবিশেষজ্ঞ অথবা পশুচিকিৎসক। বন্য প্রাণী নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিলে কেমন হয়? ভ্রু জোড়া তুলে উল্টো প্রশ্ন করে সে।