আমাদের সময়ে বিটিভি ছাড়া আর কিছু ছিল না। তখন বিটিভি সারা দিন খোলাও থাকত না। বিকেল পাঁচটা থেকে শুরু হতো। তারপর আরেকটু এগিয়ে তিনটা। সেই সময়ে বছরে একটা দিনকে আমরা খারাপ দিন বলে ধরে নিতাম, বাজেটের দিন। বাজেটের দিন মানেই একজন অর্থমন্ত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন, আর একদল লোক তা শুনছে। ওই দিন টিভিতে ছোটদের দেখার কিছু ছিল না। আমাদের সময় বাজেটের দিন বিরক্তিকর একটা দিন ছিল।
আজকের লেখাটা এই বাজেট নিয়েই। বাজেট আসলে বেশ মজার। আমাদের দেশটা কেমন চলছে, ভবিষ্যতে কেমন চলবে—এটা জানার জন্য বাজেট বুঝতে পারাটা কিন্তু খুব জরুরি। এসো আমরা একটু বাজেট বুঝতে চেষ্টা করি।
মনে করো, আজ সকালে বের হয়েছ মাত্র ১০০ টাকা নিয়ে। এই ১০০ টাকা দিয়ে সারা দিন কীভাবে চলবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট। এবার নিশ্চয়ই বিরক্তিকর লাগছে না? ১০০ টাকা দিয়ে উদাহরণটা দিলাম বটে, কিন্তু বাজেটের হিসাবটা এত সহজ না। তবে আমরা যদি একটা রাষ্ট্রের মতো বাজেট করতে পারতাম, তাহলে জীবনটা কত সহজই না হতো!
ছোটবেলা থেকেই পড়ে আসছি আয় বুঝে ব্যয় করো। বইপত্রেও কথাটা লেখা আছে। কিন্তু কথাটা একেবারেই শোনে না কে জানো তো? আর কে? রাষ্ট্র। সহজ করে বললে বলতে হয়, সরকার। সরকারই তো রাষ্ট্র পরিচালনা করে। আমরা যতই আয় বুঝে ব্যয়ের কথা বলি না কেন, রাষ্ট্রের বাজেট কিন্তু ঠিক উল্টো কাজ করে। রাষ্ট্র প্রথমে ব্যয় ঠিক করে, তারপর আয় করে।
আমরা ব্যয় বেশি করলে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ নিই। বেশি ঋণ নিতে হলে ব্যাংক তো আছেই। আর পরিশোধ করতে না পারলে একদম রাস্তায়, সোজা বাংলায় দেউলিয়া। রাষ্ট্রও একই কাজ করে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, অথবা বাইরে থেকে সাহায্যের নামে ঋণ নেয়। সরকার অবশ্য সহজে দেউলিয়া হয় না। সুতরাং ব্যক্তিগত বাজেট পরিকল্পনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অনুসরণ না করাই ভালো। ব্যাংক দুম করে দেউলিয়া ঘোষণা দিয়ে দেবে।
খুব সাধারণ কথায় বাজেট হলো একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আয় ও ব্যয়ের হিসাব। আর জাতীয় বাজেট হলো, একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়ের একটি হিসাব বিবরণী। আমরা যেমন মাসের শুরুতে বেতন পেয়ে ঠিক করি কোথায় কোথায় খরচ করব, কোনটি জরুরি, কোনটি অগ্রাধিকার পাবে। সরকারও তেমনই জরুরি বা অগ্রাধিকার অনুযায়ী খরচ করে।
সরকার বাজেটের মাধ্যমে অর্থ দুভাবে ব্যয় করে। একটিকে বলে উন্নয়ন ব্যয়, আরেকটি অনুন্নয়ন ব্যয়। অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে প্রধান হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও আগের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ। আর উন্নয়ন ব্যয় হচ্ছে রাস্তাঘাট নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ—অর্থাৎ সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য যেসব খাতে ব্যয় হয় সেগুলোই উন্নয়ন ব্যয় বা উন্নয়ন বাজেট।
মনে করো এবারের বাজেট হবে তিন লাখ কোটি টাকার। আর আমাদের দেশে আছে ১৬ কোটি মানুষ। এর মানে হচ্ছে দেশের একজন মানুষের জন্য বছরে বরাদ্দ ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা। ভাবতেই পারো, একেকজনকে এই টাকাটা দিয়ে দিলেই হয়। তাহলে তো বাজেট পরিকল্পনা হলো না। কারণ, একজন মানুষ ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা দিয়ে জীবনমান বাড়াতে তেমন কিছুই করতে পারবে না। বছরের বরাদ্দ এক দিনেই শেষ হয়ে যাবে। তার চেয়ে ভালো হবে, যদি সরকার এমনভাবে পরিকল্পনা করে যাতে তিন লাখ কোটি টাকা দিয়ে দেশের উন্নতি হয়। তাতে এর ফল পাবে দেশের সবাই।
তারপরেও বিষয়টা কিন্তু এত সহজ নয়। অনেক আগে বাজেট নিয়ে একটা ছড়া পড়েছিলাম—
বাজেট বাজেট মরার বাজেট/বাজেট আলুর দম/বড়র পাতে পড়ল বেশি/ছোটর পাতে কম।
সমস্যাটা এখানেই। অনেক ক্ষেত্রেই পরিকল্পনাটি ভালো হয় না। ফলে দেখা যায় বাজেটের সুফল বড়রাই বেশি পায়, গরিবেরা তেমন পায় না। সুতরাং বাজেট পরিকল্পনার একটা বড় কাজ হচ্ছে গরিবেরা যাতে বাজেট থেকে উপকার পায়, দরিদ্ররা দারিদ্র্যসীমা থেকে বের হতে পারে।
বাজেটের আরেকটা বড় দিক আছে। সেটি হলো রাজস্ব কার্যক্রম। সহজ কথায় ট্যাক্স বা কর। অনেকের কাছে বাজেট মানেই নতুন নতুন কর। আর অনেকের কাছে বাজেট মানেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো। বাজেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশই হলো এই রাজস্ব কার্যক্রম। কারণ, সরকার যে বাজেট বরাদ্দ দেবে, সেই টাকাটা কোথা থেকে আসবে? আসবে কর খাত থেকে। এ জন্য সরকারকে বিভিন্ন পণ্যের ওপর কর বসাতে হয়।
মোটা দাগে তিন ধরনের কর আরোপ করা হয়। যেমন, আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপ করা হয় আমদানি শুল্ক, উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সংযোজনের ওপর মূল্য সংযোজন কর এবং আয়ের ওপর আয়কর। সরকারের বড় কাজই হচ্ছে যার আয় বেশি, সে তত বেশি কর দেবে। আর সেই করের টাকায় নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানো হবে, যাতে করে যাদের আয় কম তারা উপকৃত হয়। এটাকে বলে আবার প্রগতিশীল করব্যবস্থা।
আমাদের যে আয়, তার চেয়ে কিন্তু ব্যয় বেশি। একে বলা হয় ঘাটতি বাজেট। আবার আয় ও ব্যয় সমান হলে তাকে বলা হয় সুষম বাজেট। আর ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হলে তাকে বলা হয় উদ্বৃত্ত বাজেট। আমাদের বাজেট ঘাটতি বাজেট। এটা অবশ্য খারাপ কিছু না। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, কিছুটা ঘাটতি থাকা ভালো, তাতে আয় বাড়ানোর একটা উদ্দীপনা থাকে। তবে ঘাটতি অনেক বেশি হয়ে গেলে সেটি আবার খারাপ। সুতরাং, সরকারের কাজ হচ্ছে ঘাটতিকে সহনশীল পর্যায়ে রাখা।
সবশেষে বাজেট দেওয়া অর্থমন্ত্রী নিয়ে গল্প বলি—
ছোট্ট ছেলেটা বিধাতার কাছে রোজ প্রার্থনা করে, ‘বিধাতা আমাকে মাত্র পাঁচ শটা টাকা দাও। আমার আর কিছু চাই না।’ কিন্তু টাকা আর আসে না। তারপর বুদ্ধি করে একদিন সে বিধাতাকে একটা চিঠি লিখল। সেই চিঠি ডাকঘরে পড়ে রইল কিছুদিন। তারপর একদিন সহূদয় কোনো একজন পড়ে থাকা চিঠিটা খুলে পড়লেন এবং পাঠিয়ে দিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অতি আশ্চর্য ঘটনা হলো, চিঠিটা শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর হাতেই পড়ল। তিনিও মজা করে ২০০ টাকা পাঠিয়ে দিলেন, সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর একটা স্বাক্ষর। ২০০ টাকা পেয়ে খুশি হলো ছেলেটি। হাত তুলে মোনাজাত ধরে বলল, ‘বিধাতা, টাকাটা অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে কেন পাঠালে, তিনি তো ৩০০ টাকা ট্যাক্স কেটে রেখেছেন।’