বাঘ দেখতে গহিন বনে

সুন্দরবনের বাঘের এমন একটা ছবি তুলেত পারা যেকোনো আলোকচিত্রীর সারা জীবনের স্বপ্নছবি: আলম হাওলাদার

সুন্দরবন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। এই জঙ্গলে যাওয়া হয়েছে অনেকবার। একবার তো টানা ৬৩ দিনই ছিলাম ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’-এর এই জঙ্গলে। মধ্যরাতে জঙ্গলে জোনাকি ট্রি দেখার সৌভাগ্য যেমন হয়েছে, ঠিক তেমনি ভরা পূর্ণিমায় দেখেছি দুই কুমিরের যুদ্ধ। কালবৈশাখী ঝড়ে স্রেফ উড়েও গিয়েছি নৌকা থেকে! নিজেদের নৌকায় জোড়া কিংকোবরা সাপ দেখে যেমন জান বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছি, তেমনি কুমিরের ভয়ে আবার সেই নদী থেকে উঠে গেঁথে গিয়েছি জঙ্গলের থকথকে কোমরসমান কাদায়! সাপ-কুমির, বানর-শূকর, হরিণ-কুমির—সব দেখে ফেলছি; বাকি ছিল শুধু বাঘ দেখা। স্থানীয় লোকজন বলে, বাঘ দেখা সবার কপালে হয় না। আমার কপাল কখনোই গুণী ছিল না, ফলে কখনোই মেলেনি বাঘের দেখা। সেই ২০১২ সালে উদ্ধার করা তিনটা বাঘের বাচ্চাকে ছয় ঘণ্টার মতো নিজের কাছে রেখেছিলাম, ফিডারে করে দুধ খাইয়েছিলাম, ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে গরম কাপড়ে ঢেকে দিয়েছিলাম—আমার দৌড় এতটুকু পর্যন্তই! কখনোই বাঘের বাড়িতে গিয়ে তাকে দেখা হয়নি আমার।

বাঘ তো আর জঙ্গলের বাইরে এসে দেখা দেবে না। তাকে দেখতে হলে যেতে হবে জঙ্গলের গহিনে। এ সুযোগ সবাই পায় না। বাংলাদেশে বাঘ নিয়ে একটা সংস্থা কাজ করে, ‘ওয়াইল্ড টিম’। এই সংস্থার কার্যক্রম খুব মজার। এর মধ্যে একটা হলো ক্যামেরা ট্র্যাপিং। মানে বাঘের সংখ্যা বের করার জন্য জঙ্গলের গাছের গায়ে গায়ে ক্যামেরা লাগিয়ে দেওয়া। মানুষের আঙুলের ছাপের মতো প্রতিটা বাঘের ডোরাকাটা দাগও আলাদা। ফলে কোনো বাঘ যদি ওই ক্যামেরার সামনে দিয়ে চলে যায়, তাহলে নিমেষেই ওঠে ছবি। সে ছবি থেকে খুব সহজেই আলাদা করা যায় তাদের। এভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে ওঠা ছবিগুলো মিলিয়ে মোট বাঘের সংখ্যা বের করা সম্ভব। অন্য একটা পদ্ধতি হলো ‘খাল সার্ভে’। এই পদ্ধতিতে বাঘের সংখ্যা বের করা না গেলেও বের করা যায় তাদের বিচরণক্ষেত্র। মানে ওই এলাকায় বাঘ আছে কি না তা জানা যায়। একটা নির্দিষ্ট এলাকায় একটাই বাঘ থাকে। সে এলাকার আয়তন হতে পারে ১৫ বর্গকিলোমিটার থেকে ৬০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত। সুন্দরবনে বাঘের খাবারের পরিমাণ বেশি, ফলে তার বিচরণক্ষেত্র কম।

২০০৭ সাল থেকে সুন্দরবনে দুই বছর পরপর খাল সার্ভে করে আসছে ওয়াইল্ড টিম। এই সার্ভে টিম সুন্দরবনের পাথরঘাটা থেকে কৈখালী পর্যন্ত পুরো ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ঘুরে বেড়ায়, ছোট ছোট নৌকা নিয়ে ঢুকে পড়ে জঙ্গলের ছোট থেকে আরও ছোট খালগুলোতে। অনেক সময় খালগুলো এতই সরু থাকে যে দুই পাড়ের গাছের মাথা এক হয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি হয়। বাঘ আছে জেনেও এমন একটা খালে ঢুকে পড়তে সাহস লাগে। সেই দলের মাঝে একসময় আমিও ঢুকে গেলাম। প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু করে সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত আমরা ঘুরে বেড়াতাম এ খাল থেকে সে খালে।  খুঁজতাম বাঘের পায়ের ছাপ। কখনো সারা দিন হরিণ, শূকর আর ভোঁদড়ের পায়ের ছাপ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো, আবার কখনো দিনের শুরুতেই পেয়ে যেতাম বাঘের পায়ের তাজা ছাপ। উল্লসিত আমরা খুব ভালো একটা ছাপ উঠিয়ে নিয়ে আসি, নানা রাসায়নিক দিয়ে সেটাকে বাঁধাই করে ফেলি। এ রকম ছাপই আমাদের মাসের পর মাস সার্ভের ফলাফল। কিন্তু কখনোই বাঘ দেখিনি, আমাদের অন্য টিম হয়তো বাঘ দেখে ফেলেছে, তাদের সে কী উল্লাস! সবাই বলে, জঙ্গলের বাঘ দেখতে পুরোই রাজকীয়। দূর থেকে দেখা এই বাঘগুলোর খুব ভালো মানের ছবি বা সুন্দর কোনো ছবি কখনোই তোলা সম্ভব হয়নি। কারণ, বাঘ হয়তো গোলপাতার আড়ালে চলে যায়, অথবা শুধু বাঘের লেজ দেখা যায়, আবার অনেক সময় ক্যামেরা বের করতে না করতেই পুরো বাঘটাই হারিয়ে যায় ঘন জঙ্গলে।

বাঘের পায়ের ছাপ পরীক্ষা করছেন ওয়াইল্ড টিমের সদস্যরা
ছবি: আলম হাওলাদার

২০১৬ সালে আবার শুরু হলো খাল সার্ভে। নভেম্বরের ২৪ তারিখ থেকে একসঙ্গে দুটো দল চার মাসের জন্য হারিয়ে গেল জঙ্গলে। এক দল করেছে খাল সার্ভে, অন্য দল ক্যামেরা ট্র্যাপিং। শুনতে যত সহজ মনে হয়, আসলে কাজগুলো তার চেয়েও হাজার গুণে কঠিন। বাঘ আছে এমন এক জঙ্গলের আঠালো মাটিতে জীবন হাতে নিয়ে নামতে দুরন্ত সাহসের দরকার। গাছে গাছে ক্যামেরা লাগিয়ে আবার ঠিকঠাকমতো নৌকায় ফিরে আসা মানে নতুন জীবন পাওয়া। একইভাবে খাল সার্ভেতে ভাটায় কখনো আটকে গেলে অপেক্ষা করতে হয় জোয়ারের জন্য।

সকাল-সন্ধ্যা এক করে যখন আমাদের একটা দল খুলনা আর চাঁদপাই রেঞ্জে খালের পর খাল ঘুরে বেড়াচ্ছে, অন্যদিকে ক্যামেরা ট্র্যাপিং দল চষে বেড়াচ্ছে সাতক্ষীরা রেঞ্জ। প্রতিদিনই খবর আসছে ক্যামেরায় অনেক বাঘের ছবি উঠেছে। কোনোটার শুধু চেহারা, কোনোটার লেজ। কোনোটার পেট অথবা কানের অংশটুকু। কিন্তু  সামনে থেকে এখনো কেউ বাঘ দেখতে পায়নি। আর এদিকে আমরা প্রতিদিন পায়ের ছাপ পাই, কখনো একই বাঘের অনেক, আবার কখনো বাচ্চাসহ মা বাঘের চলাচল।

একদিন আমরা খুব উত্তেজিত। মনে হলো, ঠিক সামনে দিয়েই বুঝি চলে গেল একটা বাঘ। কেউ হলফ করে বলতে পারছে না যে বাঘ দেখেছে। তড়িঘড়ি করে নৌকা থামানো হলো। ঠিক যে দিকটায় সন্দেহ, সেদিকটায়। ঘটনা সত্য! পুরোপুরি তাজা ছাপ—তার মানে মাত্রই একটা বাঘ এখান দিয়ে ঢুকে গেছে জঙ্গলে। আমাদের আফসোসের পারদ জঙ্গলের গাছের সীমানা ছাড়িয়ে আকাশে গিয়ে ঠেকল—ইশ্!  আর একটা মিনিট আগে এলে বাঘটা দেখতে পারতাম। সেদিন সন্ধ্যায় বড় জাহাজে ফেরত এসে শুনি ক্যামেরা ট্র্যাপিং টিমের লোকজন বাঘ দেখে ফেলেছে! ছবি পাঠাল তারা! ই-মেইল খুলতেই প্রত্যেকের চোখ গোলগোলা হয়ে গেল। কী অসম্ভব সুন্দর রাজকীয় একটা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাঘটি! আমাদের ক্যামেরা ট্র্যাপিং টিমের সদস্যরা স্পিডবোটে খালে ঢোকার মুহূর্তে পাশে দাঁড়ানো বাঘটিকে দেখতে পায়, মুহূর্তেই ক্যামেরা বের করে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলেন আলম হাওলাদার ভাই। তিনি নিমেষেই হয়ে গেলেন ইতিহাসের অংশ। সুন্দরবনের ভেতরে মুক্ত বাঘের এত সুন্দর ঝলমলে ছবি আর কেউ কখনো তুলেছে কি না সন্দেহ! বছরের পর বছর ধরে এত গবেষণা, এত আয়োজন, অথচ কারও চোখেই রাজকীয় এই বাঘ এত ঝলমলে রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়নি।

নৌকার একেবারে মাথায় দাঁড়িয়ে নজর রাখতে হয় তীক্ষ্ণ চোখে
ছবি: আলম হাওলাদার

তোমরা যারা ভবিষ্যতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনে যাবে, তারা সব সময় চেষ্টা করবে একটু সময় নিয়ে যেতে। সুন্দরবনকে অনুভব করতে হলে বনের মাঝে খালের ভেতর থাকতে হবে কয়েক রাত। খালের দুই পাড়ে জোনাকি গাছ দেখার যে অভিজ্ঞতা, তা বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যাবে না। এইমাত্র নিরাপদ মনে করা শান্ত জলটুকু যখন কুমিরের আলোড়নে মুহূর্তেই অশান্ত হয়ে যাবে, তখন বুঝবে ভয়ের শিহরণ! নৌকায় ঘুমাতে যাওয়ার মুহূর্তে গায়ের ওপর কম্বলটা টেনে যখন দেখবে ঠিক পাশেই শুয়ে আছে দলা পাকানো অচীন কোনো সাপ, তখন বুঝবে আতঙ্কের রং কেমন!

জল-জঙ্গলের সুন্দরবন সব সময়েই প্রাণের মঙ্গল নিয়ে আসে, কাজেই কখনো দল বেঁধে সুন্দরবনে গেলেও জঞ্জাল ফেলে এসো না। বন পরিষ্কার রাখলেই বনের পশুপাখিরা নিরাপদ থাকবে।