মে মাস আমাদের বাঙালিদের জন্মদিন পালনের মাস। কারণ এ মাসে জন্মেছিলেন বাংলা সাহিত্যের দুই কান্ডারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ মে) ও কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে)। এই দুই কবিকে নিয়ে লিখেছেন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের সেই দশা হয়, যেমনটা হয় মেঘনা যমুনাকে বাদ দিলে বাংলাদেশের জীবনের। রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন নজরুলের ৩৮ বছর আগে, ১৮৬১ সালে যখন বাংলাদেশে একটা পুনর্জাগরণ চলছে। রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই পুনর্জাগরণে অবদান রেখেছিলেন ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার এবং শিক্ষা নিয়ে অগ্রসর চিন্তা ও কাজের মধ্য দিয়ে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত রেখেছিলেন তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ এমন এক পরিবেশে জন্ম নিয়েছিলেন, যা নতুন চিন্তাভাবনা ও উদ্যোগের জন্য অনুকূল ছিল। তাঁর পরিবার ছিল উচ্চশিক্ষিত, আধুনিক এবং প্রগতিশীল। তাঁর ছেলেবেলা নিয়ে লেখায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, তাঁর বাবা থেকে, বড় ভাইদের থেকে তিনি কতটা অনুপ্রেরণা পেতেন নতুন কিছু করার। কিশোর বয়সে তিনি বাবার সঙ্গে হিমালয়ে ঘুরতে গেছেন। এরপর বিলাতে পড়তে গিয়েছেন। তবে স্কুল-কলেজে পড়াটা তাঁর শেষ পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু যে শিক্ষা তিনি পরিবারে পেয়েছেন, তাতে স্কুলে না পড়াটা কোনো ক্ষতির কারণ হয়নি। হয়তো লাভই হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের—তাঁকে পরীক্ষা পাসের জন্য পড়াশোনা করতে হয়নি, তোতাপাখির মতো পাঠ মুখস্থ করতে হয়নি। নিজের মনে অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন, প্রকৃতি থেকে শিখেছেন, জীবন থেকে পাঠ নিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে আনন্দ পেতেন। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ ঝড়হম ঙভভবত্রহমং-এর জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই তিনি ইউরোপ সফর করেছেন। তবে তাঁর জন্য খুব উপকারী ছিল পদ্মা ও তার অনেক শাখা নদীতে একটা হাউসবোটে ঘুরে বেড়ানো। এই বেড়ানোটা প্রয়োজন ছিল তাঁর পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য। ১৮৮০-এর দশকে দীর্ঘ সময় তিনি শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসরে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং বাংলাদেশকে আবিষ্কার করেছেন। অনেক ছোটগল্প, কবিতা ও গান তিনি এ সময় লিখেছেন এবং তাঁর এক ভাতিজির কাছে চিঠি লিখেছেন, যেগুলো পরে ছিন্নপত্রাবলী ও ছিন্নপত্র নামে প্রকাশিত হয়। এসব চিঠি পড়লে বোঝা যায়, তাঁর কবি হয়ে ওঠার পেছনে বাংলাদেশ কতটা অবদান রেখেছিল। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর সারা বিশ্বে তাঁকে নিয়ে একটা হইচই পড়ে গিয়েছিল। তিনি দেশের পর দেশে গিয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, আর মানুষের মন জাগানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সারা বিশ্ব ঘুরেও শেষ পর্যন্ত তিনি ঠাঁই নিয়েছেন সেই বাংলাদেশেই। বোলপুরে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছেন, শিক্ষাকে পাল্টে দিতে চেয়েছেন, কৃষিকাজ নিয়ে নতুন ভাবনা ভেবেছেন, গ্রামকে আগের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দিতে কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক ছিলেন, কিন্তু তিনি দেখতে পেয়েছিলেন পরাধীনতা এবং পশ্চিমা জাতীয়তাবাদ রোমান্টিকতার টুঁটি চেপে ধরে। উপনিবেশি শাসন এবং জাতীয়তাবাদকে আক্রমণ করে তিনি লিখেছেন, আবার উগ্র স্বদেশিবাদেরও সমালোচনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথকে পৃথিবী জানে কবি হিসেবে। আমরা জানি তাঁর আরও অনেক পরিচয় আছে—তিনি গান লিখেছেন এবং গোটা একটি সাংগীতিক ঐতিহ্যই সৃষ্টি করে গেছেন, নাটক-উপন্যাস-ছোটগল্প লিখেছেন, অসাধারণ কিছু ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধের সংখ্যাও কম নয়। ইংরেজিতেও লিখেছেন প্রচুর। বক্তৃতাও দিয়েছেন দেশে-বিদেশে। অক্সফোর্ড ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া তাঁর দুটি বক্তৃতা খুবই বিখ্যাত। শেষ বয়সে তিনি ছবি এঁকেছেন। পশ্চিমে প্রদর্শনী করে সুনাম কুড়িয়েছেন এবং বলা হয়ে থাকে তাঁর হাত ধরে ভারতীয় চিত্রকলা আধুনিকতার রাস্তায় অনেকটাই এগিয়েছে।
এত যে বড় একজন লেখক, এত যাঁর ব্যস্ততা, তাঁর মধ্যে একটা শিশু সারা জীবন বাস করবে এটি ভাবা কঠিন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শিশুদের বিষয়ে ছিলেন খুব দুর্বল। শিশু-কিশোরদের নিয়ে অনেক লিখেছেন (তাঁর ‘বীর পুরুষ’ কবিতাটি আমার সারা জীবনের প্রিয়)। শেষ বয়সে এসে দেখেছেন, পৃথিবীর হানাহানি, রক্তারক্তি থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে একটি শিশু, যদি তাকে ভেতরে ধরে রাখতে পারে মানুষ।
রবীন্দ্রনাথের মতো অত বড় ভাগ্য নিয়ে জন্মাননি নজরুল, আমাদের দুখু মিয়া। জন্ম থেকেই তাঁকে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। অভাব ছিল সংসারে। আর দশটা ছেলের মতো বই-খাতা হাতে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হয়নি। অভাব মেটানোর জন্য একসময় তাঁকে রুটির দোকানে কাজ করতে হয়েছে, রেলওয়ের এক গার্ডের বাড়িতে বাবুর্চির কাজ করতে হয়েছে। নজরুলের ভেতরে একটা ভবঘুরে, একটা বাউণ্ডুলে মন ছিল। কাজেই গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ানো গান-অভিনয়ের দলে—যাকে বলা হতো লেটোর দল—যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি তা কাজে লাগালেন। এটি অবশ্য তাঁর ১২ বছর বয়সে, আসানসোলের রুটির দোকানে চাকরি করার আগে। লেটোর দলে গিয়ে অভাব কিছুটা মেটানো গেল, খাওয়া-পরার ব্যবস্থা হলো, কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর কবি ও শিল্পী প্রতিভার বিকাশের একটা পথ পাওয়া গেল। এ সময় তিনি বেশ কিছু পালাগান বা নাটিকা লেখেন। তবে বেশি দিন লেটোর দলে তিনি থাকেননি। স্কুলে ফিরলেন, স্কুল ছাড়লেন, পুলিশের এসআই কাজী রফিজউল্লাহর সঙ্গে ময়মনসিংহের কাজীর শিমলা গ্রামে গিয়ে কিছুদিন থাকলেন, আবার দেশে ফিরলেন, শুধু ১৯১৫ থেকে ১৯১৭—এই দুই বছর তিনি কাটিয়েছেন শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে। কিন্তু স্কুলে প্রিটেস্ট পরীক্ষা শুরু হলো, আর নজরুলও পরীক্ষা দেওয়া বাদ দিয়ে চলে গেলেন সেনাবাহিনীতে। ৪৯ বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে গেলেন করাচি। হাবিলদার পদটিও পেলেন। করাচি গিয়ে তাঁর লাভ হলো, তিনি ফারসি ভাষা চর্চা করতে পারলেন। সৈনিক থাকা অবস্থাতেই তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ আর প্রথম গল্প ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ লিখলেন। এরপর তিনি ক্রমাগত লিখতে থাকলেন কবিতা, গল্প, গান। লিখলেন একটি পত্রোপন্যাসও। ১৯২২ সালে একটি অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা ধূমকেতু সম্পাদনা শুরু করলেন। এই পত্রিকাতেই বেরোয় তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি। এই কবিতা লেখার অপরাধে তাঁর জেল হলো। জেলে তিনি রাজবন্দীদের প্রতি অমানুষিক আচরণের জন্য অনশনে যান।
১৯২২ সালটি ছিল নজরুলের জন্য এক ফলপ্রসূ বছর। এ বছর বেরোয় তাঁর কবিতার বই অগ্নিবীণা, জেলে বসে লেখেন ‘শিকল পরার গান’, ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ ইত্যাদি কবিতা।
১৯৪২ সালের ১০ আগস্ট এক গুরুতর অসুখে নজরুল তাঁর সচেতন সত্তাটি হারান, কথা বলার শক্তিও হারান। কিন্তু ১৯২২ থেকে ১৯৪২—এই কুড়ি বছরে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা ও গান, যেগুলোর অনেকটির সুরও তিনি দিয়েছেন। দিলখোলা মানুষ ছিলেন নজরুল। আড্ডা পছন্দ করতেন, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করতেন না। উপনিবেশি শাসনের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে এবং মনুষ্যত্বের অপমানের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী এবং আপসহীন। অন্যায়কে সহ্য করতেন না, জেলজুলুমের ভয় করতেন না। অথচ তাঁর ছিল অসম্ভব রোমান্টিক একটি মন। নজরুলও নিজের ভেতর একটি শিশুকে লালন করে গেছেন সারা জীবন। সেই শিশুটি কখনো তিনি নিজে, কখনো বুলবুল নামের মাত্র চার বছর বয়সে মারা যাওয়া ছেলেটি। তাঁর সাত ভাই চম্পা বইটি সব শিশু-কিশোরের কাছে একটি প্রিয় বই।
বাংলা সাহিত্যের এ দুই দিকপাল জন্মেছিলেন গ্রীষ্মে। গ্রীষ্মটা এক কঠিন ঋতু, কিন্তু এ ঋতুতেই ফলে বাংলার সুস্বাদু যত ফল। এ দুই কবি হলেন দুই বিশাল ফলবান গাছ, যার নিচে গেলে খালি হাতে কেউ ফিরে আসে না।