বাংলা রূপকথা: মায়ের আঁচলের ঘ্রাণ

অলংকরণ: রাকিব

ইংরেজি Fairy Tales-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে রূপকথা শব্দটি ব্যবহৃত। ইংরেজি Fairy Tales-এ পরিদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। বাংলা রূপকথায় কিন্তু পরিদের উপস্থিতি নেই। তবে Fairy Tales-এর বাংলা রূপকথা করা হয়েছে কেন? তবে কি রূপের কথাই রূপকথা? হতেও পারে। রূপকথা কী—এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মত-পথ আছে। থাকুন পণ্ডিতেরা তাঁদের মত-মতান্তর নিয়ে। অতশত বিতর্কে না গিয়ে আমরা বরং রূপের দিকে তাকাতে চাই। পৃথিবীর সব মানুষই কোনো না কোনোভাবে সুন্দর (Fair)। সব সুন্দরেরই একটা স্থানীয় সংজ্ঞা থাকে। সুন্দরের সেই স্থানীয় সংজ্ঞায় কোনো মেয়ে দেখতে সুন্দর হলে বলা হয়, মেয়েটি রূপবতী। আর ছেলে সুন্দর হলে বলে রূপবান। তাহলে রূপকথা মানে আমরা বলতে পারি সুন্দর কথা। কথা মানে আমরা মুখে যা বলি, তা-ই। কিন্তু সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় কথা শব্দটি সাধারণত কাহিনি অর্থে বেশি ব্যবহৃত হয়। সেই হিসেবে রূপকথার মানে দাঁড়ায় সুন্দর কাহিনি (Fairy Tales)। তাহলে যেকোনো সুন্দর কাহিনিকে আমরা রূপকথা বলব! এ কথা শুনে পণ্ডিতেরা তো তেড়েমেড়েও আসতে পারেন। কিন্তু রূপকথা তো সুন্দর আখ্যান বা কাহিনিই। প্রশ্ন হলো, কেমন সে সুন্দর। সে কি আমাদের চেনাজানা সুন্দর কাহিনি বলে! অথবা নাটকে, উপন্যাসে, গল্পে যেমন বাস্তবের মতো সুন্দর সুন্দর কাহিনি বলা হয়, রূপকথার কাহিনিগুলো কি তেমন!

আমরা রূপকথার জগতে ঢুকতে চাই? কিন্তু একটু অরূপের মধ্য দিয়ে যেতে চাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায়ই তাঁর গান, কবিতা, প্রবন্ধে এই অরূপের কথা বলেছেন। বলেছেন রূপের কথাও। আমাদের চারপাশের চেনা জগৎ-মানুষ-সম্পর্ক হচ্ছে রূপের জগৎ। প্রতিদিনের দেখাশোনায়, জানাশোনায় আমাদের চারপাশ, অর্থাৎ দেখা রূপের জগৎ একঘেয়ে লেগে ওঠে। তখন কিন্তু আমরা একটু ‘অরূপরতনের’ দিকে ঝুঁকি। অরূপ মানে কিন্তু খারাপ চেহারা নয়। অরূপ মানে চেনাজানার বাইরের জগৎ। রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছেন, ‘চেনাশোনার কোন্‌ বাইরে/ যেখানে পথ নাই নাই রে/ সেখানে অকারণে যাই ছুটে’। এই চেনাজানার বাইরের জগৎই রূপকথার জগৎ। এই রূপকথার জগতের মধ্যে সবকিছু যে সুন্দর আর ভালো, তা কিন্তু নয়। খারাপও থাকে। থাকে জাদুটোনা, রাক্ষস-খোক্ষস।

একটা কিশোর বা কিশোরীর পৃথিবী থাকে ছোট। তার চলাচলতি থাকে ছোট জায়গার মধ্যে। কিন্তু পৃথিবীটা যে বড়, সে আভাস সে প্রতিদিন তার চারপাশ থেকে ঠিকই পেয়ে যায়। অথবা তার মনের মধ্যে না দেখা জগৎ সম্পর্কে একটা কল্পনার স্বাধীন পৃথিবী তৈরি হতে থাকে। সেই কল্পনার জগতের কথা বলে রূপকথা। এ জন্য রূপকথা তার এত প্রিয়। মা-নানি-নানা-দাদি-দাদাদের মুখে বাহারি রূপ-রং-রসের জগতের কথা শুনে তৃপ্তি আর আনন্দে সে ঘুমিয়ে পড়ে। অচেনা-অজানা জগতে কল্পনার রাজকন্যা-রাজপুত্র, রাক্ষস-খোক্ষস, পঙ্খিরাজ, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর সঙ্গে বিপদ-আপদের ভেতর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সে যেন বড় ক্লান্ত হয়ে যায়। অবশেষে তার পক্ষ যখন জিতে যায়, তখন এক অপার ভালো লাগা নিয়ে সে চলে যায় ঘুমের জগতে। সেখানেও হয়তো সে বুনতে থাকে স্বপ্নের ইন্দ্রজাল। এই তো রূপকথার মজা!

কিশোর-কিশোরীরা তাদের পেছন-পেছন ঘুরঘুর করত আর বায়না ধরত, ‘দাদা! ও দাদা! একটা গল্প শোনাও না!’ বুড়োরাও কম যেতেন না! পান খাওয়াও, সুপারি খাওয়াও, চুন এনে দাও, চশমা খুঁজে দাও, হেন করো, তেন করো!

কিন্তু কল্পনার জগৎ তো আরও নানা কাহিনির মধ্যে থাকে। যেমন উপকথাও কল্পলোকের কথা বলে। অসম্ভবের পায়ে এই কাহিনিগুলোও মাথা খোঁটে। তাহলে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য অনেক জায়গায়। রূপকথা প্রধানত মানুষের কথা, কিন্তু উপকথায় পশুপাখিই প্রধান থাকে। রোমান্সধর্মী কল্পকাহিনি জমিয়ে তোলাই রূপকথার মূল উদ্দেশ্য। তত্ত্বকথা বা নীতিকথা প্রচার উপকথার মূল উদ্দেশ্য। ‘অবশেষে তারা সুখে-শান্তিতে দিন কাটাইতে লাগিল’—এ ধরনের বাক্য দিয়ে মিলনাত্মক পরিণতি দেখিয়ে রূপকথা শেষ হয়। আর উপকথায় অশুভ শক্তির করুণ পরিণতি দেখানো হয়। পার্থক্য যা-ই হোক না কেন, দুটোই কিন্তু আমাদের লোকসাহিত্যের খুব শক্তিশালী দুটি শাখা। একসময় বুড়ো দাদা-দাদি, নানা-নানিদের পেট গিজগিজ করত এসব কল্পকাহিনিতে। কিশোর-কিশোরীরা তাদের পেছন-পেছন ঘুরঘুর করত আর বায়না ধরত, ‘দাদা! ও দাদা! একটা গল্প শোনাও না!’ বুড়োরাও কম যেতেন না! পান খাওয়াও, সুপারি খাওয়াও, চুন এনে দাও, চশমা খুঁজে দাও, হেন করো, তেন করো! দুনিয়ার বাহানা। নানা ফাইফরমাশ খাটিয়ে মজা নিয়ে অবশেষে হাতের লাঠিটা পাশে সরিয়ে রেখে পাটি পেতে সবার মধ্যে বসে বুড়োরা খুলতেন তাঁদের গল্পের ঝাঁপি। গ্রামবাংলার এই সব রূপকথার জাদুকরের মুখ থেকেই তো সংগ্রহ করা হয়েছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি, দাদামশায়ের থলে। হাজার বছর ধরে প্রচলিত এই সব রূপকথার আদলে রচিত হয়েছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুলসহ আরও কত কত গ্রন্থ!

আজকালকার বাংলার ঘরে ঘরে আগেকার দিনের মতো সেই রূপকথার ঝাঁপিওয়ালা দাদা-দাদি, নানা-নানিরা নেই বললেই চলে। কিন্তু কল্পনার বাহারি জগৎ ঠিকই হানা দেয় কিশোর-কিশোরীদের মনের অন্দরে। কল্পলোকের তৃষ্ণা মেটাতে তারা ঠিকই পাঠ করে চলেছে দেশি-বিদেশি বিচিত্র রূপকথার বই। বর্তমানে গোটা পৃথিবী ঢুকে পড়েছে প্রতিটি দেশের ভেতর। পৃথিবীর বিচিত্র দেশের রূপকথা এখন ছোটদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু স্বদেশি ভাষা ছাড়া যেমন তৃষ্ণা মেটে না, তেমনি স্বদেশি রূপকথা ছাড়া কি কল্পলোকের পিপাসা মেটে! আর নিজের দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়া মানে তো মায়ের আঁচলের ঘ্রাণ নেওয়া, এ কথা কে না জানে!